ভিন রাজ্যের এক তরুণী। আসন্ন প্রসবা। নিঃসহায়, নিঃসম্বল। খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ প্রান্তে এক স্টেশনে তাকে অসহায় ভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে পরদিন একটি পুত্রসন্তান হয় তার। এরপর চিকিৎসক ও নার্সদের সহৃদয় পরিচর্যায় সে কিছুটা সুস্থ হয়ে তার ঠিকানা বলতে পারে। পাঞ্জাবের এক অজ পাড়া গাঁয়ে তার বাড়ি। লক ডাউনের সময় স্বামীর চাকরি যায়। তারপর একসময়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তরুণী এবং বড় অদ্ভুত ভাবে এখানে এসে পড়ে। বহু কষ্টে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তার ভাই জানায় তারা হদ্দ গরিব, ট্রেনভাড়া দিয়ে এসে বোনকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া বোনকে খাওয়ানোর সঙ্গতিও তার নেই। সন্তানসহ তরুণী মা এখনও হাসপাতালেই পড়ে আছেন।
ঋত্বিক ঘটক বেঁচে থাকলে হয়তো হৃদয় নিংড়ানো দরদ আর ক্রোধ নিয়ে একটা ছবি করতেন, (বা করতেন না)। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এ কোন হতদরিদ্র ভারতের ছবি?
গত দেড় বছরে অতিমারী পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হিংস্র লুঠেরার চেহারাটা একেবারে নগ্ন হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ সরকারটা দেশের মানুষকে ঠেলে দিয়েছে ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য অনাহার অপুষ্টি অশিক্ষার অতল অন্ধকারে। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। আর্থিক বৈষম্য তীব্রতম হয়েছে। দেশের মানুষের করের টাকায় মেধায় শ্রমে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সম্পদ, পরিকাঠামো, পরিষেবা জলের দরে বেচে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। বন-জঙ্গল-নদী-পাহাড়-খাদান লুঠ তো চলছেই কবে থেকে। অন্যদিকে চলছে ব্যক্তিমানুষের, বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন পেশার মানুষের সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার হরণ। প্রতিবাদী মানুষকে দানবীয় আইনে বিনা বিচারে আটক রাখা, মেরে ফেলাও অব্যাহত।
মোদী-শাহর এই লাগামছাড়া দুঃশাসনীয় ঔদ্ধত্য, এই দানবীয় শোষণ আর নির্লজ্জ মিথ্যাচারের অভিশপ্ত আখ্যানের সমান্তরালে নিঃশব্দে লেখা হয়ে চলেছে ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায়। সে ইতিহাস বীরত্বের, সাহসের, স্থৈর্যের, সহিষ্ণুতার, সর্বোপরি আত্মত্যাগের! সেই ইতিহাস লিখছেন ভারতবর্ষের কৃষক শ্রেণী! দিল্লীর সীমানায় সিঙ্ঘু, গাজিপুর, টিকরি বর্ডার ছাড়িয়ে সেই প্রতিস্পর্ধা ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের প্রতিটি কোণে। মোদী-শাহের নির্মমতায় বিপর্যস্ত মানুষের সমস্ত ক্ষোভ, প্রতিবাদকে নিজের মধ্যে সংহত করে কৃষকরা হয়ে উঠেছেন আরও জেদী, আরও লড়াকু, আরও কুশলী, আরও দূরদর্শী, আরও দায়িত্বশীল। তাই তারা মোদী-শাহ তথা বিজেপি-আরএসএস-এর এই জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন দেশব্যাপী প্রতিবাদের, ডাক দিয়েছেন ‘ভারত বন্ধের’, আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর।
গত ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ৭১তম সংবিধান দিবস, যেদিন সারা ভারতের ২৫ কোটি শ্রমজীবী, পেশাজীবী মানুষ সাধারণ ধর্মঘটে উগড়ে দিয়েছিলেন তাদের ক্ষোভ, সেইদিন কৃষকরা তিনটি জনবিরোধী কৃষি-বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লী অভিযান করেছিলেন শাসকের সব অত্যাচার উপেক্ষা করে। সেই শুরু। তার পরের ঘটনাপ্রবাহ সবার জানা। এখন আর সেই তিনটি দাবিতে তারা আটকে নেই। ছড়িয়ে পড়েছেন তারা জনজীবনের বিভিন্ন স্তরে। কুড়িয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন দাবি। সাচ্চা নেতার মতো! তারা প্রাইভেটাইজশন, মানিটাইজেশন-এর নামে দেশের সম্পদ বেচা, শ্রমিক-অধিকারের উপর হামলা এবং ভারতীয় সংবিধানের উপর হিন্দুত্ববাদীদের হামলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ‘মোদীর ভারত বেচা’র অপচেষ্টাকে উন্মোচিত করে চলেছেন।
ফিরে এসেছে কৃষক সংগঠনের সেই শিহরণ-জাগানো শ্লোগান ‘আল্লাহ্ আকবর’ ‘হর হর মহাদেব’। গত ৫ সেপ্টেম্বর মজফ্ফরপুরের ‘কিসান মহাপঞ্চায়েত’ চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনে শ্রেণিগত ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এক ঐতিহাসিক নজির রেখেছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র যুব মহিলাসহ সমস্ত মানুষের ঐক্যকে শাসক শ্রেণী সবচেয়ে ভয় পায়। আর এই ঐক্যই হবে সাধারণ মানুষের শাসকদল তথা জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে অসমযুদ্ধে এক এবং একমাত্র হাতিয়ার! সেই বার্তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়ে তারা বলেছেন, রাস্তার হিম্মতের লড়াই একদিন গুঁড়িয়ে দেবে তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠতার বর্বর তাণ্ডবকে!
গত ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ কৃষক আন্দোলনের ২৯৫তম দিনে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ‘ভারত বন্ধ’-এর ব্যাপারে এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছে-এই বন্ধ হবে স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ। সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত। উদ্দেশ্য - কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সমস্ত অফিস, স্কুল কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান-বাজার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের সরকারি ও বেসরকারি গণপরিবহন, সরকারি কাজকর্ম ও অনুষ্ঠান বন্ধ করা। তবে অত্যাবশ্যক জরুরি পরিষেবা সংক্রান্ত সবকিছু বন্ধের আওতার বাইরে থাকবে। জনসাধারণের কাছে বন্ধের বার্তা যথেষ্ট আগে নিয়ে যেতে হবে যাতে তাদের কোনো অসুবিধা না হয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও তীব্রতর হয়ে ওঠা বিজেপিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তারা সঙ্গত দাবিগুলি মেনে নিলেই সমস্যা মিটবে। তার আগে নয়। হরিয়ানা সরকার সুপ্রিম কোর্ট ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশে অতিরিক্ত মুখ্যসচিবকে শীর্ষে রেখে পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে এক কমিটি তৈরি করেছে। সোনপাতের জেলাশাসক এস কে এম-এর নেতাদের নিয়ে মুর্থালে এক বৈঠক ডেকেছেন। লক্ষ লক্ষ কৃষক দিল্লি সীমান্তে প্রতিবাদ অবস্থানে রয়েছেন নিজেদের ইচ্ছায় নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও অন্যান্য রাজ্যের পুলিশ তাদের এখানে থাকতে বাধ্য করেছে। কৃষকরা ভারী বৃষ্টি-বন্যা, জ্বালা ধরানো গ্রীষ্ম ও কড়া ঠাণ্ডার মাসগুলো সেখানে অত্যন্ত কষ্টে অতিবাহিত করেছেন। এ পর্যন্ত ৬০০-রও বেশি কৃষক শহীদ হয়েছেন। তারা এই তীব্র কষ্ট ভোগ করেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন — তাদের জীবিকা, উৎপাদনের প্রাথমিক সম্পদ আর তাদের আগামী প্রজন্মগুলির ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্য। সরকারের ঔদ্ধত্য ও একগুঁয়েমি কৃষকদের বাধ্য করছে সীমান্তে প্রতিবাদ জারি রাখতে।
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকল্প কর্মীদের সর্বভারতীয় ধর্মঘটকে সক্রিয় সমর্থন জানাচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই প্রকল্প কর্মীরা (অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড ডে মিল, এনসিএলপি, এসএসএ, এনএইচএম) তাদের জীবিকার নিয়মিতকরণ, শ্রমিকের মর্যাদা, ন্যূনতম মজুরির দাবিতে লড়ছেন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা মনে করে, এই প্রকল্পকর্মীরা যারা প্রত্যন্ত গ্রামে পর্যন্ত পুষ্টি স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিশু পরিচর্যা, শিক্ষা সংক্রান্ত অত্যন্ত জরুরি প্রাথমিক পরিষেবা দিয়ে চলেছেন, তারা মূলত মহিলা এবং ভয়ঙ্করভাবে শোষিত। শুধু তাই নয়, তারা কোভিডের সামনের সারির যোদ্ধা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন। তাদের সংগ্রামে পূর্ণ সংহতি জানায় এসকেএম।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, উত্তরপ্রদেশ বিজেপির পরিকল্পিত ‘কিসান সম্মেলন’ রাজ্যের কৃষকদের বোকা বানাতে পারবে না। তারা কালা কৃষি আইন বাতিল করা ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সুনিশ্চিত করার আইন লাগুক করার দাবিতে রাজ্য জুড়ে বড় বড় সমাবেশ করছেন।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক আন্দোলনকে শক্তিশালী করা ও ২৭-এর বন্ধকে সফল করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিবৃতির শেষে সমাজ সংস্কারক ও ‘দ্রাবিড় আন্দোলনের পিতা’ পেরিয়ার ই ভি রামস্বামীর জন্মদিবস উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলা হয়েছে তাঁর আত্মমর্যাদা আন্দোলন এবং জাতি বর্ণ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় বিচারের সফল সংগ্রাম বর্তমান প্রজন্মকেও গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে।