কিছুদিন আগেই হৈচৈ শুরু হয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিক অকৃতকার্য ছাত্রী ‘আমব্রেলা’ বানান জানেনা, অনুরূপ ছাত্র এইচএস’এর সম্পূর্ণ কথাটা কী বলতে পারেনি বলে। সম্প্রতি বিহারে একজন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহজ ইংরেজি জানেননা, এরাজ্যে একজন প্রাথমিক শিক্ষককে অভিভাবকরা বিয়োগ অঙ্ক করতে দিয়েছিলেন, তিনি পারেননি। ফলে সব মিলিয়ে শিক্ষার হাল যে খারাপ তা জানা গিয়েছে। ওদিকে শিক্ষার অধিকার আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সকলকেই পরবর্তিশ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার নীতির ফলেই দেশে শিক্ষা গোল্লায় গিয়েছে এতো অতি চর্চিত ব্যাখ্যান। এরাজ্যে প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার ফলও নাকি বিষময় হয়েছে। এরাজ্যে তো শিক্ষক নিয়োগে অবারিত দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে। আলোচনাও চলছে যে ওই নিয়োগ দুর্নীতির ফলেই শিক্ষা গোল্লায় যাচ্ছে। কিন্তু যে ছাত্রীছাত্র এখন আমব্রেলা বানান বা এইচএস’এর পুরো কথা জানে না তারা তো ২০১৬-১৭-১৮ সালের নিয়োগ দুর্নীতির আগে নিযুক্ত শিক্ষকদের কাছেই পড়াশোনা করেছে। তাহলে নীতিনিষ্ঠ নিয়োগ পদ্ধতিতে নিযুক্ত শিক্ষকেরাও যথাযথ শেখাতে পারেননি। সব মিলিয়ে শিক্ষার পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন, অন্তত এরাজ্যে, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, দ্বিমত রয়েছে কবে থেকে শিক্ষায় এই পতন শুরু হয়েছে তা নিয়ে। তেমন কোনো পরিসংখ্যান ব্যবহার না করে কয়েকটি টুকরো টুকরো নিবন্ধে চেষ্টা করা হবে শিক্ষার সমস্যাকে ধরতে ও সমাধানের দিকে ইঙ্গিত করতে।
যারা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত তাদের একটা আক্ষেপ বা ছুতো রয়েছে যে, যারা পাঠগ্রহণ করতে আসে তাদের অনেকেই নির্দিষ্ট শ্রেণিতে পঠনের উপযুক্ত নয়। তাই তাদের শেখানো যায় না। যেহেতু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘নো ডিটেনশন’, এবং আগের শ্রেণিতে তারা শেখার ‘অযোগ্য’ তাই প্রায় কিছু না শিখেই তারা অষ্টম শ্রেণিতে উঠে যায়। তারপরে অনুর্ত্তীর্ণ হয়ে পড়া ছেড়ে দেয়, বা বিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে পরবর্তী শ্রেণিগুলিতে উঠে যায়, মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত। যাঁরা প্রথম শ্রেণি থেকে ফেল চালু করার পক্ষে তাঁরা কয়েকটি খুঁটিনাটি বিষয় ভুলে যান। প্রথমত, প্রথম শ্রেণিতে তো কোনো ছাত্ররই কিছু না শিখে এসে একদম নতুন করে শুরু করার কথা, তাহলে তারা কেন সেই প্রথম শ্রেণি বা শুরুর শ্রেণিতে কিছু শিখল না বা যথাযথ শিখল না? ওই শুরুতে না শেখার দায় কার? অবশ্যই সে দায় ছাত্রীছাত্র বা তার অভিভাবকদের হতে পারেনা। কোনো দায়বদ্ধ সমাজেই বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বাড়িতে নিতে দেওয়া হয়না। বিদ্যালয়ের শিক্ষা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই সম্পূর্ণ করা দস্তুর। ওই শিক্ষা সমাপনের জন্য যতটা সময় প্রয়োজন ততক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা হবে, এবং অন্যদিকে সেই শিক্ষাদানের সময় সাপেক্ষে পাঠক্রম তৈরি হবে। যদি তেমনটা