সম্মেলনে সরব শ্রমজীবী নারী
women at the conference

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দ্বাদশ রাজ্য-সম্মেলনে ২১টি জেলা থেকে নির্বাচিত ও মনোনীত ৪০০ জন প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকের মধ্যে আমন্ত্রিত ছিলেন ৮৬ জন মহিলা, উপস্থিত হয়েছিলেন ৭২ জন। মহিলা প্রতিনিধিদের অগ্রভাগে ছিলেন ক্ষেতমজুর, গরিব চাষি, বিড়ি-শ্রমিক, জন-মজুররা। এই প্রতিটি পেশায় যুক্ত শ্রমজীবী মানুষদের কথা ভাবলেই সাধারণ জ্ঞানে চোখে ভাসে পুরুষদের ছবি। অথচ, রাজ্য-সম্মেলনের ছবিটা ছিল বেশ অন্যরকম। রাজ্য-সম্মেলনে আগত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমজীবী মেয়েদের লড়াইগুলো ঠিক কীরকম? আসুন জেনে নিই তাদের কয়েকজনের মুখ থেকে।

হাওড়ার শিরীনা শেখ বললেন, “বিজেপি গরুর জন্য অনেক কিছু করছে কিন্তু মানুষের জন্য কিছু করছে না”। শিরীনা বলছিলেন, বিজেপি’র দৌলতে দেশজোড়া মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের মধ্যে আমাদের রাজ্য সরকারের দুর্নীতি কিভাবে মানুষকে নাজেহাল করে রেখেছে। আমি তো পর্দানসীন ঘরের মেয়ে, যদি এখানে আসতে পারি, তবে দেশের ঘরে ঘরে মেয়েরা আছে। তাদের দাঁড়াতে হবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

পুর্ব বর্ধমানের কালনা জেলায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সংগঠক সুমির কথায়, লক্ষীর ভান্ডারের ৫০০ টাকা দিয়ে মেয়েদের মুখ বন্ধ রাখতে পারছেনা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ১০০ দিনের কাজ মুলতুবি রেখেছে সরকার। সমকাজে সমমজুরির জন্য আমরা অক্লান্তভাবে দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। সমাজের চোখরাঙানী, নীতি-পুলিশি আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশের সাথে মোকাবিলা করেই পড়াশোনা, কাজ বা কাজের দাবি তুলছে সুমির এলাকার মেয়েরা। তাঁর কথায়, “মমতা ব্যানার্জীকে বাংলার মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলো যাতে বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক ও জনবিরোধী রাজনীতির কবলে আমরা না পড়ি। মেয়েরাই তো মুখ্যমন্ত্রীকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলো কারণ আমরা বিজেপি’র বিপদ আর তাদের পিতৃতান্ত্রিক চেহারা বুঝতে পেরেছিলাম।” সম্প্রতি, হাঁসখালির গণধর্ষনের ঘটনায় সুমির এলাকার মেয়েদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। তারা প্রশ্ন করছে, “আপনি যদি মেয়েদের নিয়ে এতই ভাবেন তবে মেয়েদের উপর নির্যাতন বাড়ছে কীভাবে? আর নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে বিরূপ মন্তব্য করছেন কেন?”

দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল মুর্শিদাবাদের কৃষক টুলুবালা দাসের সাথে। টুলুবালার মতে, কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের একত্রিত হতে হবে। ১৯৯৪ সালে জমির বর্গার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে টুলুবালা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সংস্পর্শে আসেন। ক্ষেতমজুর পরিবারের মেয়ে টুলুবালা ছোটো থেকে অনাহার আর দারিদ্র্য খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কোনোরকমে সঞ্চয় করে বিঘাখানেক জমি কিনে কৃষিকাজ শুরু করেন। এখন নিজের জমিতে চাষ করে শস্য সব্জি ফলান আর হাটে বিক্রী করে সংসার চালান। রাজ্য-সম্মেলনের তিন দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচোনা আর কর্মকান্ডের মধ্যে টুলুবালার মন পড়ে আছে তার গ্রামের বিঘাখানেক জমিতে। নিজের জমির সাথে সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে চোখ চিকচিক করে ওঠে প্রত্যয়ী টুলুবালার। বলেন, চাষের সাথে আমার জীবন চলে। জমির সাথে আমার আত্মার যোগ। শুধু আমি নয়, আমাদের গ্রামের ৩০০ ঘর কৃষক নিজেরা শস্য ফলিয়ে হাটে বিক্রী করে। সার, বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় টুলুবালা বাড়িতে সার তৈরী করতে শুরু করেছেন। কিন্ত প্রতিবেশী কৃষকদের মধ্যে অনেকেই মহাজনের থেকে চড়া সুদে সার, বীজ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। নিজের এলাকায় শাসক দলের অত্যাচার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে টুলুবালা বললেন, “ঝুঁকির মধ্যেই আমাদের অধিকারের লড়াই করি সততার সাথে। তাই আমরা ভয় পাইনা। আমরা জানি, হয় মরব নয় মারব।”

