চাকরি নিয়ে তুমুল মস্করা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে নাকি ৩০ হাজার চাকরি তৈরি! সরকার নাকি শুধুমাত্র নিয়োগপত্র দেওয়ার অপেক্ষায়। একই নিঃশ্বাসে শিল্প নিয়ে বলে গেলেন অবান্তর, আবোলতাবোল কিছু কথা “শিল্প শুধুই কি কাঠ-খড়? শুধু বালি-সিমেন্ট? শিল্প মাটি-ঘাস-গাছ থেকে হয়”। এটা বলতে তিনি কোন ধরনের শিল্পের কথা বোঝালেন, কর্মসংস্থানের কোন বিকল্প ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করলেন তা ধোঁয়াশাই থেকে গেল। এদিকে, রাজ্যে কর্মসংস্থানের মর্মান্তিক ছবি দিন কয়েক আগে ফুটে বেরোলো। সংবাদে প্রকাশ, মালদায় সরকারি কর্মসংস্থান কেন্দ্র পরিচারিকাদের জন্য একটা প্রশিক্ষণ শিবির সংগঠিত করে, যাতে অংশ নেন ৪০ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মহিলারা! তিনদিন ধরে চলা মালদা যুব আবাস কেন্দ্রে এই প্রশিক্ষণ শিবিরে শেখানো হল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শুশ্রূষা, শিশু ও বৃদ্ধদের কিভাবে দেখভাল করতে হয়, ফার্স্ট এইড, ঘর গোছানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পদ্ধতি ইত্যাদি। তিনদিনের প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা পেলেন ৬৫০ টাকা ভাতা, একটা ব্যাগ ও সার্টিফিকেট! রাজ্যের কর্মসংস্থানের হাল যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা এই ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয়।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ৩০ হাজারের শিল্প মানচিত্রই বা কি? দেউচা-পাঁচামী কয়লা ব্লক অধিগ্রহণের সময় তিনি তখনও বিপুল কর্মসংস্থানের গপ্পো শুনিয়েছিলেন। এযেন সব শিয়ালের এক রা! ক্ষমতার সিংহাসনে বসা সমস্ত রঙ বেরঙের শাসক কর্মসংস্থান নিয়ে যে সুরে কথা বলেন, মমতার কন্ঠেও তার প্রতিধ্বনি! কিন্তু, একবারের জন্যেও তিনি জানালেন না, রাজ্য সরকারের দপ্তরগুলোতে কত শূন্যপদ রয়েছে, সেগুলো পূরণের জন্য সরকার কী ভাবছে, সরকারি দপ্তরগুলোতে অনেক কম মাস মাইনের বিনিময়ে বেলাগাম অস্থায়ী, ক্যাজুয়াল কর্মী নিয়োগের যে অনিয়ন্ত্রিত খেলা চলছে, এটাই কি তবে রাজ্যে কর্মসংস্থানের আসল গল্প?
