কমরেড চারু মজুমদারের রাজনৈতিক জীবনপ্রবাহের সমগ্র সময়কাল থেকে আজকের বিশ্ব ও ভারতীয় পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। কমরেড চারু মজুমদার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে। তারপর পঞ্চাশের দশকের ঊষাকালে মহান তেভাগা আন্দোলনে তাঁর সাহসী প্রত্যয়ী আলোড়নকারী সংগঠকের ভূমিকা, এবং তারপর ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ও তার ভিত্তিতে ভারতের নতুন বিপ্লবী পার্টি সিপিআই (এমএল) গঠনে ও বিপ্লবী সংগ্রামে ঝড়ের গতিতে নেতৃত্ব দেওয়া, তার প্রথম পর্বে ধাক্কা নেমে আাসার পরে গ্রেপ্তার এবং দিনকয়েকের মধ্যে শত্রুর হেফাজতে হত্যার শিকার হওয়া – এই হল অতি সংক্ষেপে কমরেড চারু মজুমদারের রাজনৈতিক কর্মজীবন ও শহীদত্বের রূপরেখা।
আজকের ভারতীয় পরিস্থিতির কোনও পূর্বনজির কখনও ছিল না। আজকের ভারতে শাসনক্ষমতায় কায়েম হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির ও হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ।
কমিউনিস্ট আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এক বিপ্লব সংগঠিত করার স্বপ্ন নিয়ে কমরেড চারু মজুমদার আত্মোৎসর্গ করেছিলেন আজাদী, মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, জনপ্রিয় ভাষায় “জনগণের রাজ” কায়েমের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে। আর, এই মহতী উদ্দেশ্য পূরণের স্বার্থে কমরেড চারু মজুমদার শত্রুশাসকের হেফাজতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর এই জীবনচরিত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে, বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ও দেশপ্রেম বোধের বিষয়ে এক অনন্য নজির হয়ে রয়েছে।
তাঁর আত্মোৎসর্গের অর্ধশতক সময়ান্তরে আজকের এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে কমরেড চারু মজুমদারের বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরা কিছু কালোত্তীর্ণ শিক্ষাকে আসুন, পাথেয় করা যাক।
বুর্জোয়া জাতিয়তাবাদ
“যে প্রশ্ন আজ আমাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল বুর্জোয়া জাতিয়তাবাদ। এই জাতিয়তাবাদ অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং এই সংকীর্ণতাবাদই আজ শাসকশ্রেণীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ... জাতীয় ঐক্য ইত্যাদি আওয়াজ তুলে এরা একচেটিয়া পুঁজির শোষণকে অব্যাহত রাখতে চায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভারতে ঐক্যবোধ জেগেছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের জন্য। ... ... প্রত্যেকটি জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করা মার্কসবাদীদের অবশ্যই কর্তব্য। ভারতের সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র ও বড় পুঁজিপতিদের সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই নতুন ঐক্যের চেতনা আসবে এবং বিপ্লবের স্বার্থেই ভারতবর্ষকে এক রাখার দরকার হবে। সেই ঐক্যই হবে দৃঢ় ঐক্য। এই জাতিসত্ত্বার চেতনা থেকেই হিন্দীভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়েছে দক্ষিণ ভারতে। এবং ৬০জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ‘৬৫ সালেই। সুতরাং এই সংগ্রামের তাৎপর্যকে ছোট করে দেখলে শ্রমিকশ্রেণী ব্যাপক জনতার সংগ্রাম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে। শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থেই এইসব জাতিসত্ত্বার বিকাশের চেষ্টাকে সমর্থন করতে হবে।”
কৃষক আন্দোলন
