বামেদের ফিরতে হবে লড়াই করে, নতুন চেহারা ও শক্তি নিয়ে
The left must fight back

(সম্মেলনে আগত প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, অতিথি ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য)

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রেশ ধরে দীপঙ্কর বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলন, তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় তৈরি হওয়া গান কবিতাগুলি সেই সময়পর্বর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই গৌরবময় আন্দোলনমুখর সৃজনশীল সমাজের ছবিটাই আমরা চাই। কিন্ত এই ছবিটা গত কয়েক বছরে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। বিজেপি-আরএসএস এখন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকেই প্রায় দখল করে ফেলেছে। একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের কিছু অংশ এখনো তাদের হাতের বাইরে। সে কারণেই দিল্লীর কনস্টিটিউশন ক্লাবে কালীসেনা বলে এক সংগঠনের জনৈক নেতা বললেন, তাঁদের চূড়ান্ত লড়াই এখন সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে। মোদী সরকার যা করছে তার বাইরেও যুবকদের আহ্বান জানানো হল স্বাধীনভাবে হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে।

‘ইসলাম সে আজাদি’র স্বপ্নকে আরএসএস ২০২৫ সালে তাদের শতবর্ষের সময়ের মধ্যেই পূর্ণ করতে চায়। সেই লক্ষ্যেই আমাদের গণতন্ত্র ও ইতিহাসের ওপর তারা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এটাও তাদের এক ধরনের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।

২০২১’র নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ সহ কয়েক জায়গায় নির্বাচনী ধাক্কা, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন ও ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের চাপে বিজেপি’কে খানিকটা পিছু হটতে হয়েছিল। কিন্তু ২০২২এ উত্তরপ্রদেশ সহ চার রাজ্যের নির্বাচনে জেতার পরে আবার তারা পুরোদমে তাদের অ্যাজেন্ডা পূরণে নেমে পড়েছে। জাহাঙ্গীরপুরী, শাহিনবাগ সহ নানা জায়গায় বুলডোজার নামছে এবং বিশেষ করে মুসলিমদের টার্গেট করা হচ্ছে। রামনবমীর মতো উৎসবের সময় দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।

নির্বাচনী পরাজয়ের পর বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়লেও আরএসএস পূর্ণমাত্রায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখানে বিজেপি’র বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে যে রায় দিলেন এবং যার সুফল মূলত তৃণমূলের ঘরে গেল, তাকে ব্যবহার করে রাজ্যের শাসক দল অপশাসন ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। এটা যত বাড়বে তত বিজেপি’র সুবিধে করে দেবে। এই জায়গা থেকেই এখানে বিরোধী শক্তি হিসেবে বামেদের উঠে আসা দরকার। কিন্তু পুরনো চেহারায় বামেরা ফিরতে পারবেনা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭’র অপশাসনের পর যেমন কংগ্রেস এই রাজ্যে দীর্ঘদিন আর জমি খুঁজে পায়নি, তেমনি যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এখানে বামফ্রন্টের পতন হল তাতে তাকেই পুরনো চেহারায় মানুষ ফিরিয়ে আনতে চাইছেন না। এখানে নতুন ধরনের বামপন্থার বিকাশ দরকার। একদিকে বিজেপি’র দেশজোড়া বিপদ ও অন্যদিকে রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে এখানে বামেদের একসঙ্গে লড়তে হবে। রূপসী বাংলার বুকে উপোসী বাংলার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

এই লড়াইয়ের প্রধান দিকগুলোর মধ্যে আছে কৃষকের ন্যূনতম মজুরির প্রশ্ন, রয়েছে স্থায়ী ও সম্মানজনক কাজের দাবিতে এবং নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সহ নানা বিষয়। কিছু পুরনো বুনিয়াদী লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন কিছু লড়াই। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন ও ভাবনাচিন্তা তার অন্যতম।

বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিকে যদি রণধ্বনিতে পরিণত করে সাফল্য পেতে পারে, তাহলে আমাদের হাতে আছে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’এর মতো জনপ্রিয় শ্লোগান, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের জঠর থেকে উঠে আসা। স্বাধীনতা আন্দোলন শুধু ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইই করেনি, তার মধ্যে থেকে এমন কিছু অধিকার আন্দোলনের জন্ম নিয়েছে যেগুলি আমাদের চলমান লড়াইয়ের হাতিয়ার। ১৯২০-তে শ্রমিক অধিকারের জন্য আইএনটিইউসি’র প্রতিষ্ঠা বা ১৯৩৬-এ কিষাণ মহাসভার আন্দোলনে জমিদারী উচ্ছেদের দাবি উঠে আসার কথা আমরা মনে করতে পারি। সেই ১৯৩৬-এ প্রস্তুত হয়েছিল আম্বেদকরের এক বক্তৃতার বয়ান, যা পরে ছাপা হয়। অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট শুধু অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের মধ্যেই আটকে না থেকে জাতপাত ব্যবস্থাটাকেই শেষ করার দাবি তুলল। দেশের মালিক যে জনগণ ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের সময় তৈরি গানে এই কথা এসেছিল, আর স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু থেকে সংবিধান পর্যন্ত সার্বভৌমত্বের কথাটা উজ্জ্বল হয়ে থাকল।

