লাতিন আমেরিকার নানা দেশে গত তিন দশকে বাম ঝোঁক সম্পন্ন একাধিক সরকারের প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম আমরা দেখেছি। কিন্তু পেরুতে কখনো বামপন্থীরা জিততে পারেনি। সেখানে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী সরকারই বরাবর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এবছর ২৮ জুলাই বামপন্থী প্রার্থী কাস্তিলোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে পেরুতে তাই এক নতুন অধ্যায় শুরু হল।
কাস্তিলো পেরুর রাজনীতিতে নতুন মুখ। যে পার্টির সমর্থনে তিনি নির্বাচনে দাঁড়ান ও বিজয়ী হন সেই ফ্রি পেরু পার্টির সদস্যও তিনি ছিলেন না। ফ্রি পেরু পার্টির সর্বোচ্চ নেতা, কিউবা থেকে পড়াশুনো করা চিকিৎসক ভ্লাদিমির কেরন পেরুর একজন পরিচিত মার্কসবাদী। নির্বাচনে কেরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রুখতে তাঁকে দুর্নীতি মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়। শেষ মুহূর্তে কাস্তিলো হন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী।
নির্বাচনী প্রচারের গোটা পর্বে কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক দেশের আর্থ সামাজিক নীতিমালার আমূল রূপান্তরের কথা বলেন। নিও লিবারাল নীতি থেকে সরে সমাজবাদী নীতিমালার দিকে এগনোর প্রতিশ্রুতি তিনি স্পষ্টভাবে দেন। এজন্য নতুন সংবিধানসভা তৈরি করে ১৯৯৩ সালে তৈরি করা নিও লিবারাল সংবিধানটি বদলে দেওয়ার জন্য এক গণভোটের কথাও তিনি তোলেন। তাঁর প্রচারের মূল কথা ছিল “ধনী দেশ পেরুতে কোনও গরিব থাকবে না”। গত তিন দশক ধরে পেরুতে আর্থিক বিকাশ হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে, কিন্তু তার সুফল মূলত পেয়েছে মুষ্টিমেয় ধনীরা। কাস্তিলোর প্রচার একারণে দেশের বিরাট অংশের মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।
নির্বাচনী প্রচারে কাস্তিলো তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে প্রচারে সুনির্দিষ্টভাবে হাজির করেন। তিনি জানিয়ে দেন ক্ষমতায় এলে তিনি পেরুর সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আওতায় নিয়ে আসবেন। এই বাবদ রাষ্ট্রের আয় থেকে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ভরতুকি প্রদানের কথা তিনি বলেন। প্রতিশ্রুতি দেন জাতীয় আয়ের কুড়ি শতাংশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হবে। পেরুতে যে সমস্ত বিদেশি কর্পোরেট সংস্থা রয়েছে, তাদের আয়ের সত্তর শতাংশ পেরুতেই পুনর্বিনিয়োগ করার নীতি প্রণয়নের কথাও তিনি বলেন। পেরুর আর্থিক সম্পদের বহির্গমন আটকানোর জন্য বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণের কথাও তিনি বলেন।
সমাজবাদী বাম ঘরানার এই সামাজিক অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রতিশ্রুতি কোভিড জনিত পরিস্থিতিতে জনগণের কাছে আশ্বাসবাণী হিসেবে উপস্থিত হয়। পৃথিবীর আরো নানা জায়গার মতোই পেরুও কোভিডের দিনকালে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে কোভিডে মৃত্যুর হার সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেরুতে। ক্ষমতাসীন সরকার কোভিড নিয়ন্ত্রণে যেমন চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি বিফল হয়েছে ভ্যাকসিন কর্মসূচিকে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও। পেরুর তিন কোটি কুড়ি লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ দু’ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। কাস্তিলো নির্বাচনী প্রচারে দেশের সব মানুষকে নিখরচায় ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
পেরুর সমাজ অর্থনীতিতে মারাত্মক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি কাস্তিলোকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে। কাস্তিলোর এই বিজয় শুধু পেরুর ইতিহাসেই নয়, লাতিন আমেরিকার সার্বিক রাজনীতিকেই যথেষ্ট প্রভাবিত করবে।
সোভিয়েত ভাঙনের পরে যখন শোনা যাচ্ছিল ইতিহাসের সমাপ্তি ও টিআইএনএ (‘পুঁজিবাদ ছাড়া’ দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ) জাতীয় তত্ত্বাবলী, সেই সময়েই লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে এক ইতিহাস তৈরি হতে থাকে। ১৯৯৮ সালে ভেনেজুয়েলার নির্বাচনে প্রথমবারের জন্য বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হন হুগো স্যাভেজ। এরপরে বিভিন্ন নির্বাচনে পরপর চারবার বিজয়ী হয়ে তিনি গোটা লাতিন আমেরিকার বামমুখী পটপরিবর্তনের অন্যতম কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর উত্তরসূরী মাদুরোকে মার্কিন মদতপুষ্ট দক্ষিণপন্থী প্রার্থী পরাস্ত করতে পারেননি। নানা উথালপাথালের মধ্যে দিয়ে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো স্যাভেজের একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিউবা এবং ভেনেজুয়েলার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার নানা দেশে আমরা বিভিন্ন মাত্রার বামঝোঁক সম্পন্ন সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখছি। ২০০২ সালে চিলেতে রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে বিজয়ী হন রিকার্ডো লাগোস, ব্রাজিলে লুলা। ২০০৩ সালে আর্জেন্টিনার নির্বাচনে বিজয়ী হন নেসটর কির্কনার, উরুগুয়েতে ২০০৫ সালে নির্বাচনে জেতেন তাবারে ভাজকুয়েজ। ২০০৬ সালে চিলিতে মিশেল বাশালেত, বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস, ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও নিকারাগুয়ায় ড্যানিয়েল ওর্তেগা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে আর্জেন্টিনায় ক্রিস্টিনা ফের্নানদেজ ও গুয়েতমালায় আলভারো কলোম রাষ্ট্রপতি পদে বসেন। প্যারাগুয়েতে ২০০৮ সালে ফের্নাদো লুগা এবং এল সালভাদোরে ২০০৯ সালে মরিসিও ফুয়েনেস রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সে বছরই ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও বলিভিয়ায় ইভো মোরলেস দ্বিতীয় বারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। উরুগুয়েতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন হোসে মুজিকা।
বামপন্থীদের এইসব বিজয়ের বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থী শিবিরের পক্ষ থেকে সব সময়েই নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চালানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক কর্পোরেট লবি এই সব ষড়যন্ত্রে দেশগুলির দক্ষিণপন্থী শক্তিকে নানাভাবে মদত দিয়ে যায়। কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছি ২০১৯’র নির্বাচনে বলিভিয়ায় মোরালেস বিজয়ী হবার পরেও মার্কিন রাষ্ট্র ও কর্পোরেটদের মদতে সেই জয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চলে। জনগণের একাংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় কর্পোরেট প্রচারযন্ত্র। ইভো মোরালেস বাধ্য হন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। নির্বাচনে জিতেও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে একটা গোটা বছর কাটাতে হয় তাকে।
কিন্তু এই চক্রান্তের সাফল্য দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। মাত্র এক বছরের মধ্যে পুনরায় আয়োজিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পান ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোসালিজম-এর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী লুইস আর্ক। যিনি আগে মোরালেসের শাসনকালে বলিভিয়ার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আর্ক শুধু যে জিতেছেন তাই নয়, এই জয়ের মার্জিন বুঝিয়ে দিয়েছে একবছর আগের দক্ষিণপন্থী চক্রান্তর চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে বলিভিয়ার জনগণ কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। লুইস আর্ক যেখানে ৫২ শতাংশ মতো ভোট পেয়েছেন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা কার্লোস মেসা সেখানে পেয়েছেন ৩১ শতাংশের মতো। মনে রাখতে হবে মোরালেস ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজম বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয়, তাই নিয়ে বিরোধিরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। মোরালেস বিরোধী ক্যু-এর পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যিনি দায়িত্ব নেন, কনজারভেটিভ পার্টির সেই নেতা জেনাইন আনিয়েজ নিজেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কার্লস মেসা মুভমেন্ট ফর সোসালিজম প্রার্থী আর্ককে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে পারেননি, পিছিয়ে থেকেছেন বিরাট ব্যবধানে।
পেরুর সাম্প্রতিক নির্বাচনে কাস্তিলোর বিজয়কেও দক্ষিণপন্থী শিবির মেনে নিতে পারেনি। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর নানাভাবে তার বিজয়কে অস্বীকার করতে চেয়েছে। এই নির্বাচনে কাস্তিলো পরাজিত করেছিলেন সে দেশের পরিচিত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মুখ কেইকো ফুজিমোরিকে। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরই ফুজিমোরি নির্বাচন কমিশনকে বলেন দেশের আন্দিয়ান এলাকায় প্রদত্ত দু’লাখ ভোটকে বাতিল ঘোষণা করতে হবে, যার অধিকাংশই পেয়েছিলেন কাস্তিলো। একমাস ধরে নানা ধরনের তদন্ত ও বিচার বিবেচনার পর পেরুর নির্বাচন কমিশন ফুজিমোরির দাবিকে বাতিল করে কাস্তিলোকেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করেন। ফুজিমোরি শিবির এতেও না দমে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ‘অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস’কে দিয়ে পুনরায় খতিয়ে দেখার কথা বলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে চলে এবং এই সংস্থাই ২০১৯এ নির্বাচনী বিজয়ের পরেও বলিভিয়ায় ইভো মোরালেসকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে বড় ভূমিকা নিয়েছিল নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ তুলে। পেরুর সরকার অবশ্য ফুজিমোরির দাবিকে মেনে নেয়নি এবং কাস্তিলোকেই তারা প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিতে বলে। ২০২১’র ২৮ জুলাই, স্পেনের অধীনতা থেকে পেরুর মুক্তির ঐতিহাসিক ২০০ বছর পূর্তির দিনে কাস্তিলো সাম্প্রতিক সময়ে পেরুর প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
কাস্তিলো প্রেসিডেন্ট পদে বসলেও তাঁর শাসন একেবারেই নিষ্কন্টক নয়। পেরুর রাজনীতির ক্ষমতা ভারসাম্য এখনো প্রবলভাবেই দক্ষিণপন্থী শিবিরের দিকে হেলে আছে। যে ফ্রি পেরু পার্টির সমর্থনে কাস্তিলো নির্বাচনে জিতলেন তারা সংসদে সংখ্যালঘু। ১৩০ আসন বিশিষ্ট পেরুর সংসদে তাদের সাংসদ ৩৭ জন। সংসদে দক্ষিণপন্থী শিবিরের পাল্লা অনেক ভারি। দেশের সেনা বাহিনীর প্রধান সিজার আস্তিদিলোও নয়া প্রেসিডেন্টের প্রতি বিরূপ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত কিন্তু বৃহত্তম পার্টির নেতা কুইকো ফুজিমোরি হুমকি দিয়ে রেখেছেন কাস্তিলোর মত কমিউনিস্ট যেন দেশকে ধ্বংস করতে না পারেন, সংবিধান বদলে দিতে না পারেন, তারজন্য তিনি যা করার করবেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হলেও কাস্তিলোর শাসন কীভাবে এগোবে তা মূলত নির্ভর করবে পেরুর ক্ষমতাশালী শিবির ও জনগণের বৃহৎ অংশের দ্বন্দ্বজাত ক্ষমতা ভারসাম্যের ওপরেই। বিশ্বের সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক শক্তির শুভেচ্ছা এই যুদ্ধে পেরুর জনগণের পাশেই থাকবে। চোখ থাকবে পেরুর ক্ষমতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ভারসাম্য বদলের লড়াইয়ের দিকে।
- সৌভিক ঘোষাল