প্রতিটি নাম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক
history and tradition

যাঁরা ক্রিকেট খেলা ভালবাসেন তাঁরা নিশ্চয়ই ‘নজফগড়ের নবাব’, বীরেন্দ্র সেহবাগ সম্পর্কে অবহিত আছেন। তিনি যখন ব্যাট করতেন তাঁর চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে সচিন তেন্ডুলকারের ধ্রুপদী ব্যাটিংও ম্লান হয়ে যেত। সমস্যা হচ্ছে সেহবাগের ভক্তরা তাঁকে আদর করে আর ঐ নামে ডাকতে পারবেন না কারণ দিল্লীর বিজেপি সভাপতি আদেশ গুপ্ত নিদান দিয়েছেন নজফগড় নামটা পাল্টিয়ে ফেলতে হবে কারণ ওটা দাসত্বের প্রতীক। শুধু নজফগড় নয় দিল্লী সন্নিহিত চল্লিশটি তথাকথিত মোঘল আমলের বা মুসলিম নাম পরিবর্তনের জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে চিঠি লিখেছেন। তাঁর যুক্তি এই নামগুলি পরাধীনতার স্মৃতি বহন করে যা আমাদের আত্মমর্যাদার পরিপন্থী।

মোঘল সম্রাট শাহ আলম (২)-এর সেনাপতি মির্জা নজফ খান রাজধানী দিল্লীর নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য নগরের সীমান্তে একটি গড় বা দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। সেই থেকে জায়গাটির নাম হয়ে যায় নজফগড়। আদেশ গুপ্তর ইতিহাসের জ্ঞান নেহাতই সীমিত। তিনি জানেন না নজফ খান ১৭৬৪ সালে মীরকাশিমের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি দেশদ্রোহী তো ননই, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী! দিল্লী শহরে নজফ খানের নামে জায়গা থাকবে না তো কি আদেশ গুপ্তর পূর্বসুরীদের নামে থাকবে যাঁরা ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন?

নজফগড় ছাড়া চল্লিশটি নামের মধ্যে আছে হৌজ খাস, হুমায়ুনপুর, মাসুদপুর, সাহিবাবাদ, ইউসুফ সরাই, শেখ সরাই ইত্যাদি। ‘হৌজ’ উর্দু শব্দ যার অর্থঝিল, খাস’এর অর্থ রাজকীয় বা শাহি। আগেকার দিনে রাজারাজড়ারা এরকম বড় জলাশয় খনন করতো যাতে ক্লান্ত পথিকদের পানীয় জলের অভাব না হয়। হৌজ খাস সেরকমই একটি ঐতিহাসিক জলাশয়, সেটা নিয়ে এতো আপত্তি কিসের? এটি এখন রাজধানীর একটি আপ-মার্কেট অঞ্চল যেখানে আছে অত্যাধুনিক মল, রেস্তোঁরা, বিভিন্ন দূতাবাস, কিন্তু জায়গাটির মূল আকর্ষণ এখনো এই প্রাচীন ঝিল।

জলাশয়ের মতো যাতায়াত পথে সরাই স্থাপন করা ছিল সেকালের রাজারাজড়া, আমিরওমরাহদের আরেকটি জনহিতকর কাজ। মনে রাখতে হবে আমরা এমন একটা সময়ের কথা বলছি যখন আধুনিক যানবাহনের কোনও অস্তিত্বই ছিলনা। অধিকাংশ মানুষই পদব্রজে সফর করতেন; অভিজাত শ্রেণী পালকি, অশ্ব চালিত শকট বা হাতি, উটের পিঠে চড়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতেন। পরিব্রাজক, ব্যাপারি, তীর্থযাত্রী ও নানা কাজে বিভিন্ন সফরকারি মানুষের কাছে এই সরাইগুলি ছিল মরুভূমিতে মরুদ্যান পাওয়ার মতো। বিভিন্ন বিদেশী পর্যটকরা এই সরাইব্যবস্থা সম্পর্কেতাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে বিস্তারিত লিখে গেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর ভিনিসিয় পর্যটক নিকোলাই মনুচ্চির মতে হিন্দুস্থানের এই সরাই বা মুসাফিরখানাগুলি ইউরোপের পান্থশালাগুলির সমতুল্য। তিনি লিখছেন, ইট, পাথর দিয়ে তৈরি এই সরাইগুলো প্রায় দুর্গের মতো, প্রতিটির প্রবেশদ্বার অত্যন্ত শক্তিশালী, দূর্ভেদ্য। একজন সর্দার এর দায়িত্বে থাকেন। এখানে খালি মুসাফিরদের জায়গা দেওয়া হয় এবং ৮০০-১০০০ লোক অনায়াসে থাকতে পারেন, এছাড়া ঘোড়া, উট, শকট তো আছেই। পুরুষ মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। দোকানপাট আছে যেখানে দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রী পাওয়া যায়, বিলাসদ্রব্যও বিক্রি হয়। বিনোদনের ঢালাও ব্যবস্থা। ঠিক সকাল ছ’টায় ফটক খোলা হয়। তার আগে সর্দার বারবার উচ্চকন্ঠে সবাইকে নিজের জিনিস দেখে নেওয়ার জন্য সতর্ক করেন।