হত এরাজ্যে ও দেশে তাহলে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠা ছাত্রীছাত্ররা যথাযথ শিখেই উঠত। এভাবেই এগোত বিষয়টি। ফলে ফেল করানো বিষয়টি আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার যাঁরা চালক, পাঠক্রম নির্মাতা, বিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের সময় ও শ্রেণিতে ছাত্রীছাত্র সংখ্যা নির্ধারণকারী ও শিক্ষক তাদের অদক্ষতা প্রসূত ভাবনা থেকে আসে। তার থেকেই ‘সমালোচনা’ করা হয় ‘শিক্ষা গ্রহণ অযোগ্য’ ‘ফার্স্টজেনারেশন লার্নার’দের। শোনা যায়, বাবা মা নিরক্ষর বা অশিক্ষিত তাই বাড়িতে কিছু শেখে না, ফলে কিছুই পারে না। ছাত্রীছাত্রদের যে বাড়িতে শেখার কথা নয়, বিদ্যালয়েই শেখার কথা সেটা খেয়াল থাকেনা। অন্যদিকে বিদ্যালয়ে শেখা সম্পূর্ণ হয় না বলে বাড়িতে পড়ানো বা প্রাইভেট ট্যুইশন শুরু হয়। প্রকারান্তরে শিক্ষার বেসরকারিকরণ ঘটে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ছাত্রীছাত্রদের ফেল করানোর পক্ষে থাকা শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ামক সমালোচকদের মাথায় থাকে না যে, যদি বিপুল সংখ্যক ছাত্রীছাত্র ফেল করত, না শেখার ফলে, তাহলে বিদ্যালয়গুলির শ্রেণিকক্ষে একধরণের ব্যাপক স্থান বৈষম্য সৃষ্টি হত। মনে রাখা দরকার, প্রথম শ্রেণিতে অনেকে অকৃতকার্য হলে পরবর্তী বছরে দ্বিতীয় শ্রেণি অনেকটাই ফাঁকা থাকবে ও প্রথম শ্রেণিতে স্থান সঙ্কুলান হবে না। তাই বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে সুষ্ঠভাবে চালাতে গেলে অনুর্ত্তীর্ণ রাখা কেবল ব্যতিক্রম হিসেবে থাকতে পারে।
দেশে বা রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগে বৈষম্য, কত শতাংশ বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় পাশ করল, আইআইটি’র প্রবেশিকা পরীক্ষায় কোন রাজ্য থেকে কে প্রথম হল, কতজন উত্তীর্ণ হল, আইআইএম বা আইআইটির ছাত্রীছাত্ররা কত উচ্চ বেতনের চাকুরি পেল এসব নিয়ে যত আলোচনা প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায় তার বিন্দুমাত্রও শিক্ষার গুণগত মান বিষয়ে আলাপ আলোচনায় দেখা যায় না। ‘প্রথম’য়ের মত দু’একটি অসরকারি সংস্থা বিদ্যালয় শিক্ষার হাল নিয়ে সমীক্ষা করে, কিন্তু কীভাবে ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সকল শিশুর জন্য সমমান ও গুণমানযুক্ত বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা যেতে পারে তা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা সরকারিস্তরে চোখে পড়ে না। যেধরণের নতুন নতুন শিক্ষানীতিই আসুক না কেন গ্রামের শিশু ও শহরের শিশুদের মধ্যে, ধনী পরিবারের শিশু ও গরিব পরিবারের শিশুদের মধ্যে, ইংরেজি মাধ্যম ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্রদের মধ্যে বিপুল পার্থক্যকে মিটিয়ে দেওয়ার কোনো অন্তর্বস্তুই তাতে থাকে না। শিক্ষক সংগঠনগুলিও মূলত তাঁদের পেশাগত দাবিদাওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষাকে সুসংহত ও পরিপূর্ণ করে তোলার কোনো আন্তরিক এজেন্ডা সেখানে থাকে না। ফলে ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষার গুণগত ফারাক ক্রমাগত বাড়তে থাকে, শ্রেণি বিভক্ত সমাজে বিভাজনটিও পোক্ত হয়।
- অমিত দাশগুপ্ত