নদীয়া জেলার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক বেলা নন্দী জনমজুরি আর ১০০ দিনের কাজ করে পেট চালান। দীর্ঘদিন ঘরে বকেয়া মজুরি আর স্থায়ী কাজের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন বেলা। বলছেন, গ্রামের মহিলা শ্রমিকদের কাজ থেকে বঞ্চিত করে সরকারি কাজের তহবিল তছরুপ আর দুর্নীতি চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্যরা। সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাইরের গ্রাম থেকে লোক নিয়ে এসে ন্যায্য মজুরির অনেক কম টাকায় ১০০ দিনের কাজ করাচ্ছিল তৃণমূলের নেতারা। মাটি কাটার ট্র্যাক্টরের সামনে একাই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বেলা। আটকে দিয়েছিলেন তৃণমূলের দুর্নীতির রাজ। বলেছিলেন, “বাইরের পুরুষদের নিয়ে এসে মহিলাদের কাজ কেড়ে নিতে দেবো না। আমরা শ্রমজীবী মানুষ, খেটে খাবো। জোচ্চুরি মেনে নেবো না।” বেলার সাহস দেখে এগিয়ে এসেছিলো তার সহকর্মীরা। ৬ মাসের বকেয়া মজুরির দাবি আদায় করতে বেলার নেতৃত্বে পঞ্চায়েতে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা জন-মজুররা। বেলাকে পর্যবেক্ষক পদের লোভ দেখিয়ে ১০০ দিনের কাজের কমিটিতে ঢোকানোর চেষ্টা করেছিল শাসক দল, চেয়েছিল বেলাকে তাদের দুর্নীতিতে সামিল করতে। পদ আর ক্ষমতার সুযোগ ছুঁড়ে ফেলে বেলা তুলে নিয়েছেন মাটি কাটার কোদাল। রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বেলা নন্দী বললেন, “আমি মাটি কাটি, মাটি কেটে পেট চালাব। কিন্তু দুর্নীতি আর অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করবনা”। নদীয়া জেলায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেত্রী সালেয়া খাতুনের কথায়, “দেশব্যাপী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংক, বিমা, পরিবহন সহ সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণের কোপ পড়ছে মেয়েদের উপর। মেয়েদের পড়াশোনা আর চাকরিতে সুযোগ তৈরী করার কথা যদি সরকার না ভাবে তাহলে ভাবে কে? ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’এর আড়ালে মেয়েদের পুড়িয়ে মারছে বিজেপির সরকার। কে কার সাথে থাকবে, কী খাবে, কোথায় যাবে সবই ঠিক করে দিতে চাইছে বিজেপি’র নেতা মন্ত্রীরা। এদেরকে আটকাতে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন দরকার।”

শিলিগুড়ির চা-বাগানের শ্রমিক নেতা মামনি বর্মন আর ময়নাগুড়ির তিলক অধিকারী রাজ্য সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরলেন চা-বাগানের শ্রমিকদের বঞ্চনা আর দুর্দশার করুণ ছবি। উত্তর-বঙ্গের চা বাগানে উৎপন্ন চা দিয়ে শৌখিন শহুরে মানুষেরা আসর সাজায়। অথচ, চা-বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে কতজন ওয়াকিবহল। তিলক বলছিলেন, জিনিষপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। এর মাঝে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে চা-পাতার বাজারি মূল্য পড়তির দিকে। যারা নিজের জমিতে চা চাষ করেন, তাদের চা বিক্রি করে হাতে কিছুই থাকছেনা। এমতাবস্থায়, অন্যের বাগানে কাজ করা চা-শ্রমিকদের অবস্থা দুঃসহ। ন্যায্য মজুরির দাবিতে মামনি-তিলকরা মিটিং, মিছিল করে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চা-বাগানের শ্রমিক, শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী, আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার অন্যতম সংগঠক সুমন্তি এক্কার কথায়, “আমরা লড়াই ছাড়ছিনা। অন্যের জমিতে দিনরাত খেটে হাতে আসেনা পেট চালাবার মতো টাকা। আমাদের জমির পাট্টা চাই। যতদিন না জমির পাট্টা পাচ্ছি আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।”

হুগলীর ধনিয়াখালিতে ঋণ-মুক্তি নিয়ে আন্দোলন চালানো রুমা আহেরী শ্রাবণী মালিকরা তুলে ধরলেন ঋণমুক্তির নিয়ে তাদের দৃপ্ত সংগ্রামের কাহিনী। মানুষের দারিদ্র আর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মাইক্রোফিনান্স কোম্পানী (ক্ষুদ্র-ঋণ প্রকল্প সংস্থা) চড়া সুদে ঋণ দিয়ে গেছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে গ্রামের মেয়েদের স্বনির্ভর করার দুয়ো দেখিয়ে মেয়েদের ঋণ নিতে উৎসাহিত করেছিলো কেন্দ্র ও রাজ্য-সরকার। মাত্র চার মাসের অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলস্বরূপ ব্যবসাগুলি ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের বোঝা চাপে গ্রাম ও মফস্বলের মেয়েদের উপর। চুড়ান্ত অমানবিক মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিদের ক্রমাগত হুমকি ও চাপের মুখে সরকারের থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে এলাকায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন রুমা, শ্রাবণীরা। লাগাতার পঞ্চায়েত, ব্লক, জেলা অফিস ঘেরাও চলে ঋণ-মকুবের দাবিকে ঘিরে। দেশজুড়ে চলা ঋণমুক্তি আন্দোলনকে স্থানীয় স্তরে ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এই মেয়েরা। আন্দোলনের প্রভাবে ঋণ আদায় মুলতুবি থাকলেও চড়া সুদের বোঝা কমাতে কোনো ভূমিকা নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য সম্মেলনের শেষে শ্রাবণী শ্লোগান দিলেন, “তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি লাল সেলাম।”

শ্রাবণী, সালেয়া, বেলা, টুলুবালা, শিরিনার মতো মেয়েরা আজ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের লড়াইয়ের অগ্রভাগে। অতীতের সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নয়া সমীকরণ তৈরি করছেন এরা। দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন আর দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির অপশাসনের বিরুদ্ধে মাথা নত না করে, সাহস আর শক্তির মিশেলে উজ্জ্বল বাংলার শ্রমজীবী মেয়েরা।

- সম্প্রীতি মুখার্জী ও সৌমী জানা

খণ্ড-29
সংখ্যা-19