এক বছরের বেশি হয়ে গেল দিল্লীর সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারিরা জেলে আছেন। তাঁরা যে দাঙ্গার শিকার সেই দাঙ্গারই কারিগর হিসেবে তাঁদের অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই বন্দিদের মধ্যে যেমন আছেন বিশাল সংখ্যক মুসলমান আন্দোলনকারি ও মুসলমান পেশাজীবী, তেমনই আছেন বহু শ্রমিক যারা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারিদের বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিলেন। ইতিমধ্যে দিল্লি হিংসার প্রকৃত অপরাধিরা — বিজেপি নেতারা যারা ভিড় জমিয়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালানোর উসকানি দিয়েছিল, তারা — বেমাসুল ছাড়া পেয়ে গেছে।
এই গত মাসেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, যাদের অধীনে দিল্লি পুলিশ চলে, দিল্লি পুলিশকে পুরস্কার দিয়েছে দিল্লী দাঙ্গার তদন্তে পুলিশের “এক্সেলেন্ট” কাজের জন্য। এর সমুচিত এক জবাব দিল্লীর সেশন আদালতের এক রায়ের মাধ্যমে এসেছে। দাঙ্গা-অভিযুক্ত তিনজন মুসলমান পুরুষকে জামিন দিয়ে এই রায় দিল্লী পুলিশের তদন্তকাজকে “তদন্ত করার কোনও প্রকৃত ইচ্ছাই নাই, কেবল করদাতাদের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয়” বলে ভর্ৎসনা করেছে। তার ফলে, ওই রায়ে বলা হচ্ছে, “অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যাদের বহু মামলায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তারা সব জেলে পচছেন”। অতিরিক্ত সেশন জাজ বিনোদ যাদব আই বি কর্মচারি অঙ্কিত শর্মার হত্যার দায়ে অভিযুক্ত শাহ আলম, রশিদ সাইফি ও শাদাবকে জামিন দিয়ে বলেন, “ইতিহাস যখন দেশভাগ পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে কদর্য এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে ফিরে তাকাবে তখন … সঠিকভাবে তদন্ত চালাতে তদন্তকারি সংস্থাগুলোর এই ব্যর্থতা … অবশ্যই গণতন্ত্রের প্রহরিদের যন্ত্রণা দেবে”।
অ্যাডিশনাল সেশন জাজ (এএসজে) দিল্লি পুলিশকে অভিযুক্ত করেছে “আদালতের চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা” করার এবং এমনকি জালিয়াতি করে প্রমাণ প্রতিস্থাপন করার। অন্যান্য সেশন কোর্টও বিগত কয়েক মাসে একই ধরনের পর্যবেক্ষণ বারবার ব্যক্ত করেছে। দিল্লি পুলিশের দাঙ্গা-তদন্তকে এরকম ধিক্কার সহ অভিযুক্ত করা অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় যাদের “তদন্ত” আসলে দাঙ্গার হিংসা ও অবিচারকেই অন্য কায়দায় চালিয়ে যাওয়ার নামান্তর।
নির্দিষ্ট এই মামলাটির ক্ষেত্রে অ্যাডিশনাল সেশন জাজ জামিন মঞ্জুর করতে পারলেন কারণ তিনি তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখে চরম গরমিল ও দুর্বলতা পেয়েছেন। কিন্তু যদি এটি ইউএপিএ মামলা হত তাহলে বিচারক কেবলমাত্র অভিযোগগুলিই দেখতে পেতেন, তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখার এক্তিয়ার তাঁর থাকত না। এই একই বিচারক, এএসজে বিনোদ যাদব, উমর খলিদকে এপ্রিল ২০২১-এ জামিন দিয়ে বলেছিলেন, “এই মামলায় এই ধরনের ভাসাভাসা ম্যাটেরিয়ালের ভিত্তিতে আবেদনকারিকে কারাগারে আটকে রাখা চলে না”। তবুও উমর কারাগারে আছেন কারণ দিল্লি পুলিশ তাদের পক্ষপাতদুষ্ট ও হীন তদন্তকার্যের আড়াল হিসেবে ইউএপিএ ব্যবহার করেছে।
