নির্বাচন ক্ষেত্রের পুনর্বিন্যাস কমিশনের রিপোর্ট :
দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভাও নির্বাচন ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস ২০২৬ সাল পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তকে খারিজ করে ঐ অঞ্চলের জন্য ডিলিমিটেশন কমিশন বা নির্বাচন ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস কমিশন গঠন হয়েছিল ২০২০ সালের ৬ মার্চ, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণ ও ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রায় সাড়েসাত মাস পর। কমিশন নিজেকে স্বাধীন সংস্থা বলে দাবি করেছিল। যার অর্থ, গণতন্ত্রকে অগ্ৰাধিকারে রেখে, নির্বাচনী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে অঞ্চলের জনগণের সমান অধিকার ও সুযোগকে সুরক্ষিত করেই নির্বাচন ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটানো বা নতুন সীমা নির্ধারণ। কিন্তু কমিশন গত ৫ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে তাতে স্বাধীনতার বদলে তাদের বশংবদতারই এক নিদর্শন ধরা পড়ল, ৩৭০ ধারা বাতিলের পিছনে যে অভিসন্ধি কাজ করেছিল, কমিশনের রিপোর্টে মূর্ত হল তারই ধারাবাহিকতা। চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা করার আগে কমিশন দু’দফা খসড়া রিপোর্ট পেশ করেছিল। ওই রিপোর্ট পেশ করা পর্বেই অভিযোগ উঠেছিল — কমিশনের কাজের ধারা রাজ্য মর্যাদা হারানো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলটাতে নির্বাচন ক্ষেত্রে বিজেপি’র সুবিধা লাভের লক্ষ্যেই চালিত হচ্ছে। রিপোর্টের মূল প্রস্তাবগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আজকের দেশব্রতীর ২০ জানুয়ারি ২০২২ সংখ্যায় কমিশনের কাজের এক সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, কমিশন বিধানসভা আসন বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করেছে, কিছু আসনের পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব যে ধারায় করা হয়েছে তাতে একদিকে জম্মু শাখার তথা হিন্দু-গরিষ্ঠ ক্ষেত্রের প্রভাব সম্প্রসারণের সুযোগ করে দেওয়া, অন্যদিকে উপত্যকার তথা কাশ্মীরের প্রভাব হ্রাস করার নকশা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনা প্রকাশ দেশাই, অপর দুই সদস্যের একজন হলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্র ও অপরজন জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচন কমিশনার কে কে শর্মা। এছাড়া, জম্মু ও কাশ্মীরের পাঁচ সাংসদও (ন্যাশনাল কনফারেন্সের তিন ও বিজেপি’র দুই) কমিশনের সহযোগী সদস্য ছিলেন। কমিশন জানিয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিকগণ, সুশীল সমাজের গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পরই তাঁরা রিপোর্ট তৈরি করেছেন। কিন্তু রিপোর্ট এক নজরে দেখে মনে হয়, বিজেপি’র নেতৃবৃন্দ ছাড়া অন্যান্য দলের মতামত কমিশনের কাছে খুব একটা গ্ৰহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই, বিজেপি ছাড়া কাশ্মীরের বড়-ছোটো সব দলই কমিশনের রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রথমে বিধানসভার আসন সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবের কথাই ধরা যাক। রাজ্য মর্যাদা থাকা অবস্থায় জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার আসন সংখ্যা ছিল ১১১, যারমধ্যে ২৪টি নির্দিষ্ট ছিল পাক অধিকৃত কাশ্মীর অঞ্চলের জন্য এবং সেগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ কখনও ছিল না এবং তা হয়ওনি। বাকি ৮৭টি আসনের মধ্যে ৪টি নির্দিষ্ট ছিল লাদাখের জন্য, জম্মু শাখার জন্য ৩৭টি এবং উপত্যকা তথা কাশ্মীরের জন্য ৪৬টি। জম্মুর তুলনায় কাশ্মীরের আসন সংখ্যা যে ৯টি বেশি ছিল তা কাশ্মীরের জনসংখ্যা বেশি থাকার ভিত্তিতেই। কমিশন প্রস্তাব করেছে জম্মু শাখার আসন সংখ্যা বাড়ানো হবে ৬টা, তা ৩৭ থেকে বেড়ে হবে ৪৩। আর, কশ্মীর শাখার আসন সংখ্যা বাড়বে মাত্র ১টা, ৪৬ থেকে বেড়ে তা হবে ৪৭। কমিশন জানিয়েছে, ২০১১’র জনগণনার ওপর ভিত্তি করেই তাঁরা তাঁদের প্রস্তাব সমূহ তৈরি করেছেন। ২০১১’র জনগণনা অনুসারে উপত্যকার জনসংখ্যা ছিল ৬৮.