অধিকাংশ বড়-বড় সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল মোদী সরকারের তাঁবেদার বনে গিয়ে তার প্রচার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর গুণকীর্তনই তাদের কাজ। কিন্তু সংখ্যায় অল্প হলেও যে সমস্ত সংবাদমাধ্যম নিজেদের স্বাধীন সত্তাকে ধরে রাখে, ক্ষমতার মুখের ওপর সত্যি কথাটা বলে, সরকারের সমালোচনা করে, তাদের কি চোখে দেখে মোদী সরকার? সরকার তাদের শত্রু জ্ঞান করে এবং বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাকে লেলিয়ে দিয়ে যে ভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা হয়, এদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। এর আগে কখনও এন ডি টিভি-র বিরুদ্ধে সরকারকে খড়্গহস্ত হতে দেখেছি। এ বছরের জুলাই মাসের ২২ তারিখে হিন্দি সংবাদপত্র দৈনিক ভাস্কর এবং টিভি চ্যানেল ভারত সমাচার-এর বিভিন্ন অফিস ও কর্মকর্তাদের বাড়িতে আয়কর দপ্তরকে হানা দিতে দেখেছি। তাদের অপরাধ ছিল--কোভিড মোকাবিলায় মোদী সরকার এপ্রিল ও মে মাসে যে চরম অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছিল, সে সম্পর্কে বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন ঘটিয়ে একগুচ্ছ প্রতিবেদন প্রকাশ করা। দৈনিক ভাস্কর-এর ওয়েবসাইটের পাতায় লেখা ছিল, “গঙ্গায় মৃতদেহ ফেলাই হোক … করোনায় মৃতের সংখ্যাকে লুকোনোই হোক, ভাস্কর নির্ভীক সাংবাদিকতার স্বাক্ষর রেখেছে।” তাদের ভয় দেখাতে, সরকারের তাঁবেদার হওয়ার বার্তা দিতেই যে আয়কর দপ্তরকে পাঠানো হয়েছিল তা বোধকরি কেউই অস্বীকার করবেন না। অতি সম্প্রতি আবার দুটো অনলাইন নিউজ পোর্টাল, নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির দপ্তরে হানা দিতে দেখা গেল আয়কর দপ্তরকে। প্রসঙ্গত, তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার নিয়ে বড়-বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর নীরবতার বিপরীতে নিউজক্লিক যেমন গুরুত্ব দিয়ে কৃষক আন্দোলনের খবর প্রচার করেছে, তেমনি বড় আকারের কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়েও প্রতিবেদন বার করেছে। আর নিউজলন্ড্রির কাজ সম্পর্কে সংস্থার এক কর্মীর মন্তব্য এই রকম — “এই সরকার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে দিয়েই টিকে থাকে। নিউজলন্ড্রি এই নিয়ন্ত্রণটাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। মূল ধারার মিডিয়ার ভাষ্যে ছিদ্র বার করছে।” অর্থাৎ, মোসাহেবি মিডিয়া সরকারের কেমন তাঁবেদারি করছে, সেটার উন্মোচনই তাদের কাজ। এই ধরনের মিডিয়ার ওপর মোদী সরকার কি সদয় হতে পারে?