“কৃষকশ্রেণী বর্তমান বিপ্লবের স্তরে শ্রমিকশ্রেণীর মিত্র এবং এই কৃষকশ্রেণী ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সর্ববৃহৎ শক্তি। এবং এইকথা মনে রেখেই আমাদের কৃষকশ্রেণীর আন্দোলনে এগোতে হবে। কিন্তু কৃষকরা সকলেই এক শ্রেণীতে পড়ে না। ... চারটি শ্রেণী আছে। এবং আছে গ্রামের কারিগর শ্রেণী। অবস্থা অনুযায়ী তাদের চেতনা ও কর্মশক্তির মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে, তাই মার্কসবাদীদের সর্বদাই চেষ্টা করতে হবে সমগ্র কৃষক আন্দোলনের ওপর দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ..... সমগ্র কৃষক আন্দোলনের ওপর দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের নেতৃত্ব যত প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, কৃষক আন্দোলন তত জঙ্গী রূপ নেবে। মনে রাখতে হবে, ব্যাপক কৃষকশ্রেণীর ওপর ভিত্তি করে যে কোনো সংগ্রামী কৌশলই গ্রহণ করা হোক, সেটা কোনোমতেই হঠকারিতা হতে পারে না।..... মনে রাখতে হবে, কৃষকের কোনো মৌলিক দাবির আন্দোলন শান্তিপূর্ণ পথে হবে না।.... কিন্তু একথার অর্থ এই নয় যে আমরা কোনো আইনগত আন্দোলনের সুযোগ নেব না বা আইনের সুবিধা নেব না, বরং কৃষক সমিতির কাজ হবে প্রধানত আইনগত সুবিধা আদায় ও আইনের পরিবর্তনের আন্দোলন চালিয়েই যাওয়া।”
-- ( ৪ নং দলিল : আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান)
“ভারতবর্ষ বিরাট দেশ এবং কৃষক বহু শ্রেণীতে বিভক্ত। কাজেই রাজনৈতিক চেতনার মান সব এলাকার বা সব শ্রেণীর মধ্যে একই স্তরে থাকতে পারে না, তাই আংশিক দাবির ভিত্তিতে কৃষকের গণআন্দোলনের সুযোগ ও সম্ভাবনা সব সময়ে থাকবে এবং কমিউনিস্টদের সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার সব সময়েই করতে হবে।..... আমাদের কৌশলের মূল কথা হল ব্যাপক কৃষকশ্রেণীর জমায়েত হচ্ছে কিনা এবং আমাদের মূল লক্ষ্য হবে কৃষকের শ্রেণীচেতনা বাড়ল কিনা....। আংশিক দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন শ্রেণীসংগ্রামকে তীব্র করে তুলবে। ব্যাপক জনতার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াবে, কৃষক জনতা ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হবে, সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়বে নতুন নতুন এলাকায়। আংশিক দাবির আন্দোলনের ধরন যেকোনো রূপে হতে পারে, কিন্তু কমিউনিস্টরা সবসময় উন্নত ধরনের সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা কৃষক সাধারণের মধ্যে প্রচার করবে।”
(৮ নং দলিল : সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কৃষক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে)
ছাত্র-যুবদের ভূমিকা
“দু’শো বছরের পরাধীন ও শোষিত ভারতবর্ষে ছাত্র ও যুবকরাই হচ্ছে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যাপক জনগণকে অশিক্ষিত ও অন্ধ করে রেখেছে। তাই বিপ্লবী আন্দোলনে এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ছাত্র-যুবরা শুধু শিক্ষিত নয়, তাদের আছে বিরাট উৎসাহ, ত্যাগ স্বীকারের শক্তি এবং যে কোনো অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।..... তাঁরা শিক্ষিত, তাই দেশের অশিক্ষিত মানুষের কাছে চিন্তাধারার শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের সবচেয়ে বেশি।
ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে বাংলার যুব ও ছাত্ররা অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, গ্রামে গ্রামে স্বাধীনতার বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, পুলিশের দমননীতির মোকাবিলা করেছেন, .... সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন। আজকের এই নতুন যুগে ... বাংলার সেই বিপ্লবী ছাত্র যুবকরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেবেন এবং শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে...... রাজনীতি প্রচারের কাজে নামবেন।