৮৮ লক্ষ, আর জম্মুর জনসংখ্যা ছিল ৫৩.৫১ লক্ষ। জম্মুর তুলনায় কাশ্মীরের জনসংখ্যা ১৫ লক্ষের বেশি হলেও কাশ্মীরের তুলনায় জম্মুর আসন ৫টি বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হল। এইভাবে, দুই শাখার মধ্যেকার আসনের ব্যবধান ৯ থেকে কমিয়ে ৪এ নিয়ে আসার মধ্যে আইনসভায় উপত্যকার তুলনায় জম্মুর প্রতিনিধিত্বকে আরও জোরালো করে তোলার পরিকল্পনা প্রশ্নহীন ভাবে পরিস্ফুট। জনসংখ্যাকে গুরুত্বহীন করে তোলাটা প্রতিনিধিত্বকে সংকীর্ণ করার নামান্তর, এটা গণতন্ত্রের প্রতি অবহেলা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারেনা। জম্মু শাখার কিছু জেলার আসনের পুনর্বিন্যাস এমনভাবে করা হয়েছে, কিছু অংশ বাদ দিয়ে এবং কিছু নতুন এলাকা যুক্ত করে ক্ষেত্রের সীমা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে আসনগুলিতে হিন্দু নির্বাচকমণ্ডলী গরিষ্ঠ হয়। যেমন, কিস্টোয়ার ও ডোডা জেলার আসনগুলোর কথা। এই দুই জেলায় আসন সংখ্যা আগে ছিল দুটো করে, নতুন প্রস্তাবে একটা করে বাড়িয়ে তিনটে করে করা হয়েছে। দুটো জেলাতেই আগের দুটো আসনেই মুসলিম ভোটার ছিল বেশি, এখন তিনটের মধ্যে দুটোতে হিন্দু ভোটার বেশি হবে। চেনাব উপত্যকার আসনগুলোকে কিভাবে হিন্দু গরিষ্ঠতাবিশিষ্ট করে তোলা হয়েছে, সে কথা জানাতে গিয়ে এলাকার পিডিপি নেতা ফিরদৌস তক বলেছেন, চেনাব উপত্যকার (যার মধ্যে রয়েছে ডোডা, রামবান ও কিস্টোয়ার জেলা) আসন সংখ্যা ৬ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮। কিন্তু, “আগে ছটার মধ্যে পাঁচটা ছিল মুসলিম গরিষ্ঠ; এখন আটটার মধ্যে পাঁচটাই হবে হিন্দু গরিষ্ঠ”।
জম্মুর আসনের নতুন বিন্যাসের সঙ্গে কাশ্মীরের তুলনা করা যাক। উপরে উল্লিখিত জম্মুর কিস্টোয়ার জেলার জনসংখ্যা হল ২,৩১,০৩৭ (২০১১’র জনগণনা অনুসারে)। তার আসন সংখ্যা ২ থেকে বাড়িয়ে ৩ করা হয়েছে। আর, কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার জনসংখ্যা এর প্রায় সাড়ে চার গুণ, ১০ লক্ষ ৭ হাজার। কিন্তু এই জেলার আসন সংখ্যা বাড়ানোর গুরুত্ব কমিশন তার বিবেচনায় আনতে পারেনি।
কাশ্মীরের অনন্তনাগ লোকসভা কেন্দ্রের নতুন সীমা নির্ধারণের মধ্যেও বিজেপি’র সুবিধা করে দেওয়ার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। আগে জম্মু লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে থাকা পুঞ্চ জেলা ও রাজৌরি জেলার দুই-তৃতীয়াংশকে অনন্তনাগ লোকসভা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব হয়েছে। নতুন লোকসভা কেন্দ্রের নাম হবে অনন্তনাগ-রাজৌরি। প্রস্তাবিত এলাকার এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের দূরত্ব কয়েকশ কিলোমিটার হলেও এবং ভৌগলিক সংলগ্নতা না থাকলেও এই ধরনের সীমা নির্ধারণ কমিশনের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি, সাধারণের কাছে এর যৌক্তিকতা যদিও ভেবে ওঠা মুশকিল। আসলে, পুঞ্চ ও রাজৌরি জেলার যে অংশকে অনন্তনাগ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে গুজ্জর ও বাকেরওয়াল জনজাতিরই সংখ্যাধিক্য। নতুন প্রস্তাবিত ক্ষেত্রের ২৬.২০ জনগণের মধ্যে এই গুজ্জর ও বাকেরওয়ালরাই হবেন ঐ জনসংখ্যার প্রায় ১৯ শতাংশ। এরা প্রকৃতিতে যাযাবর এবং ধর্মে মুসলিম হলেও কাশ্মীরি জাতিসত্ত্বার অন্তর্গত নয়। জনজাতি হওয়ায় এদের বসবাসের ৬টা বিধানসভা কেন্দ্র সংরক্ষিত করার প্রস্তাব হয়েছে। আর এই লোকসভা কেন্দ্রের ১৮টা বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে (জম্মু ও কাশ্মীরের পাঁচটা লোকসভা কেন্দ্রের প্রত্যেকটাতেই ১৮টা করে বিধানসভা ক্ষেত্র থাকবে) এই ৬টা সংরক্ষিত ক্ষেত্রও থাকবে। বিজেপি’র আশা, গুজ্জর ও বাকরেওয়ালদের প্রভাবিত করে শুধু ওই সংরক্ষিত বিধানসভা ক্ষেত্রগুলোই নয়, অনন্তনাগ-রাজৌরি লোকসভা কেন্দ্রের ফলাফলকেও তাদের দিকে ঝোঁকাতে পারবে।
