কলকাতায় লালবাজার লক-আপে কমরেড চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সেই সময় ভারতীয় রাষ্ট্র নিশ্চয় এক পরম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল, ভেবেছিল তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল নকশালবাড়ি থেকে গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়া বিপ্লবী উত্থানের ঢেউ। কিন্তু পাঁচ দশক পর আজ যখন মোদি সরকার সব রকম প্রতিবাদ দমন করতে চায় তখনও তাঁকে প্রতিবাদীদের ওপর নিপীড়ন নামাতে আমদানি করতে হয় ‘আর্বান নকশাল’ শব্দবন্ধ। স্পষ্টতই, মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও, নকশালবাড়ি ও চারু মজুমদার আতঙ্ক এখনও ভারতের শাসকদের তাড়া করে ফেরে।
১৯৬৭ সালের মে মাসে নকশালবাড়ি যখন কৃষক অভ্যুত্থানে ফেটে পড়েছিল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাকে ‘ভারতের বুকে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ বলে বর্ণনা করে স্বাগত জানিয়েছিল। নকশালবাড়ি যে কৃষি বিপ্লবের দিশায় পথ হেঁটেছিল তার অনেকখানিই ছিল চীন বিপ্লবের গতিপথ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণায়। চারু মজুমদার, নকশালবাড়ি এবং দু’বছর বাদে স্থাপিত সিপিআই(এমএল) এইভাবে চীন, চীন বিপ্লব ও মাও সে তুং পরিচালিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে এক বন্ধনীতে চর্চিত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু বহু দিক দিয়ে বহু ভাবে সিপিআই(এমএল) ভারতের সমাজ ও ইতিহাসের মাটির গভীর থেকে গভীরে সাম্যবাদী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়। মার্ক্সবাদের ভারতীয়করণের পথে, মার্ক্সবাদের বিশ্বজনীন বিপ্লবী নীতিমালাকে ভারতের সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিত ও পরিস্থিতিতে প্রয়োগে, নকশালবাড়ি ছিল এক বিশাল অগ্রগামী উল্লম্ফন।
নকশালবাড়ি হঠাৎ একদিন ঘটে যায়নি। সন্দেহাতীতভাবে এর শেকড় ছিল ভারতে কৃষকের জঙ্গী আন্দোলন ও সাম্যবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের গভীরে। চারু মজুমদার ছিলেন ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠকদের অন্যতম। অবিভক্ত বাংলার ৫০ তম শহিদ বার্ষিকীতে কমরেড চারু মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য চারু মজুমদার ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গৌরবময় ধারা নিপীড়িত কৃষক সমাজের জমি ও ফসলের ওপর অধিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল তেভাগা আন্দোলন এবং সে’সময়কার অনেক কমিউনিস্ট নেতাদের মতো চারু মজুমদারকেও জেলে পোরা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর। জেল থেকে বেরনোর পর তিনি উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলাতে তেভাগা আন্দোলনের লাগাম ধরেন। তেভাগার দিনগুলির সময় থেকে জঙ্গী কৃষক আন্দোলনের সাথে এই সুগভীর ও সুদীর্ঘ সংযোগই চারু মজুমদারকে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানকে অনুধাবন করতে ও তাকে এক ব্যাপক ভিত্তিক কৃষি বিপ্লবের পথে পরিচালনা করতে দিশা যুগিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের অভ্যন্তরে চলা মহাবিতর্ক তাঁর কাছে নিছক কোনো একটা পক্ষ নেওয়ার বিষয় ছিল না, বরং তার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণছিল ভারতে নিজের দেশে চলা শ্রেণী সংগ্রামের ময়দানে বৃহত্তর বৈপ্লবিক গতিময়তার রাস্তা খুলে দেওয়া।
