আইপোয়া পশ্চিমবঙ্গ কমিটির বর্ধিত বৈঠকের প্রতিবেদন
AIPWA West Bengal Committee

গত ১৬ জুলাই কলকাতার বিএমপিইউ হলে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ‘আইপোয়া’র রাজ্য কাউন্সিল বৈঠক হয়। শুরুতে আইপোয়ার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদিকা মিনা তিওয়ারী ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নে ফ্যাসিবাদের বিপদ প্রসঙ্গে শিক্ষামূলক বক্তব্য রাখেন।

বহুত্ববাদের সংস্কৃতির যে ইতিহাস ভারতের বিরাজমান সেখানে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী কীভাবে মনুবাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে সেই নিয়ে সভার শুরুতে আলোকপাত করেন ইন্দ্রাণী দত্ত। তিনি ফ্যাসিবাদের পিতৃতান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করেন। ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ধারক ও বাহক আরএসএস’এর আদর্শহিসাবে মনু-সংহিতার প্রচারের তথ্য তুলে ধরেন। মনু-সংহিতায় নারীকে তুলনা করা হয়েছে কুকুরের সাথে। নারীর স্বায়ত্ততা ও স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখা মনুর বচনের মধ্যে অন্যতম। মনুর চোখে, সমাজে নারীর ভূমিকা সন্তান প্রতিপালন ও পরিবারের দেখাশোনা করাতেই সীমিত ছিল। এহেন মনুর আজ্ঞা মেনেই আজও আরএসএস’এর বক্তব্যে ও ভাবধারায় ফুটে ওঠে নারী-বিদ্বেষ। যখন আমরা দেখি, আন্ত-ধর্মীয়, আন্ত-জাতি বিয়ে বা সম্পর্কের অপরাধীকরণ করে লাভ-জিহাদের প্রচার নামায় আরএসএস ও বিজেপি। মেয়েরা কাকে ভালোবাসবে, কার সাথে থাকবে, কীভাবে বাঁচবে সবই আরএসএস ঠিক করে দিতে চায়। কাঠুয়া থেকে হাথরস — গণধর্ষকদের রক্ষা করতে বিজেপি সরকারের নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ ও প্রশাসনিক শক্তি। হাথরসে বিজেপির ঘনিষ্ঠ উচ্চবর্ণ গণধর্ষকদের বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে জেলে ভরা হয় সাংবাদিক সিদ্দিকী কাপ্পানকে। কাঠুয়ার ঘটনায় আট বছরের একটি শিশু কন্যাকে গণধর্ষন ও খুনের ঘটনায় বিজেপির সমর্থক সরকারপক্ষের উকিলরা ধর্ষকদের পক্ষে মিছিল করে। ক্ষমতায় আসার পরে পরেই নারীবাদী পড়াশোনার কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দিয়ে গৃহকর্মের পাঠ্যক্রম চালু করেছে বিজেপি। সাম্প্রতিক সময় কর্ণাটকে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরাকে কেন্দ্র করে, হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলিকে তোল্লাই দিয়ে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিতে উঠে পড়ে লাগে বিজেপি।