(দেশব্রতী, ২১ আগস্ট ১৯৬৯)
প্রকৃত কমিউনিস্ট
শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারাটাই কমিউনিস্ট হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি নয়। কে প্রকৃত কমিউনিস্ট? যিনি জনগণের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারেন। আর এই আত্মত্যাগ কোনো বিনিময়ের প্রত্যাশা করে নয়। দুটো পথ – হয় আত্মত্যাগ, নয় আত্মস্বার্থ। মাঝামাঝি কোন রাস্তা নেই।..... জনগণের সেবা করা ছাড়া জনগণকে ভালোবাসা যায় না। জনগণের সেবা করা যায় একমাত্র আত্মত্যাগ করেই। প্রকৃত কমিউনিস্ট হতে গেলে এই আত্মত্যাগ আয়ত্ব করতে হবে। জনগণের সেবা করা মানে জনগণের স্বার্থে, বিপ্লবের স্বার্থে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা। এর মধ্য দিয়েই জনগণের মধ্যে মিশে যাওয়া ঘটবে।..... এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিপ্লবী রূপান্তরসাধন হয়। তাই বিপ্লব মানে শুধু বৈষয়িক লাভ নয়। বিপ্লব মানে রূপান্তর – উপলব্ধির, আদর্শের, চিন্তাধারার রূপান্তর।.... বিপ্লব মানে চেতনার আমূল রূপান্তর। কী সেই চেতনা? জনগণের সেবা করার চেতনা, আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেতনা, জনগণকে ভালোবাসার চেতনা। বিপ্লব মানেই এই রূপান্তর – কী সমাজের, কী ব্যক্তির।”
(প্রকৃত কমিউনিস্ট হওয়ার তাৎপর্যকি? দেশব্রতী, ১২ মার্চ ১৯৬৯)
শ্রমিক আন্দোলন
যে কোনো স্থানে বা যে কোনো সংগঠনের শ্রমিকদের উপর হামলা হলে তাঁদের সমর্থনে যাতে বিক্ষোভ আন্দোলন বা অন্য ধরণের আন্দোলন সংগঠিত হয়, সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। কোন নেতারা ঐসব শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অথবা আক্রান্ত শ্রমিকরা কোন পার্টির অনুগত – এসব প্রশ্ন অবান্তর।...
শ্রমিকরা যে পার্টির প্রভাবেই থাকুন না কেন, দাসত্বের জ্বালা ও অপমান বোধ তাঁদের মধ্যে থাকেই। কারণ শ্রমিকরা সবকিছু সৃষ্টি করেন নিজ হাতে, আর তাঁর উপর মাতব্বরী করে মালিক ও আমলারা। তাঁর মধ্যে ইজ্জতবোধ যদি জাগিয়ে তোলা যায় বিপ্লবী রাজনীতি প্রচারের মধ্য দিয়ে, তাহলে অর্থনীতিবাদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা তাঁদের পক্ষে সহজ হবে। তাঁরা তখন আগুন হয়ে উঠবেন, দুঃসাহসী হয়ে উঠবেন, মালিকশ্রেণীর ত্রাস হয়ে উঠবেন।”
(শ্রমিকদের মধ্যে পার্টির কাজ, দেশব্রতী, ১২ মার্চ ১৯৭০)
যুক্তমোর্চা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
“আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ব্যাপক মূল জনগণের মধ্যে পার্টি গঠন করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং লড়াইয়ের ভিত্তিতে জনগণের ব্যাপকতম অংশের সাথে যুক্তমোর্চা প্রতিষ্ঠা করা।..... এমনকি যারা এক সময়ে আমাদের প্রতি শত্রুতা করেছে বিশেষ পরিস্থিতিতে তারাও আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে এগিয়ে আসবে। এইসব শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মতো মনের প্রসারতা রাখতে হবে। মনের প্রসারতা কমিউনিস্টদের গুণ। জনগণের স্বার্থই আজ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দাবি জানাচ্ছে। জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ।”
(জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ, ৯ জুন, ১৯৭২)