দশ বছর পর রাজ্য শ্রমদপ্তর বাড়ালো ১০ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য। দশ বছরের মূল্যস্ফীতি যদি এই মজুরি বৃদ্ধির সাথে যুক্ত করা হোত তবে তা বেশ কিছুটা বাড়তো। অত্যন্ত কম মজুরির জন্য রাজ্যে এখন পড়ে থাকা দু’ই শ্রম ঘন শিল্প – চটকল ও চা এ শ্রমিকরা অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ তাই রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে।
সেন্সাস ২০১১ (এটাই সর্বশেষ) থেকে জানা যায়, ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রায় ৫.৮ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে, যা উত্তরপ্রদেশ (৩৭.৩ লক্ষ), বিহার (২২.৬ লক্ষ) ও রাজস্থানের (৬.৬ লক্ষ) ঠিক পরেই। আর, শহর ও গ্রাম – এই দু’টো জায়গা থেকেই মানুষ গেছেন, যা প্রমাণ করে, আর সেন্সাস রিপোর্টও বলছে, এরাজ্যে কাজ না পাওয়ার জন্য। মনোজ দেবনাথ ও ডি কে নায়েক তাঁদের এক গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন, বর্ধমান (অবিভক্ত), নদীয়া, হুগলির মতো উন্নত চাষাবাদের জেলাগুলো থেকে, আর তারসাথে মুর্শিদাবাদও রয়েছে, এই পরিযানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আরও একটা সমীক্ষায় (ডেল্টাস্, ভালনারিবিলিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জঃ মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাডাপ্টেশন) দেখা যাচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৫১টি ব্লকের ৬৪ শতাংশ মানুষ আর্থিক কারণে, অলাভজনক কৃষির জন্য অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন স্রোতের মতো।
গ্রামীণ ও শহুরে বেকারত্বের সংখ্যা ২০১০’র পর থেকে হুহু করে বাড়তে থাকে। এনএসও ২০১৯’র সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ বেকারির হার দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং গত তিন দশকে তা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। সেন্সাস ২০১১’র রিপোর্ট বলছে ২০০০ সালে এই প্রথম পশ্চিমবাংলায় পরিযান পরিস্থিতি ঋণাত্বক হয়ে দাঁড়ায়, যার অর্থ হল, ভিনরাজ্য থেকে এরাজ্যে আসার বদলে এরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার সংখ্যা অনেক ছাপিয়ে গেছে। এমনকি, বিদেশে, বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ায় যে সমস্ত রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা রুটি রুজির তাগিদে পাড়ি দেয় তারমধ্যে প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবাংলা রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, অতিমারীর প্রকোপ নিয়ে এক সমীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়েছে উল্টো বা বিপরীতমুখী পরিযানে যারা একসময়ে এরাজ্যে ফিরে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আবার ফিরে যেতে চাইছে, কারণ এরাজ্যে তাঁদের উপার্জন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০০০ সালে এই পরিযান প্রবণতা ঋণাত্বকে নেমে আসার পর এখন অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী দিনগুলোতে আরও অনেক অনেক মানুষ এরাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে পা রাখবে উন্নত কাজ ও মজুরীর সন্ধানে। দিনের পর দিন বাড়তে থাকছে গ্রামীণ বেকারির হার। ২০০৯-১০ সালে যে গ্রামীণ বেকারির হার ছিল ১.৯ শতাংশ, তা ২০১৭- ১৮তে লাফ দিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৮ শতাংশে। গ্রামীণ বেকারির হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে যা বিগত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ঠেকেছে।
