ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল নেত্রী অনেকবারই বলেছিলেন বাংলার যুবকদের কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্যে বা বাইরে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে, তিনি ক্ষমতাসীন হলে কাউকেই আর বাইরে যেতে হবে না, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাজের ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই হবে। ক্ষমতায় আসার পর ৯ বছর হতে চলল। গত বছর তাঁদের একজন মন্ত্রী বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা এত বেশি উন্নয়ন করেছেন যে গ্রামের মানুষের আর কাজের দরকার নেই, মানুষ কাজ চাইছেন না, তাই পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজ কম হচ্ছে। তার মানে তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা মনে করতেন বা দেখাতে চাইতেন যে পশ্চিমবঙ্গের গরিব মেহনতিদের পরিবারের যুবকদের আর বাইরে কাজের সন্ধানে যেতে হয় না। সে কারণেই হয়তো লকডাউন ঘোষণার সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা মাথাতেই আসেনি।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানের মনতুষ্টি করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দিল্লী থেকে গুজরাট পর্যন্ত ‘গরিব-হীন ভারতবর্ষ’ দেখানোর কাজে বিভোর ছিলেন, এবং তার ঘোর কাটার পর যখন দেখা গেল করোনায় দেশকে ঘিরে নিয়েছে তখন তড়িঘড়ি জনতা-কার্ফু নাম দিয়ে রেল বিমান যানবাহন অফিস বাজার সব বন্ধ করে দিলেন। পরের দিন রাত, ২৩ মার্চ আটটার সময় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আবেগকম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন রাত ১২টার পর থেকেই সারা দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন। মাত্র ২১ দিন দেশবাসীর কাছে সময় চাইলেন। বললেন সবাই ঘরে থাকুন তাহলেই দেশ জয়ী হবে। কিন্ত যাদের ঘর নেই তারা কোথায় থাকবেন সে কথা বললেন না। বললেন না দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দিনমজুর ও মেহনতিদের কিভাবে জীবন-জীবিকার সমাধান হবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা ভাবতেই পারলেন না। লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ মেহনতিরা অর্ধাহার অনাহার ও থাকার জায়গার অভাবে বাধ্য হয়ে লকডাউন ও পুলিশের অত্যাচার অগ্রাহ্য করেই হাজার হাজার মাইল হাঁটার ঝুঁকিপূর্ণ পথে নিজেদের ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রাস্তায় না খেতে পেয়ে, দুর্ঘটনায়, ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে এবং অসুস্থ হয়ে শয়ে শয়ে আহত ও নিহত হতে লাগলেন। রক্তে রঞ্জিত হল রাজপথ রেলপথ। বিশ্বের সোস্যাল মিডিয়া, সংবাদ জগতে, মানবাধিকারের প্রশ্ন উঠল, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিষয় হয়ে উঠল। তখনই কেবল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বোধ উদয় হল। স্বীকার করলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের অস্তিত্ব। এবং অতঃপর শুরু হল ঘরে ফেরানো নিয়ে টালবাহানা। যারা বছরের পর বছর ধরে ‘চালু ডিব্বা’র যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে যান কাজের সন্ধানে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মজুর হওয়ার জন্য; অত্যাচার, বঞ্চনার, প্রতারণার স্বীকার হচ্ছেন যারা প্রতিনিয়তই। কিন্তু কেন শ্রমিক পরিযায়ী! কেন কেরল-কর্ণাটক-তামিলনাডু-গুজরাট-মহারাষ্ট্র সহ কিছু রাজ্যের মজুরি পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-ওড়িষ্যা-ঝাড়খন্ড সহ কিছু রাজ্যের থেকে ২\৩ গুন বেশি? শাসক শ্রেণীগুলির বৈষম্যমূলক নীতির ফলই হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক তৈরির উৎস। গ্রামীণ ভারতের প্রতি বৈষম্য, শ্রেণীগত বৈষম্য, জাতিগত বর্ণগত, সম্প্রদায়গত, ধর্মগত ও এলাকাগত বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক।
লকডাউনের সময় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কর্মীরা বিভিন্ন রাজ্যে যোগাযোগ রেখেছেন, সহযোগিতা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তার প্রভাব বিভিন্ন রাজ্যে যেমন আছে তেমনই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে। অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যেই এই স্তরের উত্থান। এদের সংগঠিত করা আজকে সময়ের দাবি। কেন্দ্রীয় সরকার অনেক বড় বড় প্যাকেজের কথা বললেও তিনমাস ৫ কেজি চাল ও ১ কেজি ডাল ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। গরিব কল্যাণ যোজনার ১২৫ দিন কাজ দেওয়ার কথা বললেও সব রাজ্য বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কোনো জেলাকেই যুক্ত না করে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ঘরে ফেরার পর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের গরিব মেহনতিদের মতো পরিযায়ী শ্রমিকদেরও চরম সংকট চলছে। কাজ নেই, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভ বেড়ে চলেছে। বর্ধমান সদর-১, পুর্বস্থলী-২ ও মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা-২ ব্লকে গত সপ্তাহে উৎসাহব্যাঞ্জক বৈঠক হয়েছে। মুকশিমপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাররপাড়া গ্রামে জবকার্ডের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন। বিডিও সাহেব ১৫ দিনের সময় নিলেও তৃণমূলের নেতারা নিজেদের গোষ্ঠীকোন্দল নিয়েই ব্যস্ত আছেন। কাজ দিচ্ছেন না, আবেদন নিচ্ছেন না। ডেপুটেশন নিতেও রাজি হচ্ছেন না। নাদনঘাট পঞ্চায়েতের ইসলামপুর গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকেরা অনেক লড়াইয়ের পর কাজ পেলেন। মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকরাও আন্দোলন চালিয়ে কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
-- সজল পাল