সদ্য প্রকাশিত হয়েছে “জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০”। এখানে বিদ্যালয় শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে আগামী পথচলার নীতিমালা রয়েছে। এই লেখাটিতে আমরা কেবল বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষাকাঠামো ও নীতি নিয়ে কী বলা হয়েছে তা কিছু দিক উল্লেখ করব এবং প্রাথমিক কিছু পর্যবেক্ষণই কেবল সূত্রাকারে রাখব।
• গোড়াপত্তন - প্রাক বিদ্যালয় বা প্লে স্কুলের ৩ বছর, প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণির ২ বছর মিলে মোট ৫ বছর এই স্তরের জন্য রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে তিন থেকে আট বছর বয়সের বাচ্চারা এই পর্বে খেলাধূলা ও বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে কিছু কিছু জিনিস শিখবে। মাতৃভাষা শেখা এই পর্বের মূল লক্ষ্য।
• প্রস্তুতি পর্ব - তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণি নিয়ে তিন বছরের এই স্তর। বলা হয়েছে আট থেকে এগারো বছর বয়েসের ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা, ক্রিয়াকলাপ, পারস্পরিক আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে এই পর্বে শিখবে। ভাষাজ্ঞান এবং গণনা – মানে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ শেখা এই পর্বের মূল লক্ষ্য। আগের পর্ব আর এই পর্বে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কেবল মাতৃভাষা ও স্থানীয় ভাষাকে অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে। রয়েছে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে মূল্যায়নের কথাও। বোর্ড পরীক্ষার আগে আর একটি মূল্যায়নের কথা রয়েছে অষ্টম শ্রেণিতে।
প্রশ্ন হল মাতৃভাষার সাথে আর একটি ভাষা হিসেবে ইংরাজি – দু্টি ভাষাই কি এই স্তরে যথেষ্ট ছিল না? তৃতীয় ভাষার সূত্রে কি হিন্দিকে ঘুরিয়ে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে? আর হিন্দিভাষী এলাকায় সংস্কৃত? মনে রাখতে হবে বর্তমানে ক্লাস সেভেন-এইটে তিন ভাষা পড়ানোর চল আছে। সেটাকে ক্লাস থ্রি, ফোর, ফাইভে নিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? তা চাপ কতটা বাড়াবে শিশুদের? প্রথম আর দ্বিতীয় ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে কি? এই স্তরে ত্রিভাষা নীতি প্রণয়নের প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক ওঠা দরকার ও এর পুনর্বিবেচনা জরুরি।
• মধ্যবর্তী স্তর – ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণি নিয়ে তিন বছরের এই স্তর। এই স্তরটিকে একসময়ে সিনিয়ার বেসিক, আপার প্রাইমারি, জুনিয়ার হাই ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হত। বলা হয়েছে এগারো থেকে চোদ্দ বছরের ছেলেমেয়েরা এই পর্বে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, গণিত, কলা ইত্যাদি শিখবে। মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে বোধের বিকাশের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে।
এই স্তরের শুরু থেকে কম্পিউটার কোড শেখার কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি খেলাধূলা, সঙ্গীত ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কলাচর্চাকেও বিষয় হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছে।
এই স্তর থেকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষাকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয় নি। যা আগের দুই স্তরে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ক্লাস সিক্স থেকে বেসরকারী ইংরাজী মাধ্যম স্কুলের রমরমার পথ খুলে রাখা হল। আগের দুই স্তরে মাতৃভাষা ও স্থানীয় ভাষায় শিক্ষাদানের যে নির্দেশিকা ছিল, সেখান থেকে এই পশ্চাদপসরণ দুর্ভাগ্যজনক। সরাসরি না বলা হলেও আশঙ্কা হয় এর আগে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বুনিয়াদী শিক্ষার যে কথা বলা হয়েছিল, তা পঞ্চম শ্রেণিতে এসেই শেষ করে দেওয়ার নকশা তৈরি করা হচ্ছে।
• মাধ্যমিক স্তর – নবম দশম শ্রেণির বর্তমান মাধ্যমিক স্তর এবং একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক স্তরকে মিশিয়ে চার বছরের এই নতুন মাধ্যমিক স্তর চালু করার কথা বলা হয়েছে। একাদশ শ্রেণিতে বিষয় বেছে নেবার বর্তমান ব্যবস্থাটি চালু করে দেওয়া হচ্ছে নবম শ্রেণিতেই। বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগের বিভাজন তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের বিষয় মিলিয়ে মিশিয়ে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তিগত বিষয় বেছে নেবার সুযোগও এর মধ্যে থাকছে। এই স্তরের শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে বিশ্লেষণী চিন্তার বিকাশের কথা বলা হয়েছে।
বোর্ড স্তরের পরীক্ষাকে সহজ করার কথা বলা হয়েছে। সাধারণ দক্ষতাকে কেবল যাচাই করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বোর্ডগুলির আমূল পুনর্বিন্যাসের কথাও এসেছে। তবে তার সঠিক রূপরেখা এখনো অস্পষ্ট।
সদ্য প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে সামান্য কিছু প্রাথমিক পর্যবেক্ষণই কেবল এখানে রইলো। আগামী দিনে এই নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনায় প্রবেশ করা যাবে।
- সৌভিক ঘোষাল