শৈশব-কৈশোর কাল নিয়ে আমাদের সরকার বাহাদুরের মুখে শোনা যায় কত শত রাশভারী কথা। তা সে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘মন কা বাত’ হোক বা ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-কথা, অথবা অন্য কোনও উপলক্ষে হোক, কথায় কোনও কার্পণ্য করা হয় না, চলে অজস্র কল্পকথার আসর। আর বাস্তবে করুণ পরিণতি হল, শৈশব-কৈশোর শিকার হয়ে চলছে চূড়ান্ত অনাদর, অবহেলা, অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি, বিপথগামীতার।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) পেশ করা এক রিপোর্ট রীতিমতো হাড়হিম করে দেওয়ার মতোই। ঐ রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, ২০০০ সালে তথ্য ছিল জুভেনাইল অপরাধে অভিযুক্তদের এক-তৃতীয়াংশেরই হয় শিক্ষাগত অবস্থা প্রাথমিক স্তরের নয়ত তারা নিরক্ষরতার শিকার। তাদের অর্থনৈতিক শ্রেণী-স্তরের নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া সম্ভব না হলেও তারা যে হতদরিদ্র সব পরিবারের সন্তান সেটা নিশ্চিত বোধগম্যের। ২০১৯ সালের সংশ্লিষ্ট তথ্য ছিল, এদের ২৮ শতাংশ নিরক্ষর এবং ৪২ শতাংশের শিক্ষা স্তর দশম শ্রেণীর নিচে। অপরাধের অভিযোগে আটক জুভেনাইলদের ৬৬ শতাংশ, বিচারাধীনদের ৬৯ শতাংশ এবং সাজাপ্রাপ্তদেরও ৬৯ শতাংশ উপরোক্ত দুই বর্গের মধ্যেকার। সুযোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে এদের শিক্ষাজীবনে অচিরেই ঘনিয়ে আসে আঁধার, আর তার পরিণতিতে স্কুল ছুট এবং অপরিণত চপল মস্তিষ্কে ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পেয়ে অপরাধকর্মের হাতছানিতে জড়িয়ে যাওয়া হয়। একবার অপরাধী সাব্যস্ত হলে ও সাজাজীবন ভোগ করলে হতাশায় বিরক্তিতে রাগে ক্ষোভে আর সুমতিতে ফেরা হয়ে ওঠে না। বিচারের সুযোগলাভের প্রশ্নে ধরা পড়ে তীব্র শ্রেণী বৈষম্য। যারা সম্পন্নশালী অংশের তারা প্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল বেসরকারি আইনী সাহায্যের সংস্থান করে নিতে পারে, সেই সুবাদে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে; অন্যদিকে যারা গরিব বা গরিবতম অংশের তাদের পক্ষে ভালো আইনি সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয় না, শাস্তির দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ‘পকসো’ আইনের ৪০ ধারায় বলা আছে, অভিযুক্ত শিশু/বালক/কিশোরের অভিভাবক বা পরিবারের লোকজনদের অধিকার রয়েছে সরকারি কৌসূলীদের মধ্যে থেকে পছন্দের আইনজীবী চয়নের, কিন্তু কার্যত সে সুযোগ মেলে না। সুবিচারের দাবি নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও শ্রেণী বৈষম্য থাকে।
অশেষ দুর্গতির এই ধারা এই দেশে এই রাজ্যে চলে আসছে বহুকাল যাবত। ২০১৯ পর্যন্ত স্কুল পড়ুয়াদের কিছু কিছু তথ্য হল, এক-তৃতীয়াংশের ছেদ ঘটে যায় প্রাথমিক স্তরে, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত টিকে থাকে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের ৩৫ মিলিয়ন, স্কুলে যায় উপরোক্ত সমবয়সীদের অর্দ্ধেকাংশেরও কম। আর ৫ থেকে ৯ বছরের মেয়েদের ৫৩ শতাংশ রয়ে গেছে নিরক্ষর। ‘ইউনিসেফ’-এর নিদান আছে, প্রত্যেক অপ্রাপ্তবয়সী সন্তানদের শিক্ষার অধিকার কার্যকরি করতে হবে। অন্যদিকে ২০২০-২১-এর একটানা অতিমারী সময়ে লাগাতার শিক্ষালয় বন্ধ রাখার পরিণামে অবস্থাটা এক মারাত্মক আকার নিয়েছে। মূলত দুভাবে — খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনৈতিক চূড়ান্ত ভগ্নদশা ঘটেছে আর তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল শিক্ষাঙ্গনছুট হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার যদি পরিবারপিছু এককালীন কয়েক হাজার টাকা অর্থসাহায্য আর মিড ডে মিল সহ বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা করতে আন্তরিক হত তাহলে একটা প্রজন্মের ভিত এভাবে উত্তরোত্তর ক্ষতিগ্রস্ত হত না। শিক্ষাবিদদের অনেকে যেমন আরও সাবধানতার সাথে আরও রয়েসয়ে স্কুলশিক্ষা ফের শুরুর কথা বলেছেন, তেমনি শিক্ষক-অশিক্ষক অনেকে তুলেছেন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের ভাবনা এবং সক্রিয় হয়েছেন তার সাধ্যমতো রূপায়ণে। সমাজের প্রতিনিধিরা যে স্পর্ধা, যে উদ্ভাবনী চিন্তা, নিজেদের উজার করে দেওয়ার যে মন-মানসিকতা রাখতে পারে; সরকারপক্ষ তা রাখতে পারে না কেন, রাখে না কেন? এ কি সহ্য করা যায়! এর কি কোনও মার্জনা হয়!