গত ১০ সেপ্টেম্বর নিউজ পোর্টাল দুটোর দপ্তরে আয়কর বিভাগের অফিসার ও কর্মীরা হানা দেন। সকাল ১১.৩০টা থেকে শুরু করে বারো ঘন্টারও বেশি আয়কর বিভাগের কর্মীদের অনুসন্ধান চালে। আয়কর দপ্তরের কমিশনার জানিয়েছেন, দুটো পোর্টালে তাঁদের কাজ ছিল ‘সার্ভে’র, কোনো রেইড করতে বা হানাদারি/তল্লাশি চালাতে তাঁরা যাননি। ‘সার্ভে’ আর ‘রেইড’-এর মধ্যে ফারাক হল এই যে, ‘সার্ভে’ হলে কোনো নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা যায় না, ‘রেইড’-এর ক্ষেত্রে তাতে কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু নিউজলন্ড্রির প্রধান কর্মকর্তা অভিনন্দন শেখরি জানিয়েছেন, “আমার নিজের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও অফিসের গোটা দুই মেশিনকে আয়কর দপ্তরের কর্মীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেগুলো থেকে সমস্ত তথ্য ডাউনলোড করে নিয়েছিল।” এর সঙ্গে তল্লাশি ও নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করার ফারাক কোথায় থাকছে? দুই পোর্টালে হানাদারির পর এডিটর্স গিল্ড আয়কর দপ্তরের এই কর্মকাণ্ডকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছে, এটা হল “সরকারি সংস্থাগুলোর স্বাধীন মিডিয়াকে হেনস্থা করা ও ভয় দেখানোর একটা বিপজ্জনক প্রবণতা।” গুজরাটের বিধায়ক জিগনেশ মেভানিও নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করে বলেছেন, “গতকাল রূপাণী সরকারের জনবিরোধী নীতির প্রবল সমালোচক ভি টিভি গুজরাটির অফিসে হানাদারি চালানোর পর মোদী সরকার আজ নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রিকে নিশানা বানালো। হুমকিবাজির কৌশল ফিরে এসেছে! নরেন্দ্র মোদী, কিসের জন্য আপনার এত ভয়?”
নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির ওপর মোদী সরকার যে এই প্রথম হামলা চালালো এমন নয়। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট পাঁচদিন ধরে নিউজক্লিক-এর অফিসে এবং কর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। সে সময় প্রচুর ব্যাঙ্কের নথিপত্র, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, কর্মীদের ই-মেইলে থাকা তথ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়। জুলাই মাসেও আয়কর বিভাগের অফিসাররা কর ফাঁকির অভিযোগের নামে নিউজক্লিক-এর প্রধান সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে পাঁচ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। এবারের হানাদারির পর প্রবীর পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, “গতকালের হানাদারি সেই একই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ সম্পর্কে বলেই মনে হয়, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট এবং দিল্লী পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখা যার তদন্ত চালাচ্ছে।” দিল্লী পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধের তদন্ত শাখা নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগের কারণে তদন্ত চালাচ্ছে তা হল — নিউজক্লিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সচল না থাকা একটা সংস্থা থেকে ৯.৫৯ কোটি টাকা নিয়েছিল এবং তার জন্য নাকি প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বিধির লঙ্ঘন হয়েছিল। যে সংস্থা থেকে ঐ অর্থ নেওয়া হয়েছিল সেটি হল ওয়ার্ল্ডওয়াইড মিডিয়া হোল্ডিংস এলএলসি। কিন্তু এই অভিযোগ কতটা সত্যি? নিউজক্লিক জানিয়েছে, ২০১৯ সালে এফ ডি আই-এর ক্ষেত্রে যে নতুন বিধি তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে দিয়ে ডিজিটাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে এফডিআই-এর সর্বোচ্চ মাত্রা ২৬ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছিল, সেটা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। কেননা, এই অর্থ তারা পেয়েছিল ২০১৮ সালে, নতুন ঐ বিধি তৈরি হওয়ার আগেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কও জানিয়েছে, নিউজক্লিক বিদেশী মুদ্রা পরিচালন আইন-এর বিধি ভঙ্গ করেনি। এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট এবং দিল্লী পুলিশ নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে আপাতত কোনো দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না – দিল্লী হাইকোর্টের এমন নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আয়কর দপ্তরকে দিয়ে নিউজপোর্টাল দুটোয় হানাদারি চালানোটা কি মোদী সরকারের প্রতিহিংসার পরিচায়ক নয়?
সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতা ও সমালোচনাকে স্তব্ধ ও দমন করতে মোদী সরকার বিরোধীদের ওপর হামলা নামিয়েছে, সমাজ আন্দোলনের ও মানবাধিকার কর্মীদের জেলে পুরেছে। একইভাবে সরকারের নীতির সমালোচক, হিন্দুত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা সাংবাদিকদেরও মোদী জমানায় বারবার আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই শঙ্কাজনক পরিস্থিতির জন্যই রিপোটার্স উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স-এর তৈরি করা ২০২১-এর রিপোর্টৈ ভারতকে সাংবাদিকদের জন্য “পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক দেশগুলোর একটা” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। রিপোটার্স উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স একটা ফরাসি এনজিও এবং প্রতি বছরই তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচক তৈরি করে তার ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলোর অবস্থান নির্ধারিত করে থাকে। তাদের ২০২১-এর রিপোর্টে ১৮০টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১৪২তম। অবস্থান এত নীচে হওয়ার জন্য রিপোর্টে যে কারণগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে তার কয়েকটা হল — (১) নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর কবজাকে শক্তিশালী করে তুলেছেন। (২) ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পর “হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের লাইন গ্ৰহণে বাধ্য হতে সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে।” (৩) সাংবাদিকদের সমস্ত ধরনের আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি হিংসা, রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতে অতর্কিত আক্রমণ এবং অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী বা স্থানীয় স্তরে দুর্নীতিপরায়ণ কর্তাদের দ্বারা প্রতিশোধ গ্ৰহণ।” (৪) কোনো-কোনো সাংবাদিক এমন কিছু বলেন বা লেখেন যেগুলো “হিন্দুত্ত্ব অনুগামীদের অসন্তুষ্ট করে”। তারা তখন সমাজমাধ্যমগুলোতে ঐ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে “ঘৃণার অভিযান” নামায় যাতে “সাংবাদিকদের হত্যা করার আহ্বানও থাকে।” (৫) কাশ্মীরে সংবাদমাধ্যমের অবস্থা “অত্যন্ত উদ্বেগজনক”। সেখানে সাংবাদিকদের “পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনীর হয়রানির” মুখে পড়তে হয়, কোনো-কোনো সংবাদপত্র এমনকি বন্ধ করে দিতেও হয়, যেমনটা ঘটেছে কাশ্মীর টাইমস-এর ক্ষেত্রে। (৬) সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো যেখানে সরকারের হয়ে প্রচার চালায়, এর বিপরীতে যে সমস্ত সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করার সাহস দেখায়, “শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থকরা” তাদের “রাষ্ট্র-বিরোধী”, “দেশদ্রোহী” এবং এমনকি “সন্ত্রাবাদী সমর্থক” বলে ছাপ মারে।
রিপোর্টটা ফরাসি এন জি ও-র তৈরি হলেও তাতে ভারতের সংবাদ জগতে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে এবং সরকারের সমালোচক সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা মোদী জমানায় কতটা বিপন্ন হয়ে পড়েছেন রিপোর্টে তাও অভ্রান্তভাবে ধরা পড়েছে। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ নিয়ে করা একটা সমীক্ষা জানিয়েছে — ২০২০ সালে সাংবাদিকতার কাজ করতে গিয়ে চারজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ৬৬ জন সাংবাদিককে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে এবং প্রায় ২০০ জন সাংবাদিক দৈহিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এমনকি পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে যাদের ওপর নজরদারি চালানো হয়েছে তাদের মধ্যে সরকারের অপছন্দের কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন। কখনও এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট, কখনও দিল্লী পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্তের শাখা, কখনও বা আয়কর দপ্তরকে দিয়ে নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির ওপর হামলাবাজি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরই আক্রমণ, সংবাদমাধ্যমকে সরকারের অনুগামী করে তোলার লক্ষ্যে নির্ভেজাল হুমকিবাজিরই আশ্রয়। মিডিয়ার স্বাধীনতা ও প্রাণবন্ততা ফ্যাসিবাদের কাছে প্রতিবন্ধকতা হয়েই দেখা দেয়। আর তাই মোদী সরকার ও সংঘ বশ না মানা মিডিয়াকে বশংবদ করে তুলতে লাগাতার হামলার অভিযান চালায়। তবে, শত দমন সত্ত্বেও প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে যেমন নিঃশেষ করা যায় না, একইভাবে কর্পোরেট মালিকানাধীন গোডি মিডিয়ার ব্যাপক অস্তিত্ব সত্ত্বেও বিকল্প, স্বাধীন মিডিয়া নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলে। নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির মতো মিডিয়া সরকারের নীতিহীনতা ও ভ্রষ্টাচার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার তাদের কাজ করে যায়।