ভারতের প্রথম দিককার কমিউনিস্ট নেতাদের অনেকেই এসেছিলেন অভিজাত পৃষ্ঠভমি থেকে। এবং বিদেশে পড়াশোনা করার সময় তাঁরা কমিউনিস্ট মতাদর্শে দিক্ষিত হন। চারু মজুমদার শিক্ষা পেয়েছিলেন ভিন্ন ধারায়। তিনি অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কমিউনিস্ট ধারার সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন এবং কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান ছাত্রসমাজের মধ্যে বিপ্লবী জাগরণের ঢেউ তুললে চারু মজুমদার কালবিলম্ব না করে ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বান রাখেন গ্রামে গিয়ে ভূমিহীন কষকদের সাথে একাত্ম হওয়ার। তিনি আদতে তাঁর নিজের তরুণ বয়সের পথচলাকেই ফিরে দেখছিলেন। তরুণদের প্রতি এই আহ্বান ভগৎ সিংও রেখেছিলেন - ভারতের নিপীড়িত শোষিত জনতার কাছে পৌঁছে যাওয়ার আহ্বান।
নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানে সমগ্র ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সর্বভারতীয় স্তরে সমন্বয় গড়ে তোলার এবং শেষে একটি নতুন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। নতুন পার্টি প্রতিষ্ঠার কাজ চলার সময় পার্টির বিপ্লবী উত্তরাধিকার নিয়ে খুব স্পষ্ট ও জোরালো মত ছিল চারু মজুমদারের। তিনি নতুন পার্টিকে দেখেছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী ধারা হিসেবে যা কেরালার কায়ুর ও পুন্নাপ্রা-ভায়ালার, অন্ধ্রের ঐতিহাসিক তেলাঙ্গানা ও অবিভক্ত বাংলার তেভাগা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নকশালবাড়ি ও সিপিআই(এমএল) ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন পর্যালোচনার এক নতুন গভীরতর ধারারও সূত্রপাত ঘটায় যা আদিবাসী বিদ্রোহগুলির ইতিহাস সামনে নিয়ে আসে, যে বিদ্রোহগুলি বিদেশী শাসন থেকে স্বাধীনতালাভের অদম্য আকাঙ্খা জাগিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতে এক ব্যাপক ও মহান গণজাগরণের সূচনা করেছিল।
নকশালবাড়ির ঝঞ্ঝাপূর্ণ পর্বে এবং তার অব্যবহিত পরে চারু মজুমদার ও নকশালবাড়ি-অনুপ্রাণিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা প্রজন্ম নিজেদের নজর ও উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল মূলত কৃষকের গেরিলা যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে। ফলস্বরূপ নির্বাচন হয়েছিল বয়কট, আর গণ সংগঠনের সমস্ত রূপ ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম চলে গেছিল পেছনের সারিতে। চারু মজুমদারের কাছে এটা ছিল ব্যতিক্রমী এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ জরুরি ভূমিকা নেওয়া, তা কখনই নতুন কোন স্ট্র্যাটেজি ছিল না যা চিরকাল চালিয়ে যেতে হবে। নকশালবাড়ির আগে চারু মজুমদার কখনই গণসংগঠন ও গণ সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকে খারিজ করেননি, এবং তিনি নিজেই শিলিগুড়ি কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থিহিসেবে বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন।
ভারতীয় রাষ্ট্রের চরম সামরিক দমনের মুখে দাঁড়িয়ে এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতের জয়, গরিবী হটাও শ্লোগান, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ও রাজন্য ভাতার অবসান ইত্যাদির মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধির ক্ষমতা দৃঢ়তর হওয়ায় পরিস্থিতিতে যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে তার পরিপ্রেক্ষিতে চারু মজুমদার তাঁর শেষ লেখাগুলিতে ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে পার্টিকে জীবন্ত রাখা, জনগণের স্বার্থকেই পার্টির সর্বোচ্চ স্বার্থ হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, এবং কেন্দ্রে ইন্দিরা সরকার ও রাজ্যে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের স্বৈরতান্ত্রিক হামলার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের বামপন্থী ও লড়াকু শক্তির সাথে ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো – এগুলোই ছিল কমরেডদের প্রতি চারু মজুমদারের সর্বশেষ আহ্বান।
