কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দাবি, বাকি বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় এদেশে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম, ভারত দেখিয়ে দিচ্ছে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়া কাকে বলে! পশ্চিমবাংলার টিএমসি সরকারও দাবি করছে, বাংলা বাকি ভারতকে দেখিয়ে দিচ্ছে কোভিডের মোকাবিলায় কিভাবে সফল হওয়া যায়! নিজের ঢাক নিজে পেটানোর বিরাম নেই। কিন্তু প্রকৃত কঠিন বাস্তবতা হল, তথ্য পরিসংখ্যানের ধারা বুঝিয়ে দিচ্ছে কী সারা ভারতে, কী বাংলায় কোভিড১৯-র মোকাবিলার হাল প্রায় শোচনীয় জায়গাতেই থাকছে। লকডাউন ক্রমাগত বাড়িয়ে চললেও তা সংক্রমণ প্রবণতাকে ছিন্ন করতে পারেনি। পরন্তু কোথাও কোথাও সরকারীভাবে স্বীকার করা হচ্ছে গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। সুস্থতার হার বাড়লেও, মৃত্যুহারও বাড়ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে, হাসপাতালে চিকিৎসা এবং সেল্ফ বা হোম কোয়ারান্টিন নিরাময় ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। ইতিমধ্যে সবচেয়ে তীব্র ও ব্যাপক মাত্রায় সংক্রমণ বাড়ছে মনে করে রোগ পরীক্ষার সর্বাধুনিক যন্ত্র বসানো হয়েছে মুম্বাই, নয়ডা ও কলকাতায়। ভারত এখন সংক্রমণের নিরীখে বিশ্বে শীর্ষস্থানে থাকা দেশগুলিকে আজ ছুঁয়ে ফেলছে তো কাল ছাপিয়ে যাচ্ছে। বাংলার হাল বিচার করলে ভারতের হাল কী দাঁড়িয়েছে তারও আন্দাজ মিলবে।
এরাজ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার এককথায় কোনও তালমিল থাকছে না। ফ্রন্টলাইনে থাকা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিশ্চয় যোদ্ধার মতো লড়ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও, মারাও যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যর্থতা-অপদার্থতার সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়েছে স্বাস্থ্য প্রশাসনের। একেবারে রাজ্যস্তর থেকে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল স্তর পর্যন্ত স্বাস্থ্য প্রশাসনের ভূমিকা আশা ভরসা তৈরির বদলে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে অনাস্থা-ক্ষোভ-অসন্তোষ। রাজ্যের গোটা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভঙ্গুর, অমানবিক, ও অসততার চেহারা প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে প্রকটভাবে। ওয়েবসাইটে প্রচারিত তথ্য সংবাদের সাথে বাস্তবে সঙ্গতি মিলছে না। সরকারী-বেসরকারী উভয় হাসপাতালের ক্ষেত্রেই বেঘোরে ঘুরে হয়রান হতে হচ্ছে। বিনা চিকিৎসায়ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। রাজ্য সরকারের গঠন করা টাস্ক ফোর্স ও গ্লোবাল অ্যাডভাইজারি ব্যবস্থার তেমন কার্যকারিতা ফলপ্রসূ হচ্ছে কোথায়? সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল বেড ব্যবস্থার ৮০ শতাংশই রয়েছে বেসরকারী ক্ষেত্রে, ভেন্টিলেশন সংস্থানের বিন্যাসও প্রায় সেরকম। অথচ করোনা যুদ্ধকালীন সময়ে কোভিড বেডের সংখ্যা সরকারী হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারী হাসপাতালে এক-পঞ্চমাংশ কম হয়ে থাকতে পারছে কেন? তার ওপর বেসরকারী ল্যাব থেকে হাসপাতাল সবেতেই চলছে পরীক্ষা গাফিলতি, প্রতারণা, ভুল রিপোর্ট, বিশাল আর্থিক প্যাকেজ চাপানো ও তা আদায় করতে হুমকি দেওয়া, স্বাস্থ্য বিমা ব্যবসায়ী সংস্থা ও হাসপাতাল ব্যবসায়ীর যোগসাজশে মেডিক্লেম গ্রাহ্য না করার ঘটনা ঘটছে।
সরকারী স্বাস্থ্য প্রশাসন বলছে অভিযোগ থাকলে স্বাস্থ্য কমিশনে জানান। অন্যদিকে অভিযোগটা সরকারী হাসপাতাল জড়িয়ে হলে তাকে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘তদন্ত করে দেখা হবে’ প্রক্রিয়ায়। আর অভিযোগ বেসরকারী হাসপাতালের ঘটনা সূত্রে হলে কর্তৃপক্ষ হুমকি দিচ্ছে আাদালতে যাওয়ার। মুখ্যমন্ত্রীর দৈনন্দিন স্বাস্থ্য বুলেটিনে ‘কিছু সমস্যা থাকছে’ গোছের একই অন্তঃসারশূন্য কথা থাকে। করোনা মোকাবিলার মূল ব্যবস্থা চিকিৎসা ব্যবস্থাও যে ক্রমাগত ঘাতক ভাইরাসের রূপ ধারণ করছে, সেই স্তরের স্বীকারোক্তি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা যায় না। তিনি সরাসরি একবার মাত্র বৈঠক করেছিলেন বেসরকারী হাসপাতাল মালিকশ্রেণীর সাথে, আবেদন জানিয়েছিলেন সাড়া দিতে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, সব ছেড়ে রাখা হয়েছে ঐ রক্তচোষা হাসপাতাল মালিকদের ‘শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া আার দয়া দাক্ষিণ্য’র ওপর। সরকারী তত্ত্বাবধানের এহেন নিষ্ক্রিয়তা দেখে স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য চরমে ওঠার দুঃসাহস পাচ্ছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সব বিষয়েই কিছু নিয়ম বিধি তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা সেসব মানছেই না। তাহলে এর বিহিত হবে আর কিভাবে, এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন নতুন করে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রশ্ন। সেফ কোয়ারান্টিন, সেল্ফ কোয়ারান্টিন, হোম কোয়ারান্টিন ইত্যাদি ব্যবস্থাও সমস্যা জর্জরিত অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। ব্যাপক সমস্যা রয়েছে আইসোলেশানে থাকার মতো পর্যাপ্ত ঘর, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পুষ্টিকর খাদ্য ও পারিপার্শ্বিক মানবিক পরিমন্ডল পাওয়ার প্রশ্নে। এমতাবস্থায় হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। করোনা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তুমুল চাপ সৃষ্টি করতে হবে কেন্দ্র-রাজ্যের উভয় সরকারের ওপর। কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের যত অর্থ পাওনা আছে অবিলম্বে তা পাঠাতে হবে। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন অনেক দেরীতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ভাবনার কথা বলছে তা নিয়ে কালক্ষেপ না করে পদক্ষেপ করতে হবে এখনই। রাজ্য সরকারকে আনুষ্ঠানিক তর্জন-গর্জন ও গয়ংগচ্ছ মনোভাব নিয়ে চলার বদলে প্রকৃত যুদ্ধকালীন সক্রিয়তায় নামতে হবে নতুন করে। এরসাথে প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীশ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রচার ও হস্তক্ষেপ সবদিক থেকে যুদ্ধঘোষণা। আর সবকিছুর জন্য গণ আবেদন লাগাতার তুঙ্গে তুলে জনতার শক্তিকে সংগঠিত করাই সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা।