প্রতিবেদন
সমীক্ষা দেখালো কৃষকদের দৈনিক আয় মাত্র ২৭ টাকা !
daily income of farmers

দেশের অন্নদাতারা কৃষিকাজ থেকে ২০১৮-১৯ সালে দৈনিক কত উপার্জন করেছে তা কি ভারতবাসী জানেন?

মাত্র ২৭ টাকা! যা মনরেগার মজুরি থেকেও কম! এই সংখ্যাটাই ভারতীয় কৃষির গভীর সংকটকে প্রতিবিম্বিত করছে। কৃষকেরা কেন ভারত বনধ্ ডাকতে বাধ্য হলেন, তার আভাস হয়ত এখান থেকে কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে।

ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স অফিস (এনএসও)-র তরফ থেকে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সমীক্ষা — সিচুয়েশন অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট, যা প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায়, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১।

উক্ত সমীক্ষা উল্লেখ করেছে, আনুমানিক ৯ কোটি ৩১ লক্ষ পরিবার কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। এ ছাড়াও, ৭ কোটি ৯৩ লক্ষ পরিবার অ-কৃষি কাজের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। এই সমীক্ষা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, অর্ধেকের ও বেশি গ্রামীণ জনসংখ্যা কৃষিকাজ থেকে ন্যূনতম উপার্জন করতে পারছেন না। প্রায় ৯৯ শতাংশ অ-কৃষি পরিবারের হাতে রয়েছে এক হেক্টর থেকেও কম জমি , তাই অনিয়মিত বা ক্যাজুয়াল ধরনের কাজই তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে যে সিদ্ধান্তে অনায়াসে উপনীত হওয়া যায় তা হল — কৃষিকাজের সাথে যুক্ত পরিবারগুলোর কাছে কৃষি এখন আর আয়ের প্রধান উৎস নয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে কৃষি থেকে আয়ের উৎস প্রধান অবস্থানে না থাকাটা বুঝিয়ে দেয় যে ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষি প্রান্তিক সীমানায় রয়েছে। অলাভজনক কৃষিকাজ কর্পোরেট বিনিয়োগের জন্য কতটা আকর্ষনীয় হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল সন্দিহান।

সমীক্ষায় প্রকাশ, ৯ কোটি ৩১ লক্ষ কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ৭১ শতাংশ পরিবার কৃষিতে স্বনিযুক্ত বা পশুপালনের কাজে জড়িত।

মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ নিশ্চয়তা প্রকল্পে যে মজুরি সাধারণত দেওয়া হয় তা খোলা বাজারে ন্যূনতম মজুরির থেকে সামান্য কম। এই একশ দিনের কাজের প্রকল্পের সাথে যারা যুক্ত, তাঁরাই সবচেয়ে দরিদ্র হিসাবে বিবেচিত। সমীক্ষা দেখিয়েছে, পাঁচটি রাজ্য বাদে কৃষিকাজ থেকে অর্জিত দৈনিক গড় আয় ১০০ দিনের প্রকল্পের ন্যূনতম মজুরি থেকেও কম।

কৃষি যে আর লাভজনক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নয় তা অতিমারীর সময়ে সরকার কর্তৃক ঘোষিত লকডাউন নির্দয় ভাবে ফুটিয়ে তুলল। দেখা গেল, নিজ গ্রামীণ ক্ষেত্রে কাজের অভাবে যে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ পরভূমে কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছিলেন, লকডাউনের পর সেই সমস্ত কাজ-হারা লক্ষ কোটি মানুষের অনর্গল স্রোত, অবর্ণনীয়-অমানবিক যন্ত্রণা ও দুর্দশাকে পাথেয় করে ফের নিজ নিজ বাসভূমে ফিরে আসে। এই ছবি সেই কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেই মেলে ধরল। বিপরীতে, এই প্রথম দেখা গেল, কৃষিক্ষেত্রটা চরম সংকটের মধ্যে বেঁচে বর্তে থাকার শেষ সম্বল, ডুবন্ত মানুষের অন্তিম খড় কুটো। ধারাবাহিকভাবে কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমশ নিচের দিকে গড়িয়ে পড়া অর্থনীতি ২০১৯-২০তে প্রথম মুখ তুলল। এই প্রথম ওই বছরে কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বেড়ে হয় ৪৫.৬ শতাংশ — ঠিক তার আগের বছরে যা ছিল ৪২.৫ শতাংশ। লকডাউন শহুরে ভারতে নজিরবিহীন মাত্রায় যে কাজ কেড়ে নেয়, গ্রামীণ ভারত সেই কাজের একটা অংশকে ঠাঁই দেয়। এপ্রিল-জুন ২০১৯-এ শহুরে ভারতে কাজ চলে যায় আনুমানিক ১ কোটি ১০ লক্ষ আর ওই একই সময়ে গ্রামীণ ভারতে কর্মসংস্থান নতুন করে বৃদ্ধি পায় ১ কোটি ৪৭ লক্ষ। কিন্তু গ্রামীণ ক্ষেত্রে এই কাজ অনেক কম মজুরিবৃদ্ধিতে, অধিক শ্রমসাধ্য ক্ষেত্রে হয়েছে। অগত্যার গতি, দুর্দশা চালিত সময়েই কৃষি বেশ কিছুটা প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে ব্যতিক্রম হিসাবে।

অতিমারির সৃষ্ট আর্থিক দুর্দশা থেকে কোনোক্রমে বাঁচতে, কাজ হারা বিপুল সংখ্যক মানুষ মাথা গুঁজতে সেই কৃষি ক্ষেত্রকেই বেছে নিল, কেন্দ্রীয় সরকারের অবজ্ঞা অবহেলায় যা আজ মরণাপন্ন হয়ে উঠেছে। যে মোদী সরকার “আগামী ৫ বছরে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ” করার আওয়াজ তুলেছিল, আজ নিঃস্ব রিক্ত দেনার দায়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা কৃষক সমাজ আর আত্মহননের পথে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে নেমেছে রাজনৈতিক এক লড়াইয়ে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ভারত বনধের ডাক দিয়ে নামহীন অবয়বহীন অবহেলিত অগণিত কৃষকেরা আজ ছুঁড়ে দিয়েছে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষ এই প্রথম দেখতে চলেছে সংযুক্ত কৃষক মোর্চার ডাকে দেশব্যাপী বনধ যার পাশে দাঁড়িয়েছে সারা দেশের শ্রমিকশ্রেণি, ছাত্র যুব মহিলা সমাজ, বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলসমূহ।

মোদীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে যাওয়া বিরাট এই মহাকাব্যের জন্য চলছে জোর লড়াইয়ের প্রস্তুতি।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-28
সংখ্যা-34