তখন বছর ছয় সাত হবে। আমাদের বাড়ির পাশে বিনয় কাকুদের বাড়িতে বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে একজন ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা আসতেন। ভদ্রলোক পাজামা পাঞ্জাবি পড়া মাঝারি হাইটের।
বেশ কিছু বছর পরে শুনেছিলাম ওনারা ‘নকশাল’ করেন। সম্পর্কে বিনয় কাকুদের কাকা কাকিমা। তারপর বিভিন্ন কারণে অনুষ্ঠান কমতে থাকলো। ওনাদের আসা যাওয়া অনিয়মিত হয়ে গেলো কি? জানিনা ঐ সময়ে জানার যে বিশেষ তাগিদ অনুভব করেছিলাম তাও না। পড়াশোনা, বন্ধু, ক্রিকেট, আড্ডা নিয়ে দিব্যি ছিলাম। উচ্চমাধ্যমিকের পরে কলেজে স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্রের পতাকায় তখন বিকল্প দিনের ভাবনা। বিপ্লবের হাতছানি! নকশালবাড়ি সম্পর্কে বই তখন নিজের আগ্রহেই সংগ্রহ করতে শুরু করেছি। ২০০৭ নন্দীগ্রামের ঘটনায় কেমন যেন সব নড়ে উঠলো। ততদিনে অবশ্য ভোটে দাঁড়িয়েছি সিআর হওয়ার তীব্র ইচ্ছাশক্তি তখনও খানিক বাকি ছিলো বোধহয়। তারপর একদা এসএফআই নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ, যুক্তি পাল্টা যুক্তির কলেজ গেট পেরিয়ে যখন সত্যি বিকল্প খুঁজছি। কমরেড কৃষ্ণ তখন রাতদিন এসএমএস করে আমাকে ভাবনার রসদ যোগাচ্ছে। কমরেড প্রদীপণ কখনও এপিডিআর কখনও পার্টি পত্রিকার পুরোনো নতুন সংস্করণে আমার সঙ্গের ব্যাগটি ওজন সামান্য হলেও বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। বাড়িতে সকলে সিপিএম’র সদস্য। আমিও তো এই পর্যন্ত পাড়ায়, পথসভায়, মিছিলে প্ল্যাকার্ড, পতাকাগুলা সামলেছি। তাহলে আমি কি বাড়িতে না জানিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। লড়াইটা জারী রাখবো লাল পতাকাটাও থাকবে তবে ছোটো থেকে যা বোঝানো হয়েছে, এতদিন যা আলটিমেট বলে জানতাম, সেই বৃত্তের বাইরে বেড়িয়েই ভাববো যা ভাবার। বেশ কিছুদিন ধরে পার্টি অফিসে যেতে শুরু করেছি। ২০১২-র ফেব্রুয়ারীর কোনো একদিন সকালবেলা হঠাৎই ফোন
আমি বিনয়ের কাকা বলছি, তুমি শাশ্বতী?
হ্যাঁ কিন্তু?
আমি অপু চতুর্বেদী।
ও আচ্ছা, আমি তোমার কথা শুনেছি।
একটু কথা বলতাম তোমার সাথে।
হ্যাঁ বলুন,
না ফোনে হবে না,
তবে?
