বিবৃতি
কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২০-২১ : অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণ নেই

২০২০-২১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট মোদী সরকারের বিপজ্জনক অর্থনৈতিক নীতিগুলি অব্যাহত রেখেছে এবং বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষি সঙ্কট ও ভয়ানক নিম্নগামী মজুরির কবলে থাকা জনগণের যন্ত্রনা উপশমের কোনো উপায় বাৎলাতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাজেটের নথিগুলি নিজেই এই তথ্য স্বীকার করছে যে মোট কর্মসংস্থানে অস্থায়ী শ্রমিকের শতকরা হার  হ্রাস পেয়েছে। এই হ্রাস এমন একটা সময়ে হচ্ছে যখন বিজেপি সরকার দেশের শ্রমিকদের অস্থায়ীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এটা কর্মসংস্থানের শোচনীয় অবস্থার চিত্র তুলে ধরছে। স্বনিযুক্ত শ্রমিকদের অনুপাত ৫০ শতাংশ রয়েছে যা আট বছর আগে ২০১১ সালেও একই ছিল—এই তথ্যও বেকারত্ব বৃদ্ধির ইঙ্গিতবাহী।

এলআইসির বিক্রির পদক্ষেপ একদিকে এলআইসির কোটি কোটি পলিসি হোল্ডারদের জীবন ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলবে, পাশাপাশি তাদের সামাজিক সুরক্ষাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। এটা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের অক্ষমতাও তুলে ধরছে—এইভাবেই সরকার তার স্যাঙাৎ পুঁজিপতিদের ভর্তুকি দিতে জনগণের নিজস্ব অর্থ ছিনিয়ে নিচ্ছে। জনমানসের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলির কৌশলগত বিলগ্নিকরণ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

গ্রামীণ বেকারত্ব ও মজুরি সংকট মোকাবিলায় বাজেট মনরেগার কাজের পরিধি ও বরাদ্দ  বৃদ্ধি এবং কৃষক সংগঠনগুলির দাবি অনুযায়ী স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ  মেনে অর্থ বরাদ্দ করতে পারত। পরিবর্তে এটি একটি ১৬ দফা কর্মসূচি হাজির করেছে, যা কৃষিক্ষেত্রে উদারীকরণ পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়, যা আসলে বড় বড় কর্পোরেটদের আবাদকে ও কৃষিজমি দখলের পথকে আরও সুগম করবে। বাস্তবে মনরেগা বরাদ্দ, ২০১৯-২০ সালের সংশোধিত বরাদ্দ ৭১০০২ কোটি টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২০-২১-তে হয়েছে ৬১৫০০ কোটি টাকা, অন্যদিকে বকেয়া মজুরি, অর্থ বন্টন না করা, ও নতুন কাজ না দেওয়ার অভিযোগ আসছে।

রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার পয়সায় কর্পোরেটদের ডোল দেওয়ার সর্বনাশা নীতি অব্যাহত রয়েছে। বাজেট কর্পোরেট খাতে বিভিন্ন আকারে কিছু নির্দিষ্ট কর ছাড়ের সুবিধা দিয়েছে, তবে একই সাথে আয়কর সীমা হ্রাস করার কথাও বলেছে, যা বাধ্যতামূলক নয়। নতুন আয়কর হার মেনে কর ছাড় না নেওয়ার বিকল্পকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে  আদতে এতাবৎকাল আয়কর ছাড়ের আওতায় রেখে জনকল্যাণ, দাতব্য এবং অনুদানের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার দীর্ঘমেয়াদী নীতিকে বিদায় জানানো হল। এই প্রত্যাবর্তী পদক্ষেপ জনকল্যাণের বিভিন্ন প্রকল্প/প্রতিষ্ঠানে আয়করদাতাদের অর্থব্যয় করাকে নিরুৎসাহিত করবে।

ব্যাংক আমানতকারীদের বীমা এক লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে। এটাও সরকারের একটা স্বীকারোক্তি যে ব্যাংকে জনসাধারণের অর্থ এখনো নিরাপদ নয়। মানুষের সঞ্চয়কে ব্যাংকে আটকে রাখা হচ্ছে যাতে কর্পোরেটরা অবাধে ব্যাংক লুট চালিয়ে যেতে পারে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। সাধারণ আমানতকারীদের প্রতিটি পাই পয়সা নিরাপদ ও সুরক্ষিত হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এই একই সরকার বিমুদ্রাকরণ করে জনগণকে তাদের কষ্টের উপার্জন ব্যাংকে জমা করতে বাধ্য করেছিল। উপরন্তু এমনকি প্রয়োজনের সময়ও তাদের বীমাকৃত পরিমাণের টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে দেয়া হয়নি, পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক দুর্নীতি এবং একই ধরনের আরো কয়েকটি দুর্নীতিতে আমরা এইরকম দেখেছি।