জম্মু ও কাশ্মীরের আয়তনে জম্মুর ভাগ ৬২ এবং কাশ্মীরের ভাগ ৩৮ শতাংশ হলেও দুই শাখা মিলিয়ে মোট জনসংখ্যায় জম্মুর ভাগ হল ৪৩.৭২ শতাংশ এবং কাশ্মীরের ভাগ ৫৬.২৮ শতাংশ। জনসংখ্যার এই গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ডিলিমিটেশন কমিশনের প্রস্তাবিত আসন সংখ্যা কাশ্মীরের নির্বাচনী প্রতিনিধিত্বকে আরও প্রতিকূল করেই তুলবে। বিধানসভা আসনের মোট সংখ্যায় জম্মুর ভাগ ৪৪.৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৪৭.৭৭ শতাংশ, আর কাশ্মীরের অংশ ৫৫.৪০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়াবে ৫২.২২ শতাংশে। জম্মুতে হিন্দু গরিষ্ঠ নির্বাচনী ক্ষেত্রের সংখ্যা ২৫ থেকে বেড়ে হবে ৩৩, আর মুসলিম গরিষ্ঠতার আসন ১৩ থেকে কমে হবে ১০টা। ২০১৪’র নির্বাচনে বিজেপি বিধানসভায় বিজয়ী হয়েছিল ২৫টা আসনে যার সবগুলোই এসেছিল জম্মু শাখা থেকে। এবার তাদের লক্ষ্য জম্মু থেকে বিজয়ী আসনের সংখ্যাকে আরও ১০ থেকে ১৩টি বাড়ানো, যারমধ্যে যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করছে সংরক্ষিত আসনগুলো (সংরক্ষিত আসনের মোট প্রস্তাব হল ১৬টা, জনজাতিদের জন্য ৯টা এবং তপশিলি জাতিদের জন্য ৭টা)। আর শুধুমাত্র জম্মু শাখা থেকে জয়লাভ করা আসনগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তারা জম্মু ও কাশ্মীরে শাসন কায়েম করা, কোনও হিন্দু নেতাকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসানোর দুরভিসন্ধি লালন করে চলেছে।
এইভাবে, কাশ্মীর উপত্যকার একটা আসনেও বিজয়ী না হয়েও উপত্যকাকে, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে শাসন করার বিজেপি’র অভিপ্রায়ে ডিলিমিটেশন কমিশনের কাঁধ যেন বিজেপি’র কাঁধের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কমিশন যদিও বলেছে যে, নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাসে শুধু জনসংখ্যা নয়, ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য-সংযোগ পরিস্থিতি-জনসংযোগের সুবিধা-এলাকার সংলগ্নতার মতো বিষয়গুলোও তাদের বিচার্য হয়েছে, এসত্ত্বেও তাদের বিচারের ভিত্তির অযৌক্তিকতা এবং বিজেপি’র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মনোভাব কিছুতেই আড়াল করা যাচ্ছে না। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি যথার্থই বলেছেন, “ডিলিমিটেশন কমিশন বিজেপি’রই শাখা হয়ে উঠেছে এবং জনসংখ্যার মানদণ্ড উপেক্ষা করে বিজেপি যেমন চায় সেরকম কাজই করেছে। আমরা কমিশনকে বিশ্বাস করিনা। এদের সুপারিশগুলো ৩৭০ ধারাকে বাতিল করা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের ক্ষমতাকে খর্ব করার সঙ্গে যুক্ত।” যে আইনের বলে ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছিল, ২০১৯ সালের সেই রিঅর্গানাইজেশন অ্যাক্ট বা পুনর্গঠন আইনের বৈধতা সুপ্রিম কোর্টে বিবেচনাধীন রয়েছে। ডিলিমিটেশন কমিশনের গঠনকেও অবৈধ আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। এই দুই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় যাই হোক না কেন, ডিলিমিটেশন কমিশন আর পাঁচটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো বিজেপি’র মোসাহেব বলেই যেন নিজেকে জাহির করল। কমিশন নিজেদের স্বাধীন সংস্থা বলে দাবি করলেও তার পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাবগুলোয় জম্মু শাখার পর্যাপ্ত সুবিধা লাভ ও কাশ্মীরি জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতা হ্রাসের সম্ভাবনায় কমিশনের রিপোর্টকে শুধু নিকৃষ্ট নথি বলেই থেমে থাকা যাচ্ছেনা, তা ভারত জুড়ে চলা মুসলিম বৈরিতা ও সংখ্যাগুরুবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চলমান অভিযানের সহচর বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।
- জয়দীপ মিত্র