মিনা তিওয়ারী তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন বর্তমান ভারতে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের বাস্তব পরিস্থিতি ও অধিকারের প্রশ্নগুলি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৪৬টা দেশের মধ্যে লিঙ্গ-বিভেদের নির্দেশিকা অনুযায়ী ভারত ১৩৫ নম্বর স্থানে আছে। দেশের সরকার ভারতে লিঙ্গ-বিভেদের এই দুর্দশা নিয়ে কোনোরকম মুখ খুলছেনা। অন্যদিকে জন-সংখ্যার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে মেয়েদের সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে পরোক্ষভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করছে। আজকের ভারতের মেয়েরা যে মুখ্য বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে তারমধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর কাজের বেহাল অবস্থা। এই বৈষম্যগুলির সাথে ধর্মের কোনো যোগ নেই, কিন্তু মুখ্য সমস্যাগুলির থেকে নজর সরিয়ে বারবার ধর্ম-বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে নিজেদের জনবিরোধী নীতি চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ভারতের মেয়েরা মোট শ্রম উপার্জনের মাত্র ১৮ শতাংশ ভাগ পান। ভারতের গরিব মানুষেরা দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ। অথচ দেশের সম্পদের ৫৭ শতাংশ সম্পদ দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষস্থানীয় ধনীর হাতে। ২২ শতাংশ সম্পদের মালিকানা দেশের ১ শতাংশ শীর্ষস্থানীয় ধনীর হাতে। সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় গড়া জাতীয় সম্পদ যেমন রেলপথ, বিমানপথ ইত্যাদি আম্বানি-আদানিদের কাছে বেচে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। পুঁজিপতিরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ধার নিয়ে ভারতের জাতীয় সম্পদ কিনছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের টাকায় বানানো সম্পদ তাদেরই ব্যাংকে জমানো টাকা নিয়ে কেনা হচ্ছে। মোদী সরকারের প্রতিটি আর্থিক নীতি গরিব-বিরোধী। অন্যদিকে রাজনৈতিক ফ্রন্টে তারা এক দেশ এক আইনের জুমলা জারি করার চেষ্টা করে মানুষের অধিকার আন্দোলনের আইনি সুরক্ষাকে দমন করতে চাইছে। সংসদে প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করাকে অসংসদীয় বলে জারি করা হচ্ছে। রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মী থেকে সাংবাদিক, যেই এই সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে তাকেই ভরা হচ্ছে জেলে। ভারতের প্রতীকের চিহ্নের চেহারা বদলে হিংসাকে বলবৎ করার চেষ্টা চলছে। ভারতের বিভিন্নতার ইতিহাস বদলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের এজেন্ডা অনুযায়ী গড়া হচ্ছে ভারতের ইতিহাস। আজ মেয়েদের স্বায়ত্ব ও স্বাধীনতার প্রশ্ন কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী ও জনবিরোধী সরকারের হাতে চুড়ান্ত বিপন্ন। এরআগে আমরা দেখেছি, এই সরকারের বিরুদ্ধে সরব মেয়েদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ করতে। সুল্লি, বুল্লি ডিলের মাধ্যমে মুসলিম মেয়েদের যৌন-সামগ্রী হিসাবে বেচাকেনা হতে দেখা গেছে। এমনকি হিন্দুধর্মের বিভিন্নতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে গেলেও সামাজিক মাধ্যমে ধর্ষণ, খুনের হুমকির মুখে পড়ছে মেয়েরা, যেমন সাম্প্রতিক সময় লীনা মেকমেলাইকে ‘কালী’ নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে ন্যক্কারজনক হামলার মুখে পরতে হল।

বৈঠকের সভাপতিমন্ডলী তুলে ধরেন রাজ্যের পরিস্থিতি। এই মোদী সরকারের বিরোধিতা করে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল সরকার ‘লক্ষীর ভান্ডার’এর ভাতা’র ব্যবস্থা করেই মেয়েদের জীবিকা ও অর্থের প্রয়োজনের প্রশ্নে দায় সেরেছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনাকে ‘ছোটো ঘটনা’ বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল সরকার। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ঋণমুক্তি কমিটির মহিলারা নিজেদের জীবিকার দাবিতে কলকাতায় জমায়েত হলে, তৃণমূল সরকারের অকথ্য পুলিশী আক্রমণের মুখে পড়তে হয় তাদের। সবচেয়ে বেশি মেয়েদের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এলেও মেয়েদের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার দাবিগুলিকে দমিয়ে রাখতে চাইছে তৃণমূল সরকার।