সেন্সাস রিপোর্ট বহিঃপরিযানের যে সাতটা কারণকে চিহ্নিত করেছে, তারমধ্যে ‘কাজ/কর্মসংস্থান’ অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সেন্সাস রিপোর্ট দেখিয়েছে যে এরাজ্য থেকে ভিনরাজ্যে চলে যাওয়ার যে ঢল তার প্রধান কারণ হচ্ছে এরাজ্যে কাজ না পাওয়া। ১৯৯১ সালে এই বাইরে যাওয়ার হার ছিল ২১ শতাংশ যা ২০০১এ বেশ অনেকটা বেড়ে হয়ে দাঁড়ালো ৩৭.২ শতাংশ। সামান্য হ্রাসপ্রাপ্ত হয় ২০১১ সালে (৩৪.২ শতাংশ)। আর, শহরের (৩১ শতাংশের) তুলনায় ক্রমে বেড়ে চলা গ্রামীণ (৩৮ শতাংশ) পরিযান রাজ্যের কৃষি অর্থনীতির চরম দুরাবস্থাকেই প্রতিফলিত করে।
এরাজ্য থেকে কী বিপুল পরিমাণে পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে চলে যায়, তার হদিস পাওয়া গেল কোভিডকালীন লকডাউনের সময়ে। সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একটি ভিডিও কনফারেন্সে সরকারিভাবে ঘোষণা করেন যে ১০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরে এসেছেন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রাজ্যে কর্মসংস্থানের ঘোর সংকটের জন্যই রাজ্যের মানুষ অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছেন, এটা নতুন ব্যাপার নয়।
পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস) ২০১৭-১৮ অনুযায়ী (এটি কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, শ্রমিক সংখ্যার অনুপাত, বেকারত্বের হার সম্পর্কিত প্রধান প্রধান সূচক) এরাজ্যে বেকারত্বের হার হল ৪.৬ শতাংশ, যা ২০১১-১২’র ৩.২ শতাংশ থেকে বেশ খানিকটা বেশি। ২০১১’র সেন্সাস অনুযায়ী, এই রাজ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমজীবী মানুষ (৬৯ শতাংশ) কৃষিকাজের সাথে যুক্ত, আর শিল্পক্ষেত্রে নিয়োজিত ২২ শতাংশ মানুষ। ক্ষেত্রভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ ও বিকাশ নির্ভর করে রাজ্যের সামগ্রিক আর্থিক বৃদ্ধির উপর। ১৯৯০ ও তার কিছুদিন পর পর্যন্ত আয়ের দিক থেকে পশ্চিমবাংলার অবস্থান বেশ ভালো থাকার পর তা নীচে গড়াতে শুরু করল ২০০০’র পর থেকে। আর, ২০১০’র মধ্যে তা সম্পূর্ণ গতিরুদ্ধ হয়ে যায়। গ্রামীণ ক্ষেত্রে বিরাজমান গভীর সংকট আয় বৃদ্ধির সব রাস্তাকেই একে একে বন্ধ করে দিচ্ছে। রাজ্যের শিল্পক্ষেত্র এমন এক বদ্ধজলায় পরিণত হয় যেখানে গ্রামীণ শ্রমশক্তিও আর এইক্ষেত্রে কোন স্থান করতে পারলনা। পরিষেবা ক্ষেত্রটি তুলনামূলক ভাবে দক্ষ শ্রমের জন্য সংরক্ষিত থাকায় অগণন অদক্ষ শ্রমকে এরাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে জীবন জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিতে হচ্ছে। (এই প্রতিবেদনে সাহায্য নেওয়া হয়েছে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’তে প্রকাশিত গবেষণালব্ধ একটি মনোজ্ঞ লেখা – মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল সিন্স ১৯৯১, অভিজিত মিস্ত্রী, ১৭ জুলাই ২০২১)।
২০০১-২০০৬’র বুদ্ধবাবুর আমলে বাম সরকার পুরোপুরি গতিরুদ্ধতায় পড়ে। নতুন কর্মসংস্থানের সমস্ত সম্ভাবনা বেশ ধাক্কা খায়। রাজ্য বিরাট এক সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। আর, সার্বিক অর্থনৈতিক গতিরুদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ পেতে বুদ্ধদেববাবুর সরকার তখন যে আগ্রাসী শিল্পায়নের রাস্তা ধরল, তা ৩৪ বছরের বাম জমানাকে ঠেলে দিল অস্তাচলে। বাম জমানার শেষ লগ্নে আর্থিক সংকট থেকে শুরু করে নতুন কর্মসংস্থানের যে করুণ চলচ্ছবি ফুটে উঠে, তা তৃণমূলের তৃতীয় দফার জমানায় আরও মর্মান্তিকভাবে প্রকট হয়েছে। এই আর্থিক অবরুদ্ধতা তৃণমূলী শাসনের সর্বাঙ্গে চরম অধঃপাতের দগদগে ঘা নিয়ে হাজির। অর্থনৈতিক বিকাশের পথে কোন জনবিরোধী শাসন যদি তার অন্তরায় হয়ে ওঠে, তবে বিকাশের অমোঘ নিয়মে ইতিহাসই তাকে উপড়ে ফেলবে। আর, অনাগত সেই অধ্যায়ে কান্ডারীর ভূমিকা পালন করতে রঙ্গমঞ্চে যাতে বামেরা উপস্থিত থাকতে পারে তারজন্য আজ থেকে সলতে পাকানো শুরু করতে হবে।
- অতনু চক্রবর্তী