দিল্লি পুলিশের তদন্তকার্য এক হীন ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিইবা হতে পারত? ২০২০-র ফ্রেব্রুয়ারিতে যখন দিল্লীর বুকে মুসলমান-বিরোধী নিষ্ঠুর হত্যালীলা চলছিল তখনই দিল্লী হাইকোর্টের বিচারক মুরলীধর দিল্লী পুলিশকে চেপে ধরেছিল বিভিন্ন বিজেপি নেতাদের হিংস্র উসকানির বিষয়ে না জানার ভাণ করায়। তিনি মিশ্র, ঠাকুর ও এমএলএ অভয় বর্মা (যারা “গোলি মারো শালোকো” বলে ভিড়কে নেতৃত্ব দিচ্ছিল) এবং পরবেশ বর্মার (যে শাহিনবাগের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদিদের ‘রেপিস্ট ও মার্ডারার’ বলেছিল) বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ আদালতে চালাতে বলেছিলেন যেহেতু পুলিশ দাবি করেছিল যে তারা সেগুলো দেখেনি ও জানে না। হিংসা থামাতে তিনি ওইসব অপরাধিদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়ার দিকেও এগোচ্ছিলেন, কিন্তু সলিসিটর জেনেরাল তুষার মেহতা বলে দেন “যথা সময়ে এফআইআর করা হবে” (কপিল মিশ্র ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে)। বিচারক মুরলীধর প্রশ্ন করেছিলেন, “কোনটা যথাযথ সময়? নগর জ্বলে শেষ হয়ে যাওয়ার পর?” কিন্তু ওই সময়ই বিচারক মুরলীধরের বদলির অর্ডার নামিয়ে আনা হল এবং চলমান দাঙ্গা থামানোর সকল দায়িত্ব-কর্তব্যও বুঝিবা তার সাথে সাথে দিল্লী হাইকোর্ট চত্বর থেকে বিদায় নিল।
সেশন কোর্টের রায় উন্মোচিত করে দিয়েছে পুলিশ/স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের “টুলকিট” : সুপরিচিত বিজেপি নেতারা যে উসকানি দিয়ে ভিড় জমিয়ে দাঙ্গাকারিদের নেতৃত্ব দিয়েছিল তার অজস্র জাজ্বল্যমান তথ্যপ্রমাণ থাকলেও তা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখো; নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসাতে প্রমাণ ঢুকিয়ে দাও, সাক্ষী সাজাও; তারপর ইউএপিএ ব্যবহার করে আদালতকে সেইসব তথ্যপ্রমাণের প্রকট গরমিল যাচাই করা থেকে দূরে রাখো এবং সেই নিরপরাধ ব্যক্তিদের ছাড়া পাওয়া বন্ধ করো; এবং শেষে, নতুন নতুন অনুপূরক চার্জশীট পেশ করে যাও যাতে বিচার ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকে।
এখন যখন আদালতগুলি দিল্লী পুলিশের “দাঙ্গা তদন্ত”-কে সুস্পষ্ট ভাষায় অভিহিত করেছে প্রতিবাদকে “সন্ত্রাসবাদ”-এর সমান করে দেওয়ার এবং সময় নষ্ট করার অপচেষ্টা হিসেবে, তখন এই অবিচারের অন্ত ঘটাতে, গ্রেপ্তার হওয়া বন্দিদের মুক্ত করতে এবং দাঙ্গার তদন্তকাজ আদালতের তত্ত্বাবধানে চালাতে বিচার বিভাগের উচ্চতর স্তর থেকে হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
(এম এল আপডেট, সম্পাদকীয়, ১৪ সেপ্টেম্বর' ২১)