অমুক দিন, (এত বছরে ডেট আর মনে নেই) ফকটচাঁদ প্রাইমারি স্কুলে ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি লোকাল কমিটির সম্মেলন আছে তুমি চলে এসো।
কিন্তু আমি,
এসো কিছু হবে না আমি বলছি।
সেই শুরু। অপুদার জন্যই সেইদিনই মেম্বারসিপের ফর্মফিলাপ করেছিলাম। প্রথম যেদিন ডাবগ্রামে অপুদার ভাড়া বাড়ির কাঠের ঘরটায় গিয়েছিলাম অনেক টুকরো টুকরো কথা শিলিগুড়ি বিভিন্ন জায়গায় সত্তরের দশকের গল্প, রাস্তার পাশে দেয়াল দেয়ালে স্টেনসিলে মাওয়ের মুখ, এক শেল্টার থেকে আরেক শেল্টার। অপুদার জেলে থাকার গল্প শুনতে শুনতে বারংবার শিহরিত হচ্ছিলাম।
সেদিন কত কি জানতে চেয়েছিলাম। হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছিলেন। উত্তর দিতে দিতে কখনও সামান্য উত্তেজিত হচ্ছেন, থামছেন আবার বলছেন।
এভাবেই দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়েছিল সেদিন। মুক্তির দশকের আবহমান উত্তাপের আঁচ কি সেদিন খুঁজেছিলাম আমি অপুদার মুখে, হয়তো! সবশেষে অপুদা টেবিলের ড্রয়ার খুলে কাপড়ে মোড়ানো দুটো বই বার করে আমার হাতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন পড়ে ফেরত দিও কিন্তু সেই যে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের দিনগুলোর অন্যতম ভালোলাগা সঙ্গে নিয়ে চলা ‘রেডবুক’ তখন আমার হাতে, সঙ্গে জলার্কের চারু মজুমদার সংখ্যা-১। অপুদার কাছে শুনেছি সেকেন্ড সিসি করার সময়ের অভিজ্ঞতা। সঙ্গে থেকে দেখেছি নকশালবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি গ্রামে গঞ্জে সত্তরের সময় থেকে এ সময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে ওনার সখ্যতা। কমরেড চারু মজুমদার সম্পর্কে বলতে শুরু করলে থামতেই ভুলে যেতেন। জমির পাট্টা থেকে রাস্তা, ড্রেন, সংস্কার, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ডাবগ্রাম ফুলবাড়ির সম্পাদক কমরেড অপু চতুর্বেদী মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে শ্লোগান দিতেন অক্লান্ত। মনে পড়ছে শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির শুরুর দিনগুলির কথা। প্রায় শূন্য থেকে আরম্ভ হওয়া একটি স্বপ্নের সময়ে কখনও ঘন্টাখানেক ফোনে কখনও ভর দুপুরে বাড়িতে এসে উৎসাহ দিয়ে গেছেন; হবে হবে ঠিক হবে লেগে থাকো। মতানৈক্য হয়েছে বারবার। তবুও তা, টেঁকেনি বেশিদিন। কেউ একজন আবার স্বাভাবিকভাবে কথা বলে ফেলেছি সব ভুলে। পার্টি অফিসের মাথার ওপর নতুন টিন, নতুন দরজা জানালা নিয়ে বর্তমানের খানিক নতুন চেহারা, তা তো অপুদাই দাঁড়িয়ে থেকে করালেন। এই তো সেদিনও পার্টি অফিসে অপুদা যখন শানুদার দোকানে চায়ের অর্ডার দিতে যাচ্ছেন বললাম খিদে পেয়েছে শুধু চায়ে হবেনা। হাসিমুখে কেক বিস্কুট এনে হাজির করলেন। গত মাসের ২৬ তারিখ সুমন্তি’র নমিনেশনের দিন বাইরে আমাদের পেটে তখন ইঁদুর লম্বা লম্বা লাফ দিচ্ছে। বসেছিলাম একজায়গায়। দেখি অপুদারা কি যেন খাচ্ছেন, বললাম এটা কি হলো? সঙ্গে সঙ্গে শশা মেখে নিয়ে এলেন। মিছিলে বা রাস্তায় কোনো উঁচু জায়গাতে ঠিক এসে সহযোদ্ধার হাতটা বাড়াতেন। এই তো ৮ এপ্রিল ফাঁসিদেওয়াতে সুমন্তি’র সমর্থনে রোড-শোতে একসাথে বসে খেলাম কমরেড – গল্প হলো – শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে নিয়ে চললেন লড়াইয়ের গাড়ি। মিছিল এগিয়ে চলেছিল শ্লোগানে শ্লোগানে আপনাদের লড়াইয়ের নির্যাসটুকুকে সঙ্গে করে। চেনা রাস্তা আলপথ পেরিয়ে পৌঁছে তো গেছিলাম কমরেড আমরা – আর একটু লড়াই যে খুব দরকার ছিলো কমরেড। আপনি বলেছিলেন তিনটে দিন সবসময় মনে রেখো আটাশ জুলাই বাইশ এপ্রিল ঊনিশ মার্চ। ভুলিনি কমরেড কিন্তু ‘সাতাশ এপ্রিল ২০২১’ তারিখটাও এভাবে মনে গেঁথে দিয়ে গেলেন অপুদা – ঠিক হলো না – ঠিক …!
লড়াইটা জারি থাকবে কমরেড আপনার দেখানো পথেই।
লাল সেলাম কমরেড অপু চতুর্বেদী।।
কমরেড অপু চতুর্বেদী অমর রহে।।
- শাশ্বতী সেনগুপ্ত