এই সমস্ত অর্জনগুলিকে বিপরীতদিকে ঘুরিয়ে দিতে চায় আরএসএস-বিজেপি। ১৯২৫এ কমিউনিস্টরা যেমন পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করবে তেমনি সেটা আরএসএস প্রতিষ্ঠারও শতবর্ষ। ভারতের চেহারা কেমন হবে তা নিয়ে এই দুই শক্তির লড়াই রয়েছে এবং থাকবে। এই লড়াই সংসদের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র করতে হবে। ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তির একটা মহাজোট এই নির্বাচনে দরকার। কিন্তু সেটা শুধু পাটিগণিতের ব্যাপার নয়। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে থেকেই এই জোট মজবুত ও শক্তিশালী হতে পারে।

আন্দোলন সংগ্রামের সাফল্য ও প্রসারের জন্য ভয়কে জয় করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপে যখন ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই হচ্ছে তখন কমিউনিস্টরা বলেছিল ফ্যাসিবাদ ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। এটা এখনকার ফ্যাসিবাদীরাও চায়। সাহস, দৃঢ়তা ও সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে এই ভয় ও সন্ত্রাসের রাজত্বের মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হবে।

প্রকাশ্য অধিবেশনে উপরোক্ত বক্তব্য রাখা ছাড়াও সম্মেলনের শেষ দিনে প্রতিনিধি সম্মেলন ও বিদায়ী রাজ্য সম্পাদকের জবাবী ভাষণের পর প্রতিনিধিদের সামনে বক্তব্য রাখতে উঠে সাধারণ সম্পাদক আরো কিছু কথা বলেন। সেখানে সাংগঠনিক কিছু বিষয়ের কথাবার্তা ছাড়াও একুশের নির্বাচন, সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে বিতর্ক ও বামেদের যুক্ত কার্যকলাপ প্রসঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। তিনি বলেন, একুশের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন গোটা দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ দখল করে নিতে পারে — এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট ছিল। আজকের বিজেপি’র মতো একটি পার্টির সঙ্গে গোটা দেশের অন্য কোনও পার্টির যে তুলনা হতেই পারেনা, এটা অনেকে বুঝতে পারছিলেন না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র বিপদ বাড়ছিল কিন্তু এই নিয়ে চেতনা বাড়ছিল না। আমরা এখানে এই কাজটা করতে চেয়েছিলাম। বিহারে আমাদের সাফল্যের কারণে আমাদের ওপর নজর বাড়ে এবং এই বিতর্ক তীব্র হয়।

In order to protect the endangered homeland

বামপন্থীরা পুরনো চেহারায় আর ফিরবে না। বামেদের ফিরতে হবে প্রতিটি ইঞ্চিতে লড়াই করে, নতুন চেহারা ও শক্তি নিয়ে। যেভাবে আমরা বিহারে লড়াই করছি, এখানেও সেটা করতে হবে। বিজেপি ও তৃণমূল দুই শক্তির সঙ্গে লড়াই কীভাবে একইসঙ্গে করা হবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বিহারের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে।

বিজেপি’র দেশব্যাপী উত্থানের পর্যায়ে ১৯৯০ থেকে ২০০৫ বিহারে আরজেডি সরকার ক্ষমতায় ছিল। প্রথম দিকে দলিত গরীবের মানসম্মান ও ক্ষমতায়নের কথা হলেও পরবর্তী পর্যায়ে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও অপশাসনের অভিযোগে এই সরকার ক্ষমতা হারায়। এই দীর্ঘ পর্যায়ে গণহত্যা, ধারাবাহিক রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রের নিপীড়নের মাধ্যমে আমাদের পার্টিকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তবুও আমরা বিজেপি’র বিপদকে কখনও কম করে দেখিনি, আরজেডি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কখনও বিজেপি’কে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিইনি। বাংলার মাটিতেও একইভাবে বিজেপি’র বিপদ এবং তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এখানে কোন সহজ সরল শর্টকাটের প্রশ্ন নেই।

সাহস, বিশ্বাস, সংগঠনের শক্তি — সব মিলিয়েই বিপ্লবী বামপন্থাকে এগিয়ে যেতে হবে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-19