দেশব্যাপী কট্টর সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের আক্রমণ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকের সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম নিয়ে প্রতিবাদী প্রতিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গত ৮ মে বারাসাত তিতুমীর সভাকক্ষে আহুত কনভেনশনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছিল “প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চ”। সেই কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এই মঞ্চের শাখা বা এর সাথে যুক্ত সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এরকম দুটি আঞ্চলিক ইউনিট আত্মপ্রকাশ করল বনগাঁ ও বারাসাতে।
গত ৯ জুলাই বনগাঁর কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের অতীশ বিশ্বাস সভাকক্ষে গড় উঠল “বনগাঁ সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চ”। এই উদ্যোগে বনগাঁর শতাধিক সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের মানুষ উপস্থিত হন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বরিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী অনাথবন্ধু ঘোষ। সভায় প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষে সম্পাদক দীপক মিত্র প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার যে প্রয়াস চলছে তার বিরুদ্ধে লেখক শিল্পী কলাকুশলীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে। বনগাঁ সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষে প্রস্তুতি কমিটির সম্পাদক দেবাশিস রায়চৌধুরী মঞ্চ গঠনের উদ্দেশ্য লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, বর্তমান সময়ে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কর্মীর শাসক ঘনিষ্ঠতা, সুবিধাবাদী প্রবণতা পরোক্ষভাবে দেশে সার্বিক স্বৈরাচার, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত ঘটাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। এই প্রেক্ষিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি আরো বলেন, এই মঞ্চ সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে আলোচনা সভা, বিতর্কসভা, পথনাটিকা সহ অনান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে এবং সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করবে। অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় নৃত্য, মূকাভিনয় “রামমোহন” পরিবেশন করে বনগাঁ কালুপুর হিন্দোল সংস্থা, গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান বাবুনি মজুমদার। সবশেষে, “রামমোহন রায় : অনির্বাণ অগ্নিশিখা” শীর্ষক আলোচনা করেন বিশিষ্ট গবেষক কণিষ্ক চৌধুরী। এক কথায় এই মঞ্চের আত্মপ্রকাশ বনগাঁর সাহিত্য সংস্কৃতির ভূগোলে আত্মসমর্পণের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আপোষহীন প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বার্তা দিল।
২০ জুলাই নাট্যশহীদ প্রবীর দত্তকে স্মরণ করে বারাসাত সুভাষ ইন্সটিটিউটে আত্মপ্রকাশ করল প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের দ্বিতীয় ইউনিট “বৃহত্তর বারাসাত প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চ”। এদিনের অনুষ্ঠানে বারাসাত অঞ্চলের সাহিত্য সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের উপস্থিতি ছিল সার্বিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কমবেশি দেড়শোর মতো দর্শক ও শিল্পী সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন বরিষ্ঠ গণসঙ্গীত শিল্পী দুলাল চ্যাটার্জি। নবগঠিত মঞ্চ গঠনের উদ্দেশ্য বিষয়ে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন সমীর চক্রবর্তী, যিনি এই মঞ্চের নবনির্বাচিত সম্পাদক। “বিশে জুলাই, প্রবীর দত্ত ও আজকের প্রাসঙ্গিকতা” শীর্ষক আলোচনা করেন নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবাশিস চক্রবর্তী। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই কার্জন পার্কে যেভাবে প্রবীর দত্তকে পিটিয়ে মেরেছিল, আজও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিভিন্ন ইস্যুতে হত্যা, নিপীড়ন চালাচ্ছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে। প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলায় জেলবন্দী করছে। এর বিরুদ্ধে সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন অনুপম সেনগুপ্ত, মহীউদ্দীন মণ্ডল এবং পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের মধ্যমগ্রাম শাখা। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার, সৌমেন রায় ও জনগণমন সংস্থার সদস্যরা। মূকাভিনয় পরিবেশন করেন মছলন্দপুর ইমন মাইম সেন্টার। সবশেষে তিনদিক দর্শক পরিবেষ্টিত অঙ্গনে 'আয়না' নাট্য সংস্থা করে দেখায় নাটক – “না"।
এই দুটি সংস্থার আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আরও কিছুটা বাড়তে সফল হল। এই লক্ষ্যে প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের আরও ইউনিট গঠনের উদ্যোগ চলবে।