রাজ্য নেত্রী চৈতালি সেন অঞ্চলে অঞ্চলে জন সংযোগ বাড়ানোর কথা বলেন। সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন আইপোয়া’র রাজ্য নেতৃত্ব — চৈতালী সেন, কল্যাণী গোস্বামী, কাজল দত্ত, মলিনা বক্সী ও মিতালী বিশ্বাস। আগামী ১০ ডিসেম্বর কলকাতায় আইপোয়া রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেই উপলক্ষে অঞ্চলে অঞ্চলে প্রস্তুতি এবং জেলায় জেলায় সম্মেলন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এবং শিক্ষাশিবিরের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। হুগলী জেলা থেকে শিপ্রা ঘোষ, সুদীপ্তা, রুমা আহেরী, ময়না মুর্মু, পূর্ব বর্ধমান থেকে সুমি মজুমদার, উত্তর ২৪ পরগণা থেকে অর্চনা ঘটক, পশ্চিম বর্ধমান থেকে সন্ধ্যা দাস, দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে কাজল দত্ত, হাওড়া থেকে সুষমা মুখার্জী, সবিতা, মুর্শিদাবাদ থেকে গুলশন বেগম, কলকাতা থেকে মমতা ঘোষ ও সম্প্রীতি মুখার্জী বক্তব্য রাখেন। এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদের বিপদ, মহিলাদের অধিকারের উপর যে হামলা নেমে আসছে — এই বিষয়ে জেলায় জেলায় শিক্ষণ শিবির এবং জন সংযোগ গড়ে তোলার কথা উঠে আসে বিভিন্নজনের বক্তব্যে৷ আদিবাসী নেত্রী ও সংগঠক, ময়না মুর্মু তুলে ধরেন আদিবাসী সংস্কৃতি ও দেবতার ধারণাকে কীভাবে বিজেপি হিন্দুত্বকরণ করার চেষ্টা করছে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ সময় আদিবাসী ও বাঙালী হিন্দুরা আদিবাসীদের মানুষ হিসাবে মনে করত না। আদিবাসীদের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে অস্পৃশ্যতা অভ্যাস করত উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালী। আজ ধর্মনিয়ে চারদিকে দাঙ্গা বাধানোর চক্রান্তের কথা মনে করিয়ে ময়না মুর্মু আরও বলেন, ধর্ম আর দেবতাকে বিশ্বাস করা নিয়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন অভ্যাস ও সংস্কৃতি রয়েছে। এই বিভিন্নতাকে হাতিয়ার করেই ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ঋণ-মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী ও আইসিডিএস কর্মী রুমা আহেরী তুলে ধরেন, করোনা পরবর্তী সময় গ্রামের মেয়েদের কর্ম-সংস্থানের দুর্দশার কথা। মিড-ডে-মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা কোনোরকম সুরক্ষা ছাড়া, অত্যন্ত কম মজুরিতে সরকারের কাজ করছেন, কিন্তু এখনো অবধি তারা ন্যায্য মজুরি বা সরকারি শ্রমিকের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। সম্প্রতি, কর্মসংস্থানের দাবিতে কলকাতায় জমায়েত হওয়া মিছিলের উপর পুলিশী আক্রমণের কথা উল্লেখ করে রুমা বলেন, আমার সাথে গ্রাম থেকে আরো অনেক মিড-ডে-মিল কর্মী, ঋণমুক্তি আন্দোলনের সাথীরা এসেছিল। ন্যায্য কাজের আর মজুরির দাবি চাইলে আমাদের উপর এলোপাথারি লাঠি, মারধর চলেছে। আমরা কেউ ভয় পাচ্ছি না। বরং, আমাদের জেদ আরো বেড়ে গেছে যে আমাদের নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনবোই। প্রতিনিধিদের বক্তব্যে, পরিচারিকাদের কাজকে আরো সংগঠিত রূপ দেওয়ার ও সোশ্যাল মিডিয়াকে নিজেদের আন্দোলনের জন্য ব্যবহার করার গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা হয়। এআইসিসিটিইউ নেত্রী মীনা পাল নারী শ্রমিক ও মহিলা হিসাবে দ্বৈত নিপীড়নের বিরুদ্ধে মহিলা ও শ্রমিক ফ্রন্টের সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করার কথা বলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে জনবিরোধী প্রতিটি আইন ও অপচেষ্টার বিরুদ্ধে নিজেদের দেশজুড়ে সংগঠিত করতে হবে — এই বার্তা দিয়ে সভার বক্তব্য শেষ হয়।

খণ্ড-29
সংখ্যা-28