একজন আদিবাসী মহিলা দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। ঠিক একই সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারের এক সুপারিশ গ্রহণ করেছে। কী সেই সুপারিশ? সেই সব আদিবাসী মহিলা যারা পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার বিচার চেয়েছেন, তাদের ষড়যন্ত্র কারী ও অপরাধী হিসাবে গণ্য করতে হবে! বিজেপি শ্রীমতী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পছন্দের উমেদারি করেছে প্রতীকী অন্তর্ভুক্তির একটি বিষয় হিসেবে। সেই একই বিজেপি, রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তির বিধিবদ্ধ হিংস্রতার বিরুদ্ধে আদিবাসী নারীদের ন্যায় বিচার চাওয়ার যে কোনো চেষ্টাকে ‘অপরাধ’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে! এটা নিয়ে দ্বিতীয়বার সুপ্রিম কোর্ট তার নিজের আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থীদেরই ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করল। প্রথম রায়ে, ২০০২তে গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন যারা, তাদের জন্য বিচার চাওয়ার ‘অপরাধে’ তিস্তা শেতলবাদ সহ গুজরাট পুলিশের প্রাক্তন আধিকারিকদের ‘দোষী’ সাব্যস্ত করেছিল। ১৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট গান্ধীবাদী সমাজকর্মী হিমাংশু কুমার এবং ১২ জন আদিবাসী মানুষ, যারা বস্তারে ২০০৯-এ আদিবাসী গণহত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত চাইতে গিয়েছিলেন শীর্ষ আদালতে, তাদেরই দোষী সাব্যস্ত করল।
এই রায়ে আদালত এই যুক্তি দেখিয়েছে : যেহেতু রিট আবেদনকারীদের পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে বিভিন্ন থানায় দায়ের করা এফআইআরগুলির তদন্ত হয়েছে এবং তদন্তকারী সংস্থা এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে পুলিশবাহিনী নয়, বরং মাওবাদীরাই এই গণহত্যা ঘটিয়েছে, তাই “আপাতদৃষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে এটা বলা যায় যে তথাকথিত পুলিশবাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে প্রথম সংবাদদাতারা পুলিশকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল”।
এই যুক্তি এক বিপজ্জনক পূর্বনজির তৈরি করল যা গণহত্যাকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া মানুষ ও সাক্ষীদের এফআইআর নথিবদ্ধ করতেও বাধা দেবে, যদি তারা সেই ঝুঁকি নেয় তো সেজন্য তাদের শাস্তি পেতে হবে। তা ছাড়াও, ভারত সরকার শীর্ষ আদালতে যে বিবৃতি দাখিল করেছে তা পরস্পরবিরোধী দাবি তৈরি করেছে। এতে হিমাংশুকে, এক সংঘর্ষে নিহত মাওবাদীদের মিথ্যাভাবে “নিরাপত্তাবাহিনীর দ্বারা নিহত আদিবাসী মানুষ জন” বলে তুলে ধরার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আবার একই সময়ে তাঁকে, মাওবাদীদের সংঘটিত গণহত্যাকে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা বলে চালানোর চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই হলফনামা কার্যত দাবি করছে যে গোস্পদ গ্রামে এক এনকাউন্টারে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী সশস্ত্র মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। এও বলা হয়েছে যে মাওবাদীরা তাদের আহত কর্মীদের সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ আহত হয়নি। আবেদনকারীরা দাবি করেছে, গণহত্যার শিকার যারা হয়েছেন, তারা সাজানো ভুয়ো “সংঘর্ষে” নিহত নিরস্ত্র গ্রামবাসী। সরকার উল্লিখিত গণহত্যা স্থলে তার বাহিনীর উপস্থিতির কথা স্বীকার করেছে এবং দাবি করেছে গণহত্যার বলি মানুষজন ছিল “সংঘর্ষে” নিহত মাওবাদী। এরপর সুপ্রিম কোর্ট কী করে সরকারের এই পরস্পরবিরোধী অভিযোগ গ্রহণ করতে পারে যে, আবেদনকারীরা মাওবাদীদের দ্বারা “নিরীহ আদিবাসীদের” হত্যাকে আড়াল করার জন্য রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর দোষ চাপানোর ষড়যন্ত্র করেছিল?
