অপপুষ্টি -মানে অপুষ্টি, অতিপুষ্টি, অসমপুষ্টি।
কিছুউন্নয়নশীল দেশে অপুষ্টির মতো অতিপুষ্টিও দেখা দিতে শুরু করেছে। পৃথিবীতে অন্তত তিনজনের মধ্যে একজন অপপুষ্টির শিকার। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যে প্রোটিন ভিটামিন বা খনিজ পদার্থের ঘাটতি, অতিরিক্ত ওজন, স্থূলতা, বা খাদ্য-সম্পর্কিত অসংক্রামক রোগ। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অপুষ্টিজনিত রোগ বেশি দেখা যায়। অপুষ্টি সম্পর্কিত গবেষণায় জনসংখ্যাকে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, কিশোর, গর্ভবতী মহিলা, প্রাপ্তবয়স্ক এবং বয়স্ক মানুষসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার
২০২০ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৪৯ মিলিয়ন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশর মধ্যে, ৪৫ মিলিয়ন শিশুর ওজন এবং উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম ছিল; প্রায় ৩৮.৯ মিলিয়ন শিশু স্থূলতা বা অতিপুষ্টির শিকার হয়। ২০২১-এ প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু-মৃত্যুর কারণ ছিল অপুষ্টি। ভিটামিন এ-এর অভাবে সারা বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এক তৃতীয়াংশ অন্ধত্বের শিকার হয়। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত, প্রায় ১.৯ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্কের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ছিল এবং ৪৬২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্কের ওজন ছিল কম। গত এক দশকে বিশ্বে অপুষ্টির পরিমান বেড়েছে। ২০১৫ সালে, প্রায় ৭৯৫ মিলিয়ন মানুষ (পৃথিবীতে প্রতি দশজনের মধ্যে একজন) অপুষ্টিতে ভুগছিল। ২০২০ সালে সেখানে ৮২০ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টির শিকার, অর্থাৎ বিশ্বের নয়জনের মধ্যে একজন। এই বৃদ্ধি চলমান কোভিড- ১৯ অতিমারির সঙ্গে আংশিকভাবে সম্পর্কিত। এছাড়াও, ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্রমাগত খরা, কোভিড১৯-এর চলমান অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্বব্যাপী শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর বিশাল ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।
ভারত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মাত্রা অর্জন করলেও বিশ্বের সর্বাধিক অপুষ্টিরুগ্ন শিশু ভারতেই রয়েছে । অপুষ্টি কারণে দেহের উচ্চতা ও ওজন দুটিই কমতে থাকে। এটি দীর্ঘস্থায়ী শৈশবকালীন এমন একটি রোগ, যা অপুষ্টির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ এবং এর ফলে শিশুদের শারীরিক তো বটেই মানসিক দিক থেকে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এই রোগ স্টান্টিং নামে পরিচিত। এন.এফ.এইচ. এস- এর (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে) গবেষণা থেকে জানা যায় যে, (বিশ্বব্যাপী প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) বহু ভারতীয় শিশু এই স্টান্টিং রোগের শিকার। শিশু-অপুষ্টি মোকাবিলায় একটি বহুমুখী উদ্যোগের প্রয়োজন, উদাহরণস্বরূপ খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ এবং গুণমান উন্নত করা, স্যানিটেশনের মাত্রা বৃদ্ধি, মাতৃস্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি। একইভাবে, পরবর্তী সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিবর্তনটি হলো মায়েদের। শিশুদের মধ্যে বিশেষত মেয়েদের বেশি পুষ্টির প্রয়োজন, কারণ শৈশবে স্টান্টিং-এ আক্রান্ত মায়েদের রক্তাল্পতা ও স্বল্পোন্নত জরায়ুর কারণে তারা পরবর্তীতে স্টান্টিং-আক্রান্ত শিশুদের জন্ম দেয়।
ভারতে অপুষ্টির একটি প্রধান কারণ হল অর্থনৈতিক বৈষম্য। দারিদ্র্যের কারণে, তাদের খাদ্যে প্রায়শই গুণমান এবং পরিমাণ উভয়েরই অভাব থাকে। যেসব মহিলা অপুষ্টিতে ভোগেন তাদের সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা কম। পুষ্টির ঘাটতি ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়েরই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফ.এ.ও) মহাঅধিকর্তা কু ডংইউ- এর মতে, “(২০২০ সাল পর্যন্ত) অর্থনৈতিক প্রভাব ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০৭ কোটি মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী সুষম আহার পায়নি।” ভারত, বিশ্বের দ্বিতীয় জনসংখ্যার দেশ, বিশ্ব- জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এফএও-এর মতে, ভারতে পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য প্রতিমাসে জনপ্রতি প্রায় ১৯০০ টাকার প্রয়োজন। অর্থাৎ একটি চার সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৭,৬০০ টাকা খাদ্য খরচ। ৭০.৫ শতাংশ ভারতীয় পুষ্টিকর খাবারের খরচ যোগাতে অক্ষম, যেখানে শ্রীলঙ্কায় ৪৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮৩.৫ শতাংশ এবং নেপালে ৮৪ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর ও সুষম আহার গ্রহণে অক্ষম। এফএও-র মতে, কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের কৃষি,খাদ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা এবং আমাদের সমাজে বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে, যা বিশ্বকে ক্ষুধা ও মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার দিকে পরিচালিত করেছে। ২০২২ সালের প্রথমার্ধে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করেছে এবং শস্য, সার ও জ্বালানির দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এর ফলে খাদ্যের দাম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও জলবায়ুর চরম অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরিবেশের শান্তি শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করেছে। প্রায় ৮০ কোটি বা প্রায় ৬০ শতাংশ ভারতীয়, সরকারি ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য রেশনের উপর নির্ভরশীল। তারা ২- ৩ টাকা কেজি দরে প্রতি মাসে মাত্র পাঁচ কেজি গম ও চাল পান, বিশেষত অতিমারির সময় থেকে। কিন্তু এই কর্মসূচিটি প্রায়ই সমালোচিত হয়। কারণ, পর্যাপ্ত ক্যালোরি সরবরাহ করার অর্থ কিন্তু পর্যাপ্ত পুষ্টি নয়।
ভারতে ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগজনক ছবি ‘স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (এসওএফআই) -এর সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে, যা ৬ জুলাই যৌথভাবে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টে বলা হয় যে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ৫৬ কোটি ভারতীয় (যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০.৬ শতাংশ) মাঝারি বা গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। ২০১৮-২০ সালে যারা চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, ২০১৯-২১ সালে তার সংখ্যা ২০.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.৩ শতাংশ হয়েছে। এছাড়াও এই বছরের শুরুর দিকে ওয়ার্ল্ড ওবেসিটি ফেডারেশনও জানিয়েছে যে ভারতে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২৭ মিলিয়নেরও বেশি শিশু স্থূলতায় ভুগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর খাবারের সামর্থ্যের উপর একটি তুলনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ৯৭ কোটিরও বেশি ভারতীয়, বা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭১ শতাংশ পুষ্টিকর খাবারের সামর্থ্য রাখতে অক্ষম।
একটি গবেষণায়, অনুপ্রিয়া সাক্সেনা এবং তাঁর সহকর্মীদের পর্যবেক্ষণ – রাজস্থানের একটি আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের ২১১ জনের দুই-তৃতীয়াংশ তাদের পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমান খাবার না থাকার কথা উল্লেখ করেছে। তাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের কাছে খাবার কেনার মতো টাকা নেই।
ভারতের শিশুরা অপুষ্টি এবং অতিপুষ্টি দুয়েরই শিকার। তাই মনে রাখতে হবে শুধু ক্যালোরি নয় শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক সকলকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম আহার এবং নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
- অবন্তী