নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, এবছরের শেষ নাগাদ হবে বলে প্রত্যাশা। কিন্তু তার আগেই নির্মীয়মাণ ভবনের ছাদে বসে গেল নতুন জাতীয় প্রতীক, যার উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করলেন গত ১১ জুলাই। এটাই ‘নতুন’ ভারতের দস্তুর — এই ভারতের আকাঙ্খিত রূপ কেমন হবে, তাকে বিজ্ঞাপিত করতে সম্ভাব্য সমস্ত মাধ্যমের ব্যবহারেই মোদী জমানা উন্মুখ। সেই রূপের প্রকাশ নিয়েই বাধল তীব্র গোল। সারনাথের মাটি খুঁড়ে পাওয়া সিংহ মূর্তি-সহ অশোক স্তম্ভের যে শীর্ষকে জাতীয় প্রতীক করা হয়েছিল, নতুন প্রতীকের সিংহগুলো সারনাথের সিংহগুলো থেকে রূপে বেশ কিছুটা ভিন্ন হয়ে যেন চলতি জমানারই দ্যোতক হয়ে উঠল।
জাতীয় প্রতীকে রয়েছে চারটে সিংহ — ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে ও তার বিপরীতে মুখ করা। সিংহর সঙ্গে হাতি, ঘোড়া ও অন্য কিছু জন্তুও প্রতীকের অঙ্গ। মূল যে জাতীয় প্রতীককে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি গ্ৰহণ করা হয়েছিল, সেই প্রতীকের সিংহগুলো রাষ্ট্রের একটা ভাবমূর্তিকে মূর্ত করত। পশুরাজের রাজসিকতার সঙ্গে শৌর্য, প্রশান্তি ও মহিমাও সেই মূর্তিগুলোতে ধরা পড়ত। মূর্তিগুলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও শান্তিকামিতাকেও প্রতিফলিত করত। কিন্তু নতুন প্রতীকের সিংহগুলোর বুক ফুলে রয়েছে (ছাতি হয়ত ৫৬ ইঞ্চি বা তার বেশি), পায়ের স্ফীত পেশি তাদের প্রতাপ জাহির করছে, মুখের হাঁ অনেক বড় হয়ে রাগে গর্জনরত ভঙ্গিকে প্রকট করছে, আর মুখগহ্বরের ধারালো দাঁতগুলো সৃষ্টি করছে আতঙ্কের এক বাতাবরণ, বুঝিবা শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত। জাতীয় প্রতীককে তেমন বড় আকারে নির্মাণ করার কথা স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়ার দিককার শাসকরা ভাবতে পারেননি, আর তাই লম্বায় তা ছিল ১.৬ মিটার। চলতি জমানার ধরন-ধারণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন প্রতীকের উচ্চতা করা হয়েছে প্রথম প্রতীকের চার গুণেরও বেশি, একেবারে ৬.৫ মিটার। ফলে ব্রোঞ্জের তৈরি প্রতীকের ওজন বেড়েছে অনেক — প্রতীককে ধরে রাখার সাড়ে-ছয় টনের ইস্পাতের কাঠামো সহ প্রতীকের ওজন দাঁড়িয়েছে একেবারে ১৬ টন। এই বিশাল আয়তন ও ওজনের করতে গিয়ে খরচও বেড়েছে অনেক, প্রাথমিক আনুমানিক ব্যয় ৯৭৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে পৌঁছেছে ১,২৫০ কোটিতে। তবে মূল প্রতীক থেকে নতুন প্রতীকের বিচ্যুতি আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট প্রকট হলেও মোদী সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন যে, নতুন প্রতীকে কোনো বিকৃতি সাধন করা হয়নি, তা মূল প্রতীকেরই ‘অবিকল প্রতিরূপ’। এই অস্বীকৃতির ভিত্তি কতটা যথার্থ এবং তা জাহির করা হচ্ছেটাই বা কেন? মূল প্রতীক এবং নতুন প্রতীককে পাশাপাশি রেখে অনেক ছবিই সামনে এসেছে, এবং মূল প্রতীকের সিংহগুলোর পাশে নতুন প্রতীকের সিংহগুলো অনেক হিংস্র রূপেই প্রতিভাত হচ্ছে। কাজেই নতুন প্রতীকের উদ্ভাবকদের পরিকল্পনায় মূল প্রতীক থেকে সরে আসার অভিপ্রায় যে ছিল, মোদী মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের হাজারো অস্বীকৃতিও তাকে আড়াল করতে পারবেনা। এখন প্রশ্ন হল, নতুন প্রতীকে সিংহদের হিংস্র রূপে রূপান্তরণ কি মোদী সরকারের পরামর্শেই হয়েছিল? যাঁরা প্রতীকের নকশা বানিয়েছেন ও তার নির্মাণ করেছেন, এতটা পরিবর্তআন সাধনের স্বাধিকার ভোগ করা সেই কলাকুশলীদের পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না।
