সুপ্রীম কোর্ট অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ব্যবহার আপাতত বন্ধ রাখা হোক। কেন্দ্রের মোদী সরকার সময় চেয়েছে ‘আইনটির অপব্যবহার’ রোধে ‘পুনর্বিবেচনা’ করে দেখবে বলে। এখনই আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ মোদী জমানা ছল-বল-কৌশলে যেমন নৃশংস তেমনি ধুরন্ধর। কেন্দ্র কি করবে তা সময়ের ধারায় জানা যাবে। তবে, বোঝা যাচ্ছে চাপের মুখে পড়েছে। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির প্রশ্নবাণের মুখে কেন্দ্রের কৌসূলীর ঠ্যাটামী দাঁড়ায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট সচিবেরও প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে একইরকম। অনতিবিলম্বে অবস্থান বোঝা গেল কিঞ্চিৎ রক্ষণাত্মক। স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদীরা ছিল না, তবু ‘ছিল’ বলে ইতিহাসের বিকৃতকরণে উঠেপড়ে লেগেছে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর উপলক্ষে ‘অমৃতউৎসবে’ মাতোয়ারা হতে হচ্ছে, এই অবস্থায় ঔপনিবেশিক আমলের নিপীড়ক আইন আজও কেন চলবে প্রশ্ন উঠছে। বল এখন মোদী সরকার আর বিজেপির কোর্টে।
দেড় শতাধিক বছরের একটা দমন আইন। চালু করেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসকেরা। মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দিতে। ব্রিটেনেও এর প্রবর্তন করা হয়। তবে মূল নিশানায় ছিল উপনিবেশ ভারত। আইনের শাসনের নামে দমনরাজ চালানোর অপরাধ শুধু ব্রিটিশ শাসকরা করেনি। পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে পরাধীন ভারতের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি অক্ষত করে রাখা হয়। ঔপনিবেশিক আমলের আরও পাঁচ রকমের দমন আইনও বজায় রাখা হয়। ১২৪এ ধারাটি ইতিহাস বলছে, ষাটের দশকের গোড়ায় একবার মামলার গেড়োয় পড়লেও ছাড় পেয়ে যায়। চোখ বুজে থাকে আইনসভা-বিচারসভা। আমলাতন্ত্রও। সে ছিল কংগ্রেসের নেহরু-গুলজারিলাল আমল। তারপর আর এনিয়ে বিশেষ হৈচৈ হয়নি। গত শতকের ষাট-সত্তর দশক ছিল নিরন্তর আন্দোলনের ঝড়ের, তার মোকাবিলায় ইন্দিরা-সিদ্ধার্থ ঘরানার শাসকশ্রেণী নামিয়েছিল বিভিন্ন দমন আইন। তখন লাগু করা হোত ১২০বি ও ১২১এ অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধঘোষণা’র মতো মারাত্মক ধারা। তবে সীমিত সংখ্যায়। আর তখনও পুরোদস্তুর দানবীয় রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ শুরু হয়নি। এটা চালু করে দেওয়া হয় একুশ শতকের দেশ শাসনে রাজ্য শাসনে। রাজ্যে রাজ্যে শাসকের রং নির্বিশেষে ‘পোকা’-’মোকা’-’আফস্পা’ ইত্যাদি — নানা নিবর্তন আইন লাগু হতে থাকে। কেন্দ্রে ইউপিএ আমল নিয়ে আসে ইউএপিএ। সেই প্রক্রিয়ায় সিডিশন অ্যাক্ট চাপিয়েও দমন শুরু করে দেওয়া হয়।
২০১০ থেকে ২০২২ — এক দশকাধিক সময়কালে উপরোক্ত দুটি সবচেয়ে মারাত্মক জনবিরোধী আইনের ব্যবহার একইভাবে চলেনি। তারতম্য থেকেছে। ইউপিএ আমলের তুলনায় মোদী আমলে বহুগুণ ব্যাপক বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এনসিআরবি'র রিপোর্ট বলছে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে এপর্যন্ত মামলার ৬৫ শতাংশই মোদী আমলে। যে সর্বোচ্চ পাঁচটি রাজ্য এই আইনের যথেচ্ছে ব্যবহারে অভিযুক্ত, তার চারটিতেই বিজেপি সরকারের শাসন। পয়লা নম্বরে রয়েছে যোগী সরকার শাসিত উত্তরপ্রদেশ। আইনটি কোথায় না ব্যবহার হয়েছে! টার্গেট করা হয়েছে ছাত্র আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, মজদুর আন্দোলন, এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন, সমান নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, সীমান্ত সেনা সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন, জাতিসত্তার আন্দোলনকে। কাদের না নিশানায় ফেলা হয়েছে! জনআন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, সক্রিয় সমাজকর্মী, জনমুখী সাংবাদিক, মিডিয়া কর্মী, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানকর্মী, ইতিহাসবিদ, নাট্যকর্মী, গায়ক, লেখক, কলমচি, দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও বিরোধীপক্ষের লোকজনকে। সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রায় সর্বাংশেই চলে আসছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে হামলা। বিনাবিচারে কারাগারের অন্তরালে অন্তহীন বন্দী করে রাখার নিগ্রহ, উৎপীড়ন। এমনকি আবালবৃদ্ধবনিতা হলেও, স্বাভাবিক চলাফেরা করতে অসমর্থ হলেও, প্রাণের স্পন্দন থেমে গেলেও, মুক্তি মেলেনা। কি আশ্চর্য! আইনটি শীর্ষ আদালতের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর লেগে গেল! সংবিধান ও গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জ্বারই কথা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদী সমাজপতি ও শাসকদের কোনও শরম নেই। ওরা চালাচ্ছে সংবিধান বহির্ভূত জবরদস্তি ও সংবিধানের চূড়ান্ত জনবিরোধী ধারার সমন্বয়ে সাঁড়াসী আক্রমণ। এইসব চালিয়ে ওরা ভয়ের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়।
তবু মানুষের চোখ-কান খুলছে, মানুষ চিন্তা করছে, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, রুখে দাঁড়াচ্ছে। তীব্রতম ব্যাপকতম অত্যাচার আর ভীতি সন্ত্রাস সীমা ছাড়ানোয় প্রতিক্রিয়ায় মানুষের ভয়ভীতিও কাটছে। জীবন-জীবিকার অধিকার চলে যাওয়ার বিপদ তাড়িত হয়ে মানুষের ভয় ভাঙছে। অস্তিত্ব রক্ষার আওয়াজ উঠছে — মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষার্থে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি সংবিধান, সমাজ ও রাষ্ট্রদেহ থেকে বাদ দিতে হবে। ‘অপব্যবহার পুনর্বিচারের’ বাহানা আবার কী! আইনটিকে পুরো বাতিল করতে হবে। শুধু রাষ্ট্রদ্রোহ আইন কেন, ইউএপিএ, আফস্পা ইত্যাদি জনবিরোধী কানুনী উপাঙ্গগুলোকে নির্মূল করতে হবে। জনগণের এই দাবি, কণ্ঠনাদ সরাসরি বিজেপি গরিষ্ঠের সংসদে, মোদী সরকারের খাসমহলে গ্রাহ্য হওয়ার নয়, কিন্তু শীর্ষ আাদালতে তার সামান্যতম হলেও প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই দ্যোতনা ওই দাবি আদায়ের রাস্তার লড়াইকে শক্তি যোগাবে।