সরকারী পরিসংখ্যানগুলির জন্য বাজেটের একটি নতুন জাতীয় নীতি ঘোষণার কথা এই কারণে আমাদের চিন্তিত করে তোলে যে, বর্তমান সরকার সরকারী পরিসংখ্যানে অভূতপূর্ব কারচুপি করেছে। ডেটা কেন্দ্র পার্ক নির্মাণের প্রস্তাব ডেটা সাম্রাজ্যবাদকে বাড়িয়ে তুলবে, যখন ইতিমধ্যেই মার্কিন চাপে “ডেটা প্রাইভেসি বিল” পাস করিয়ে ডেটা লোকালাইজেশন বা অভ্যন্তরীণ নাগরিক তথ্যের সংরক্ষণ ও গোপনীয়তাকে অনেকটাই লঘু করে দেওয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত তথাকথিত ডিজিটাল শাসন দেশের নাগরিকদের জন্য একটি ডিজিটাল বিপর্যয় হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, এখন ডেটার আরও সংহতকরণ এবং ডেটা কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব ডিজিটাল একচেটিয়া বিশ্বে বহুজাতিকদের দানবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার কর্মসূচিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই ঘোষণা এমন আশঙ্কাও জাগিয়ে তুলছে যে, সরকার জনগণকে নজরদারিতে রেখে ব্যক্তি স্বাধীনতা হ্রাস করার নীতি অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে।

বহু ঢক্কা-নিনাদে প্রচারিত আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের গত বছরের সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৩১১৪ কোটি টাকা, যা প্রাথমিক বরাদ্দ ৬৫৫৬ এর প্রায় অর্ধেক। এবছর আবার আমাদের দেখতে হবে যে এই প্রকল্পে আসলে কতটা ব্যয় হলো আর কতজন উপকৃত হল। অনুরূপে গত বছরে পিএম-কিষান যোজনার বরাদ্দের এক তৃতীয়াংশ অব্যয়িত রয়েছে।

সরকার বছর বছর নাবার্ডে তার শেয়ারের মূলধন হ্রাস করছে, যা এখন মাত্র এক হাজার কোটি টাকাতে এসে দাঁড়িয়েছে, দু’বছর আগে ঠিক যা ছিল তার অর্ধেক, যা কৃষি ক্ষেত্রকে বেসরকারী ক্ষেত্রে পরিণত করার পক্ষে নীতি বদলের ধারাবাহিকতার ইঙ্গিতবাহী।

রেল সুরক্ষার উন্নতি এবং রেল বেসরকারীকরণ বন্ধে বাজেট কোন কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি।

পুরোনো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বন্ধের সিদ্ধান্ত মূলত জমি হাঙ্গরদের স্বার্থে গ্রহণ করা হয়েছে।

একদিকে সরকার নাম করা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অভ্যন্তরে শিক্ষার পরিসর এবং গণতন্ত্রকে ক্রমাগত আক্রমণ করেই চলেছে সেই সময়েই শিক্ষার বেসরকারীকরণ ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হচ্ছে যা দেশের জন্য একটি বিপর্যয় বয়ে আনবে। বাজেট মহিলা, তফসিলি জাতি এবং অন্যান্য দুর্বল অংশগুলির জন্য গালভরা কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবে তা উল্লেখযোগ্য কোনো বরাদ্দ ছাড়াই। স্বচ্ছ ভারত মিশন ইতিমধ্যে একটি পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন বাজেটে কোনও উল্লেখযোগ্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দ না করার ফলে খালি হাতের সাফাই কর্মীদের এদেশে অদূর ভবিষ্যতে কোনো  ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা নেই!

২০১৫-১৬ সাল থেকে জিডিপির প্রবণতা নিম্নগামী, এই বছর তা সর্বনিম্ন। বাজেট এই বিষয়ে কোনও সংশোধন সমাধানের পথ দেখায় না, যদিও এখন এটি স্পষ্ট যে এই ধারাবাহিক মন্দা আসলে মেড ইন ইন্ডিয়া এবং কোনও বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের ফল নয়।সবার জন্য মাসিক তিন হাজার টাকা পেনশন, স্কিম কর্মীদের নিয়মিতকরণ এবং সমকাজে সমবেতনের মতো জনপ্রিয় দাবির প্রতি সরকার মনোযোগ দেয়নি, এগুলি সবই মন্দার প্রবণতা মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারতো।

সামগ্রিকে, বাজেট পড়লে একটি সরকারী প্রচারপত্রের মতোই মনে হবে যার মধ্যে বাস্তব  কোনো প্রতিশ্রুতিই নেই যা পতনশীল অর্থনীতিকে বাঁচাতে বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে, মন্দাকে প্রশমিত কিংবা চাহিদা বৃদ্ধি করতে পারে—বিশেষত গ্রামীণ ক্ষেত্রে এই বাজেট কিছুই পরিবর্তন আনতে পারবে না এবং স্থিতাবস্থাই বজায় রাখবে।

- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি

খণ্ড-27
সংখ্যা-3