নতুন পরিস্থিতি, চাই নতুন উদ্যোগ
New situation

অবশেষে ফ্যাসিবাদী বিজেপির বাংলা দখলের অভিযান রুখে দেওয়া গেল। এটাই এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনী ফলাফলের সবচেয়ে বড় খবর। এটা শুধুমাত্র বাংলার জন্য শুভ তা নয়, সারা দেশের জন্যও একটা বার্তা। বুঝিয়ে দিল তেমনভাবে লড়তে পারলে বিজেপিকে রুখে দেওয়া যায়। তবে তা মোটেই সহজ ছিল না। রাজনৈতিক লড়াই হয়েছে প্রতি পদে পদে। মোদী-অমিত শাহদের অনুকূলে কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছিল। একদিকে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, অন্যদিকে বিরোধী দল হিসাবে বিশেষত সিপিএম ও কংগ্রেসের ক্রমাগত রাজনৈতিক-নৈতিক অধঃপতন বিজেপিকে গত দু’বছর যাবৎ ক্রমাগত জমি পেতে পরোক্ষে সহায়তা জুগিয়ে এসেছে। এছাড়া আড়াল থেকে মানুষের মগজ ধোলাইয়ের আরএসএস-এর কাজের ধারা বাড়তি সুবিধা করে দেয়। বিজেপির চাপানো ইস্যুগুলো সহজে উড়িয়ে দেওয়ার ছিল না। বিদ্বেষ-বিভাজনের মেরুকরণের রাজনীতির হামলা নামিয়েছিল বেশ সুকৌশলে। কিন্তু পরিণাম দেখিয়ে দিল তাকে ছাপিয়ে নির্দ্ধারক হয়ে ওঠে বিজেপিকে হারানোর যুক্তি, বুদ্ধি, শ্লোগান, জেদ, ভোটদান কৌশল; পাল্টা হাওয়ায় তাকে পর্যুদস্ত করে রুখে দেওয়ার অভিযানই জিতে গেল। একস্বরের একেশ্বর কায়েম করার সাধ মিটিয়ে দিল বহুস্বরের বাংলা।

বিধানসভায় বিরোধী দলের আসনে এবার নজর কাড়ছে নজিরবিহীন সমাপতন। বামফ্রন্টের দলগুলোর কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। সেই জায়গায় প্রবেশ ঘটছে বিজেপির, সংখ্যাটা হেলাফেলার নয়, শাসক দল তৃণূলের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। বিজেপিকে নির্বাচনে হারানো গেছে, এটা একটা সাফল্য ঠিকই, কিন্তু লড়াইটা দীর্ঘস্থায়ী চালিয়ে যাওয়ার দাবি রাখে। কেন্দ্র এবং সারা দেশ থেকে দূর করার প্রয়োজনে যেমন, তেমনি এখানেও লড়াই শুরু করতে হবে নতুন করে। ওরা বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, কিন্তু বিধানসভায় বিরোধীপক্ষের একচেটিয়া দখল পেয়ে গেল। ওদের হিন্দুত্বের ঘৃণার রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ফেলতে পেরেছে সামাজিক শক্তিগুলোর বিশাল পরিসরে, বিশেষত নিম্নশ্রেণী-নিম্নবর্ণের মধ্যে। সমাজে পদানত করে রাখা শক্তিগুলোর ভেতর থেকে আবার ব্যবহারের পদাতিক বানাচ্ছে উচ্চ শ্রেণীমুখী-বর্ণবাদী-ধর্মরাষ্ট্রবাদী একটা দল। ফলে নানা পরিচিতির গরিব ও মধ্যবিত্ত সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অচেনা সব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিস্থিতি। এইসব জট ছাড়ানোর কোনো সহজ-সরল সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। খুবই নিবিড় ও ব্যাপক বোঝাবুঝির নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। তবেই সম্ভব ওসব মাটি থেকে বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করার উপায়গুলো বার করা।