অতীতের এই ঐতিহ্যশালী সরাইগুলি নিয়ে গেরুয়াবাদীদের আপত্তি! এগুলো নাকি দাসত্বের প্রতীক! সরাই শব্দটিতেই এদের গাত্রদাহ হয় কারণ এটি উর্দু শব্দ। এদিকে আদেশ গুপ্ত মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে গোলামী, আজাদী এসব উর্দু শব্দ ব্যবহার করেছেন। উর্দু আদ্যোপান্ত একটি ভারতীয় ভাষা, এঁরা জবরদস্তি এটাকে একটা বিশেষ ধর্মের ভাষা বানিয়ে দিয়েছে এবং আমাদের দেশীয় ভাষাকে পাকিস্তানের হাতে সমর্পণ করেছে। এতো ঐতিহ্যশালী একটা নাম মোঘলসরাই সেটাকে পালটে দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন করে দেওয়া হল। এতো বড় একটা নাম উচ্চারণ করতে ঠোকর খেতে হয়! ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় মোঘলসরাই বিদ্রোহীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল। এই গুপ্ত ঘাঁটিতে তাঁরা গোপনে দেখা করতেন, খবর আদানপ্রদান করতেন। যেসব নারীরা ব্রিটিশদের অধীনে বাধ্যতামূলক দেহ ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা এই সরাইয়ে বিদ্রোহীদের সাথে দেখা করে শত্রুপক্ষের খবর পাচার করতেন। আজকে জায়গার নাম উপাধ্যায়ের নামে করে দিলেই কি এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস মুছে দেওয়া যাবে?

স্থানের নাম পরিবর্তন এখন সংক্রামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওরাঙ্গাবাদের নাম হয়ে গেল শম্ভাজীনগর, ওসমানাবাদ হয়ে গেল ধরাশিব। প্রথমটি দক্ষিণ ভারতে আওরঙ্গজেবের রাজধানী ছিল। হিন্দুত্ববাদীদের রচিত ভারতবর্ষের নয়া ইতিহাসের প্রধান খলনায়ক হচ্ছে আওরঙ্গজেব, যিনি নাকিহিন্দুদের ওপর প্রবল অত্যাচার করেছেন, ধর্মান্তকরণে উৎসাহ দিয়েছেন, বহু মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করেছেন। এটা যদি সত্যি ধরেও নেওয়া যায় তাহলে তো সম্রাট অশোকের নাম সব জায়গা থেকে মুছে দিতে হয়, কারণ কলিঙ্গ যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করে তিনি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের মানুষ তাঁকে ইতিহাসের সর্বোত্তম নৃপতি হিসাবে অধিষ্ঠিত করেছেন। অতীতে আওরঙ্গজেব কী কুকর্ম করেছিলেন সেটার দায়ভাগ তো আজকে মুসলিমদের ওপর বর্তাতে পারে না। ইতিহাসকে প্রতিহিংসার আতস কাঁচে দেখার পরিণাম ভয়ঙ্কর, সমাজকে তা চিরন্তর নৈরাজ্য, হানাহানিতে নিমজ্জিত করতে পারে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর অন্যতম সেরা বই জাহানারা ইমাম লিখিত ‘একাত্তরের দিনগুলি’। সেখানে খানসেনারা কীভাবে ‘ঢাকাকে জাতে ওঠানোর’ জন্য রাস্তার নাম বদলানোর চেষ্টা করেছিলো তার একটা বর্ণনা আছে। আজকের কাগজে লম্বা ফিরিস্তি বেরিয়েছে। লালমোহন পোদ্দার লেন হয়েছে আবদুল করিম গজনভি স্ট্রিট। শাঁখারিবাজার লেন হয়েছে গুলবদন স্ট্রিট, নবীন চাঁদ গোস্বামী রোড হয়েছে বখতিয়ার খিলজি রোড, কালীচরণ সাহা রোড হয়েছে গাজি সালাউদ্দিন রোড, এস কে দাস রোড হয়েছে সিরাজউদ্দিন রোড… খানিক পড়ার পর হয়রান হতে হয়। এত নাম পড়া যায়না।… উঃ! একশো পঞ্চাশটা রাস্তার নাম বদলেছে, তাও শেষে লেখা আছে অসমাপ্ত…। ঘৃণা, বিদ্বেষকারী শাসকদের মধ্যে কী অদ্ভুত মিল! অত্যাচারী শাসক প্রত্যেক দেশেই নিজেদের স্বার্থে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পালটা আক্রমণে খানসেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেখানে লড়াই ছিল বহিরাগত বিজাতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এদিকে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে এখানের সংগ্রাম আরও জটিল ও দুরূহ।

- সোমনাথ গুহ

খণ্ড-29
সংখ্যা-28