যদিও সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে আদিবাসী আবেদনকারী ও তাদের হিমাংশু কুমারের মত শুভানুধ্যায়ীদের গ্রেফতার ও নিগ্রহ করার ব্যাপারে উৎসাহদাতার ভূমিকায় রয়েছে, ছত্তীশগড়ের একটি এনআইএ কোর্ট, ৫ বছর ইউএপিএ-তে আটক থাকার পর ১২১ জন আদিবাসীকে, ২০১৭ সালে বস্তারে কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনীর ২৫ জন কর্মীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাওবাদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। নিরপরাধ আদিবাসী গ্রামবাসীরা তাদের জীবনের পাঁচটি বছর হারিয়ে ফেলেছেন কারা প্রাচীরের অন্তরালে। আর যে পুলিশ ও প্রশাসন তাদের বলির পাঁঠা বানিয়েছিল, তাদের কোনো শাস্তি হবে না, ক্ষমা চাইতেও বলা হবে না, ক্ষতিপূরণের বিষয়টি তো ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না!
সংঘর্ষের এলাকায় আদিবাসীদের গণ কারাভোগ, গণহত্যা ও গণধর্ষণের উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়। কিন্তু তাদের পক্ষে এই হিংস্র ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে আদালতের দরজায় বিচারপ্রার্থী হয়ে পৌঁছানো সম্ভব হত না, যদি না মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা এগিয়ে আসতেন যাঁরা এই কাজে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটা দলিত এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রেও সত্য যাদের অন্যায় গণ কারাভোগ ও পরিকল্পিত গণহত্যার শিকার হতে হয়। তিস্তা শেতলবাদ, যাঁর সহায়তা ও হস্তক্ষেপে গুজরাট দাঙ্গার ৮৮টি মামলায় ১২০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছিল, তিনি নিজেই আজ কারারুদ্ধ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ‘সৌজন্যে’, যে প্রতিষ্ঠান এখন রাজনৈতিক শীর্ষ কর্তাদের ‘হাত’ হয়ে কাজ করছে! সুধা ভরদ্বাজ এবং স্ট্যান স্বামী, দু’জনেই ভীমা কোরেগাঁও মিথ্যা মামলায় ‘অভিযুক্ত’ হয়েছিলেন। এঁরা উভয়েই যথাক্রমে ছত্তীশগড় ও ঝাড়খণ্ডে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল জেলে পচতে থাকা আদিবাসীদের মুক্ত করার উদ্যোগের জন্যই সুপরিচিত।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা কথা প্রসঙ্গে এই সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, “আমাদের অপরাধের বিচার পদ্ধতিতে, প্রক্রিয়াটিই একটি শাস্তি। তড়িঘড়ি নির্বিচারে গ্রেফতার থেকে জামিন পাওয়ার সমস্যা পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াটা বিচারাধীনদের দীর্ঘ কারাবাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিষয়টিতে অবিলম্বে নজর দেওয়া দরকার। “প্রশ্ন উঠছে, কেন ভারতের প্রধান বিচারপতির সহকর্মী বিচারপতিরা একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারকে অপরাধের বিচার পদ্ধতিকে হাতিয়ার করে সেই মানবাধিকার কর্মীদেরই শাস্তি দেওয়ার সুযোগ করে দিলেন একমাত্র যারা এই অপরাধের বিচার পদ্ধতিটার মেরামতি চেয়েছিলেন, যেটা ভেঙে গেছে বলে স্বয়ং ভারতের প্রধান বিচারপতি স্বীকার করে নিয়েছেন? বাথানিটোলা (১৯৯৬) এবং লক্ষ্মণপুর বাথে (১৯৯৭)-র ঘটনার শিকার হয়েছিলেন যেসব নির্যাতিত জাতি ও সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তারা সেই ২০১২ থেকে অপেক্ষা করে আছেন সুপ্রিম কোর্ট কবে তাদের আবেদন শুনবেন! পাটনা হাইকোর্ট ঐ সব ঘটনার সমস্ত অপরাধীকে গণ খালাস দিয়েছিল। সেই রায়কে উল্টে দেওয়ার আবেদন নিয়ে নির্যাতিতরা প্রতীক্ষায় আছেন। সেইসব সাক্ষী আর বেঁচে যাওয়া নিগৃহীতরা যারা আবেদন দাখিল করেছিলেন, তাদের কি আজ ভয় পেতে হবে যে সুপ্রিম কোর্ট শুধু তাদের ন্যায় বিচারকে প্রত্যাখ্যানই করবে না, তাদের শাস্তি দেবে, আর তাদের ও যেসব আন্দোলন তাদের ন্যায় বিচারের খোঁজকে সম্ভব করেছিল সেগুলিকেও ‘অপরাধী’র তকমা দেবে?
এই সরকার-পোষিত বিচার বিভাগীয় অবিচারের মুখে দাঁড়িয়েও মানুষের ন্যায়ের তালাশ বেঁচে থাকবে আর শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে!
এম এল আপডেট সম্পাদকীয়
খণ্ড- ২৫, সংখ্যা-৩০, ১৯-২৫ জুলাই, ২০২২