ইতিহাসবিদ, নৃতত্ত্ববিদ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন — নতুন প্রতীকের সিংহগুলো আসলে বর্তমান শাসক জমানার বৈশিষ্ট্যেরই প্রতিনিধি। নরেন্দ্র মোদী জমানা ২০১৪ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা সমাজে বিপুল বিস্তার লাভ করেছে। অন্যদিকে, সরকারের বিরোধীদের জেলে পোরা এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতাকে নির্মূল করে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার মধ্যে ত্রাসসঞ্চারী প্রশাসনিক রীতিরও উন্মেষ ঘটানো হয়েছে। এই জমানার হাতে নির্মিত জাতীয় প্রতীকের সিংহ তাই সংযম ও শান্তির দ্যোতক হতে পারেনা, তার প্রকাশ ঘটছে এই জমানার ভাবভঙ্গিতেই। মনস্তত্ববিদ আশীষ নন্দী যথার্থই বলেছেন, “এই সিংহগুলো শুধুমাত্র সিংহ নয়। নরখাদকও বটে। এ এক দ্বিতীয় ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ও বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃত প্রতীক। আমি আমাদের বর্তমান শাসকদের অভিনন্দন জানাই এত উদার মানসিকতার জন্য, এতখানি স্বীকারোক্তি করার জন্য।” নতুন প্রতীকের সিংহগুলোর মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি নিয়ে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংসদরা মূল প্রতীক থেকে বিচ্যুতির জন্য সরকারের সমালোচনা করেছেন, অনৈতিক বলেছেন। এই সমালোচনাকে খণ্ডন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী বলেছেন, কোনো মূর্তির মধ্যে সৌন্দর্য আছে কিনা তা নির্ধারণ করবে যিনি মূর্তিদেখছেন তাঁর চোখ। এইভাবে মূর্তির মুখ শান্ত না ক্রোধান্বিত, তাও ধরা পড়বে নির্দিষ্ট দর্শকের দেখার ঢঙেই। অর্থাৎ, নতুন প্রতীকে বিকৃতি খুঁজে পেলে দোষ তাঁরই, যিনি মূর্তিদেখছেন। কথায় বলে না, যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা! বিজেপিও প্রতীক নিয়ে যাবতীয় সমালোচনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণের বিরোধীদের ‘ষড়যন্ত্র’ই দেখতে পাচ্ছে। তবে, নতুন প্রতীক নিয়ে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের সমালোচনার জবাবে মোক্ষম মন্তব্যটা করেছেন ‘কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী। নতুন প্রতীকের সমালোচনায় প্রশান্ত ভূষণ বলেছিলেন — এই নতুন জাতীয় প্রতীক গান্ধী থেকে গডসেতে ক্রমবিকাশেরই পরিণাম। “দংষ্ট্রা বার করা রাগী সিংহ; এটা হল মোদীর নতুন ভারত”। এর জবাবে বিবেক অগ্নিহোত্রী বললেন, “শহুরে নকশালরা একটা দন্তহীন মূক সিংহকেই চায় যাতে তারা সেটাকে পোষ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।” একেবারে যথার্থ বলেছেন অগ্নিহোত্রী মহাশয়, সিংহপুরুষ রাষ্ট্র নায়ককে দোর্দণ্ড প্রতাপেরই অধিকারী হতে হবে, বিরোধী ও দেশদ্রোহী নিষ্পেষণে যিনি হবেন ষোলো আনা নির্মম! সারনাথের সিংহ ছিল ‘ওদের’, সেটা ‘আমাদের’ হতে পারে না। সারনাথ ছিল উত্তরপ্রদেশের বেনারস জেলায়। সেই রাজ্যেই এখন উদ্ভব ঘটেছে এক তেজস্বী সিংহের, যাঁর আগ্ৰাসী বুলডোজারের গুঁতোয় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি। নতুন প্রতীকের সিংহকে এরকমই হতে হবে। কিংবা হতে হবে গির অরণ্যের সিংহদের মতো, গুজরাটের যে অরণ্যের সিংহদের আগ্ৰাসী ধরন-ধারণ নিরীক্ষণ করে শাসনের কেতা রপ্ত করেছেন দেশের প্রশাসনিক প্রধান!
- জয়দীপ মিত্র