২০১৯-এ ৩০৩টি আসন দখল করে মোদী-অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার দেশবাসীর উপর ব্যাপক সন্ত্রাস নামিয়ে আনে — কাশ্মীরের জনগণের দীর্ঘদিনের অধিকার ৩৭০ ধারা বিলোপ করে গোটা কাশ্মীরকে কারাগারে পরিণত করা, সিএএ সংশোধনী-২০১৯ এনে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব বিভাজনকে আইনি রূপ দিয়ে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রটাই পাল্টে দেওয়া, বনবাসী আইন ২০০৬-কে খর্ব করা, এনএসএ ও ইউএপিএ আইন সংশোধন করে আরো হিংস্র করা, পুলিশের স্বৈরাচারী ক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি। এরপরই আমরা দেখলাম ৪৪টি শ্রম আইনকে ৪টি শ্রমকোডে রূপান্তরিত করে এযাবতকালের লড়াইয়ে অর্জিত শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারগুলি কার্যত কেড়ে নেওয়া হলো। আর লকডাউন পিরিয়ডেই জারি করা হল তিনটি কৃষি বিল নিয়ে অর্ডিন্যান্স। ফুঁসে উঠলো পাঞ্জাবের কৃষকরা। হরিয়ানার কৃষকরাও তাতে যোগ দিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো। সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে নভেম্বর মাসে বিল তিনটিকে আইনে রূপান্তর করা হলো। শুধু এটুকুই নয়, লকডাউন পিরিয়ডে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অমানবিক আচরণ করা হলো। এর সাথে দেখা গেলো ধর্ষকদের নিয়ে বিজেপি-আরএসএস মিছিল করছে। স্তম্ভিত হলো গোটা দেশ। মানুষ কি খাবে কি পরবে তা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আদেশ জারি করা হলো। গো-মাংস রাখার অজুহাতে পিটিয়ে খুন করা হলো। এবং প্রতিবাদ করার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে আটক করা শুরু হল। এর পাশাপাশি বিদ্বেষ বিভাজনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো। করোনার বৃদ্ধির জন্য দায়ী মুসলমানেরা – এই প্রচার ছড়িয়ে দেওয়া হলো। তবলিগি জমায়েতকে দায়ী করে এই কাজ শুরু হলো। এই সময়ে আমরা দেখলাম একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে আগ্রাসী অংশ সরকারের সহযোগিতায় বিপুল মুনাফা করছে। একদিকে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছে, অপরদিকে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির মুনাফা বেড়েই চলছে। এককথায় গোটা দেশে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।
আমাদের দেশে শাসকদের বিভিন্ন দল আছে আবার শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী বিভিন্ন দল আছে। কিন্তু তারা কেউই ফ্যাসিস্ট দল নয়। ফ্যাসিস্ট দল তাদেরই বলা হয় যাদের ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী থাকে। ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলন চালিয়ে যারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। এবং রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান এরা কব্জা করতে চায়। মুসোলিনি এদের আদর্শ হয়। আরো একটা বিষয় বোঝা প্রয়োজন। ফ্যাসিস্ট শক্তির সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ থাকে। আমাদের দেশে একমাত্র আরএসএস বিজেপির এরকম ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী আছে। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান গঠনের নামে একনায়কতন্ত্র হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এর জন্য একটি কল্পিত শত্রু খাড়া করে, এক্ষেত্রে যা মুসলিম সমাজ, তার বিরুদ্ধে সব অর্থেই যুদ্ধ ঘোষণা করে। যেমন হিটলারের নেতৃত্বে নাজীরা ইহুদিদের শত্রু খাড়া করে একাজ করেছিল। সমাজবিকাশের পরিপন্থী সব পিছিয়ে পড়া ভাবনাকে জনমানসে ছড়িয়ে দেয়। বিরোধী সব কণ্ঠকে জোর করে বন্ধ করে দেয়। নিজেদের স্বার্থর জন্য এমন হীন কাজ নেই, যা ওরা করেনা। উদাহরণ, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা, ২০০২ সালে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমান হত্যা। আর, একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষার জন্য সমস্ত পন্থা নেয়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন বেশ কিছু রাজনৈতিক শক্তি আছে যারা শাসক শ্রেণীর সব দলকেই ফ্যাসিস্ট দল বলে। তারা বোঝে না স্বৈরাচারী শাসন মানেই ফ্যাসিবাদী নয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদে স্বৈরাচারী শাসনের সাথে ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী থাকে। যেমন সিপিএমের শাসনকালে আমরা স্বৈরাচারী আক্রমণ দেখেছি, কিন্তু সিপিএমের ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী নেই। একই কথা তৃণমূল দল সম্পর্কেও প্রযোজ্য। একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার আমাদের দেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি বলতে একমাত্র আরএসএস-বিজেপিকেই আমরা চিহ্নিত করি।
এই প্রেক্ষিতেই আমরা বিচার করবো বাংলার নির্বাচনকে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচারাভিযানের প্রাসঙ্গিকতা। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ১০ শতাংশ ভোট পায়। ৩টে বিধানসভাতে জয়লাভ করে। কিন্তু ২০১৯ লোকসভা ভোটে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটপেয়ে ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। অভূতপূর্ব ভাবে শক্তি বাড়ে। তারপরই বাংলা দখলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে ওরা। বস্তুত বাংলায় ক্ষমতায় না আসলে তাদের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিজয়রথ আটকে যাবে। তাই বিগত কয়েক মাসে ঘৃণা, কুৎসা ও মিথ্যার রাজনীতিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। সঙ্ঘপরিবার এটা বুঝতে পারে যে বাংলার রাজনীতি, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে তাদের কাজকর্ম খাপ খায় না। তাই চাকাটা উল্টো দিকে ঘোরানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বিদ্বেষ বিভাজনের মতাদর্শ ও রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এককথায় সারা দেশের সঙ্ঘপরিবারের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে এই রাজ্যের ভোটের গুরুত্ব অনুভূত হয়।
মতাদর্শ ও রাজনীতিতে যারা অগ্রণী সেই কমিউনিস্টদের যদি সেইভাবে শক্তি থাকতো তাহলে তারা তুল্যমূল্য লড়াই দিতে পারতো যার উপর ভিত্তি করে শ্রমিক শ্রেণী সহ মেহনতি সমাজ ফ্যাসিস্ট হামলার বিরুদ্ধে পথে নামতো। কিন্তু গোটা দেশ সহ রাজ্যে সেই পরিস্থিতি নেই। আবার, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সব ধরনের বামেদের শক্তি ক্ষয় হয়ে চলেছে। কিন্তু একটা ইতিবাচক জায়গা সমাজে গুরুত্ব পায়। সেটা হলো বাম, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো মতামত বা কাজ করলে সমাজে সেটা গুরুত্ব পায়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে হোক কলরব বা সাম্প্রতিককালের ভাঙ্গর, এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন সেই তাৎপর্য বহন করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরের মানুষজন বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, ছাত্রছাত্রী ও মহিলাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান বেশ তীব্র। এরা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমে লড়াই করতে প্রস্তুত। নভেম্বরে বিহারের নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী জোটের লড়াই গণআন্দোলনের রূপ নেয় এবং তার ফলাফল এরাজ্যের জন্যও অনুপ্রেরণা জোগায়, পশ্চিমবাংলাতেও বিজেপিই প্রধান শত্রু – এই দৃঢ় ঘোষণা প্রত্যয় জাগায়। এই অবস্থায় আমরা কয়েকজন উদ্যোগি হই এরাজ্যে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী সংগঠন, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কথাবার্তার ভিত্তিতে। আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায় ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই কি ভাবে হবে এবং নির্বাচনী সংগ্রামে আমাদের অবস্থান কি হবে তা বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে আলোচনা করে স্থির হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চ গড়া হবে। যেখান থেকে জনগণের কাছে ফ্যাসিস্ট শক্তির স্বরূপ উন্মোচন করা হবে। অর্থাৎ জনগণকে ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রভাব মুক্ত করার লাগাতার প্রয়াস নেওয়া হবে। অপরদিকে যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় আসতে চাইছে, তাদের নির্বাচনে হারানোরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কথা ওঠে ফ্যাসিবাদকে কি নির্বাচনের মাধ্যমে পরাস্ত করা যায়? আলোচনাতে স্থির হয় বাংলার নির্বাচনে হারলে ফ্যাসিস্ট শক্তির আগ্রাসন সাময়িকভাবে হলেও প্রতিহত হবে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী গনআন্দোলন বেগবান হবে।
সঙ্ঘপরিবার যেহেতু বিদ্বেষ বিভাজনের মেরুকরণ করাতে চাইছে তাই তার বিরুদ্ধে ‘বিজেপি বনাম না-বিজেপি’ এই মেরুকরণ করাতে হবে। এই রাজ্যে কাজটা কঠিন ছিল। কারন এখানে রাজ্য সরকারে বিজেপি কোনোদিন ছিল না। কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ শ্রমকোড, কৃষিআইন থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প বেচা, চরম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, এনআরসির নামে লাখ লাখ মানুষকে না মানুষ করা, বিদ্বেষ বিভাজনকে বাড়িয়ে তোলা, নারীসমাজ সম্পর্কে কুৎসিত অবস্থান, ঘৃণা-ভয়-চোখরাঙানি দিয়ে বিরুদ্ধ মতকে আক্রমণ করা, মিথ্যা ভাষণ অনর্গল বলে যাওয়া, উগ্র জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে যে কাজ সঙ্ঘপরিবার করছে তাকে এ রাজ্যের বহু মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। তৃণমূলের শাসনকাল, কিংবা ৩৪ বছরের বাম শাসন নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন মানতে পারছিলেন না। সুতরাং এখান থেকেই ‘নো ভোট টু বিজেপি’ শ্লোগান স্থির হয়। আরো স্থির হয় শুধু বিজেপিকে নয়, আরএসএসের বিরুদ্ধেও প্রচার করতে হবে। যেখান থেকে সংগঠনের নাম হয় ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’।
আমরা বলি, বিজেপিকে ভোট দেবেন না। আবার সঙ্ঘপরিবারের মতাদর্শ ও রাজনীতির স্বরূপও তুলে ধরি।
এই বক্তব্য নিয়ে প্রচার শুরুর সাথে সাথে বহু মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র প্রচার শুরু করেন। অসংখ্য মানুষের সাথে তরুণ-তরুণী ছাত্র ছাত্রীরা প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা একটা গণ আন্দোলনের রূপ পায়। এর মানে এটা নয় যে আমরাই করেছি। এর মানে হলো আমরা যে বক্তব্য রেখেছি তা বহু মানুষের মননে প্রবেশ করে। এটা একটা শক্তি হয়ে ওঠে। আমরা যোগসূত্র তৈরি করেছি।
আজ বিজেপি ভোটে পর্যুদস্ত। বিজেপি কি শুধু ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র জন্য পরাজিত হলো? না এটা ঠিক নয়। অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারনের সাথে এটাকেও যুক্ত করতে হবে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে বিজেপি এ রাজ্যে ২ কোটির বেশি ভোট পেয়েছে। সুতরাং লড়াই অনেক বাকি আছে। সবশেষে যে কথা না লিখলেই নয়। দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলন এই কাজটাকে অনেক ত্বরান্বিত করেছে। যেভাবে তারা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচার করেছে সেটা আমাদের গোটা কাজকে অনেক অনেক শক্তি যুগিয়েছে। আমরা আরো দৃঢ় ভাবে কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াবো। শুধু এটাই নয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদী মানুষকে নিয়ে লড়াই চলবে। একমাত্র বাংলাতে নয়। গোটা দেশেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই লড়াই চলবে।
– কুশল দেবনাথ