পরিস্থিতি একইসাথে দাবি করছে বাংলার বামপন্থীদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে গড়ার আত্মানুসন্ধান নতুন করে শুরু করতে হবে। আন্দোলনের বামপন্থার টুকরো-টাকরা চেষ্টা ছাড়া বামফ্রন্টের বড় শরিক দলটি গত দশ বছর খোঁজে থেকেছে কেবল কিভাবে সুড়ঙ্গের শেষে মসনদে পৌঁছানোর তালাশ পাওয়া যায়। তার জন্য বারবার হাত ধরেছে কংগ্রেসের, সেই মূঢ়ামীর প্রথম মাশুল গুণতে হয়েছিল ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে। এবারের নির্বাচনে সিপিএম নেয় আরও সুবিধাবাদী কৌশল। এক মুসলিম মৌলবাদী শক্তিকে মিত্র বলে চালিয়ে তিন পক্ষের ‘সংযুক্তমোর্চা’ বানিয়ে নামে ফাটকা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এবার মাশুল গুণতে হল জুয়ারীর সর্বস্ব হারিয়ে ঘরে ফেরার মতোই। সিপিএম-কংগ্রসের মাঝখান থেকে বিধানসভায় ঢুকে গেল ‘সেকুলার’ বুলি আউরানো আইএসএফ। একটি মাত্র আসনে। আর, সিপিএমের কাছে মসনদ রইল মরীচিকা হয়ে, বিরোধীপক্ষের আসন সব হয়ে গেল চৌপাট, বাম মান মর্যাদাও সবই গেল। যে নতুন প্রজন্ম এসেছে, দিশার সঠিকতা ধরতে পারলে, পর্যালোচনার একটু গভীরে ঢুকতে পারলে, তারা প্রত্যক্ষ করতে পারবে এবার নেতৃত্বের সুবিধাবাদ ও দেউলিয়াপনা পৌঁছেছে কোথায়। ফেটে পড়বে এলোপাথারি তর্ক-বিতর্ক। সঠিক নীতি-আদর্শ-চিন্তাচেতনা থাকলেও লড়ে ধাক্কা খেতে হতে পারে। তবু তার মধ্যেও একটা সার্থকতা থাকে এই যে, পঙ্গুত্ব গ্রাস করেনি। কিন্তু বাংলার এখনও আকারে বড় বাম দলটি সবদিক থেকে জড়বৎতন্ত্রের কেন্দ্র বনে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় পুরানো প্রথাগত বাম দলগুলোর ভাঙচুর শুরু হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। তা থেকে আজ সময়ের দাবিতে ইতিবাচক আশাপ্রদ অংশগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। আর, তুলনায় আকারে অনেক ছোট-মাঝারি হলেও চেতনায় নতুনত্ব আয়ত্ব করা বাম সংগঠন ও মঞ্চগুলোর শক্তির স্ফূরণ ঘটার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। অবশ্যই আপনা থেকে নয়, উপযুক্ত প্রচেষ্টা চালালে।

পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতিতে বিজেপির সাথে সংগ্রামী বাম শক্তির টক্কর দেওয়ার অবস্থান থাকবে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। বাম ও প্রগতিপন্থী ধারাগুলোর সামনে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভবপর ক্ষেত্র বহুধা বিস্তৃত বৃহত্তর। বিজেপি করবে কেন্দ্রের মোদী সরকারকে আগলানো আর রাজ্যের তৃণমূল সরকার বিরোধী রাজনীতি। আর, বামপন্থীদের সামনে সুযোগ থাকছে আন্দোলনের বর্শামুখ কেন্দ্রের দেশবিরোধী জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে অব্যাহত রাখার, রাজ্যের নবনির্বাচিত সরকারকে দায়বদ্ধ করে চলার। কোভিড মোকাবিলার যুদ্ধ এই সুযোগ এনে দিয়েছে। তাছাড়া লড়াইয়ের সুযোগ থাকবে বিজেপির বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধেও। বিজেপি ক্ষমতার দখল না পাওয়ার আক্রোশ মেটাতে বলতে শুরু করেছে, ‘জিহাদিরা সক্রিয়’, ‘হিন্দুরা একটু বুঝুক’! নির্বাচিত রাজ্য সরকারের শপথ না হতেই হল্লা তুলতে শুরু করে দিয়েছে ‘ রাষ্ট্রপতি শাসন চাই’!

খণ্ড-28
সংখ্যা-16