চারু মজুমদারের এই শেষ কথাগুলিই বিপ্লবী কমিউনিস্টদের পুনরায় সংগ্রামের ময়দানে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বিহারের নিপীড়িত গ্রামীণ গরিব জনতার উত্থানের অমিত শক্তি ও অসীম সাহসে ভর করকমরেড চারু মজুমদারের দ্বিতীয় শহীদ বার্ষিকীতে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হয়। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের সমগ্র সঞ্চারপথ ও চারু মজুমদারের রাজনৈতিক যাত্রাপথের শিক্ষা ও প্রেরণা পুনর্গঠিত সিপিআই(এমএল)-কে যে কেবলমাত্র ধাক্কা কাটাতে ও জরুরি অবস্থার দমনপীড়নের দিনগুলি মোকাবিলা করতেই সফল করেছে তা নয়, বরং সুদৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে বহুবিধ গণতান্ত্রিক উদ্যোগ ও সংগ্রাম গড়ে পার্টির বিস্তার ঘটাতে সমর্থ করেছে।
আজ আধুনিক ভারত যখন এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়ানক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তখন চারু মজুমদারের অদম্য প্রেরণা, দিশা ও প্রজ্ঞা ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে এক নতুন তাৎপর্য পায়। গণতন্ত্রকে নিলম্বিত ও দমিয়ে রাখাটা জরুরি অবস্থার সাথে যুক্ত ছিল, আজ তা এমন সর্বব্যাপ্ত ও স্থায়ী চেহারা নিয়েছে যে প্রথাগতভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা আর দরকার পড়ছে না। আধিপত্যকারী সংবাদ মাধ্যমকে আপাদমস্তক এমন নাটকীয়ভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে যে আজ সেন্সরশীপ চালানোও অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। আজকের এক্সেকিউটিভ কার্যত সাধারণতন্ত্রের অন্য তিনটি স্তম্ভকে নিয়ন্ত্রণ করছে – বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও মিডিয়া, এবং যেটুকু যুক্তরাষ্ট্রীয় সাম্য আমাদের ছিল তা এক্সেকিউটিভের চারপাশে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সম্পূর্ণ অস্থির করে তুলেছে।
এই সীমাহীন কেন্দ্রীকতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সাথে আসছে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ঘৃণা ও মিথ্যার ব্যাপক বিস্তার। ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বুনট এরকম আক্রমণের শিকার দেশভাগের বিভীষিকার পর কখনও হয়নি। এবং এই বিষাক্ত ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের সাথে হাত ধরাধরি করে আছে দেশের সমস্ত সম্পদ ও পরিকাঠামো ও মানবসম্পদের নিরন্তর কর্পোরেট লুট। দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার পরবর্তী ৭৫ বছরের সাংবিধানিক সাধারণতন্ত্রের অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে ভারতের জনগণ যা যা অধিকার অর্জন ও নির্মাণ করেছিল তার সবকিছুই আজ বিপন্ন। কমরেড চারু মজুমদারের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও একবার আমাদের সঞ্চিত ঐতিহাসিক সম্পদের গভীরে অনুসন্ধান চালাতে হবে এবং বিপ্লবী উদ্যোগ ও জনতার কল্পনার দ্বার খুলে দিতে হবে ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনাকে প্রতিহত করে গণতান্ত্রিক পুনর্ভ্যুদয়ের এক নবযুগ আনতে।
এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৬ জুলাই - ১ আগস্ট
(চারু মজুমদারের মুখাবয়বটি এঁকেছেন রাঁচির কমরেড বাসির আহমেদ। তাঁর মৃত্যুর মাত্র দশ দিন আগে স্কেচটি করেন তিনি)