প্রাণঘাতী কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ আর সেই মৃত্যুগুলোর জন্য ভারত সমবেতভাবে শোক জ্ঞাপন করছে। এই মৃত্যুগুলোকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন গভীর শোক ও মানসিক আঘাত দেখা যাচ্ছে, অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে ভারত সরকারের চরম হৃদয়হীনতা।
ধর্মীয় এবং নির্বাচনী জমায়েত সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে “সমস্ত কোভিড বিধিকে জলাঞ্জলি দেওয়া” এবং মেডিক্যাল অক্সিজেনের ভয়াবহ ঘাটতির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘সুপার স্পেরডার’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। দিল্লী হাইকোর্ট মেডিক্যাল অক্সিজেনের অভাবের কারণে মৃত্যুগুলোকে “গণহত্যার চেয়ে কম নয়” বলে অভিহিত করে দায়ী করেছেন মোদী সরকারকে। কিন্তু নিজেদের সর্বনাশা পথকে শুধরে নিতে উদ্যোগী হওয়া দূরে থাক, মোদী ও তাঁর মন্ত্রীসভা এবং তাঁর দল এই তীব্র ভর্ৎসনাগুলোকে এমনকি মানতেও রাজি নয়। এর বিপরীতে মোদী সরকার এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারগুলোর কাছে জনগণের জীবন রক্ষার চেয়ে নিজেদের “ভাবমূর্তি” রক্ষাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। মেডিক্যাল অক্সিজেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাহায্যগুলোকে যথাযথভাবে বন্টন করার জন্য অনেক দিন থেকেই জরুরি হয়ে ওঠা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনাকে গড়ে না তুলে মোদী সরকার এবং আরএসএস “পজিটিভিটি আনলিমিটেড” শীর্ষক প্রচারাভিযান শুরু করেছে।
“কোনো নেতিবাচক মনোভাব” প্রকাশ করলেই এই প্রচারাভিযান আমাদের ভর্ৎসনা করছে। এই প্রচারাভিযান বলছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে প্রতিদিন যে বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন তা নিয়ে আমরা যেন উদ্বিগ্ন না হই; শ্মশানগুলোতে সারি-সারি যে মৃতদেহ দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে আতঙ্কিত যেন না হই; যে বায়ু থেকে শ্বাস নিই তা যে চিতার ছাইয়ে পরিপূর্ণ, সে কথা যেন স্বীকার না করি; সাংবাদিকরা তাঁদের প্রতিবেদনে হাসপাতালে মানুষের খাবি খাওয়া এবং অক্সিজেনের অভাবে মারা যাওয়ার কথা তুলে ধরলে আমরা যেন সেগুলোতে নজর না দিই এবং শেয়ার না করি; আমরা যেন কোভিড সংক্রমণে মারা যাওয়া সেই মৃতদেহগুলোকে না দেখি, যেগুলো উত্তরপ্রদেশের গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং যেগুলো ভেসে-ভেসে পৌঁছেছে বিহারের কূলে; প্রাক্তন এক রাষ্ট্রদূত অক্সিজেন যুক্ত শয্যার জন্য বৃথাই অপেক্ষা করে হাসপাতালে গাড়ি রাখার জায়গায় মারা গেলেন, সেই সংবাদ আমরা যেন না পড়ি এবং শেয়ার না করি; হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, ইত্যাদি আছে কি নেই সে সম্পর্কে খবরাখবর নিয়ে অন্যদের যেন না জানাই। হাতুড়ে দাড়িয়াল “গুরুরা” এবং সরাকারের প্রচারবিদ হিসাবে কাজ করা সুবেশি টিভি সঞ্চালকরা আমাদের বলছেন, এগুলো সবই “নেতিবাচকতা”’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। যাঁরা “নেতিবাচকতা” ছড়াচ্ছেন তাঁদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হচ্ছে, তাঁরা হলেন দেশপ্রেম বর্জিত, এবং “গুজব ছড়ানো” ও “দেশের নিরাপত্তার” প্রতি বিপজ্জনক হওয়ার জন্য তাঁদের গ্ৰেপ্তার করা হতে পারে। কেউ যাতে শ্মশানে জড়ো হওয়া সারি-সারি মৃতদেহ এবং সদাজ্বলন্ত চুল্লির দৃশ্য দেখতে না পান তার জন্য শ্মশানের চারদিকে অস্থায়ী দেওয়াল তোলার দায়িত্ব পুলিশকে দেওয়া হয়েছে।
আজ ভারতে প্রায় প্রতিটি পরিবারই কোভিড-১৯ সংক্রমণে কোনো না কোনো সদস্য মারা যাওয়ার জন্য শোকবিহ্বল। সরকারি ভণ্ড “সদগুরু” আমাদের বলছেন যে, মৃতের সংখ্যাটা “তাৎপর্যহীন”। এই কথা এটাই বোঝাচ্ছে যে, এমনকি পরিসংখ্যানেও, শুধু একটা সংখ্যা হিসাবেও আমাদের প্রিয়জনদের ধর্তব্যের মধ্যে আনা হবে না। সরকারের হাতে ছেড়ে রাখলে তাদের হিসেবের মধ্যেই নেওয়া হবে না। রাজ্য সরকারগুলো স্বল্প সংখ্যককেই দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বলে প্রকাশ করলেও খবরের কাগজগুলোতে পাতার পর পাতা ভর্তি শোক সংবাদ বেরোচ্ছে, এবং গাড়ি রাখার জায়গায়, জনসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট পার্কে, এবং এমনকি রাস্তাতেও শেষকৃত্য সম্পন্ন হচ্ছে। কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃতের সংখ্যা আড়াই লাখ বলে সরকার স্বীকার করেছে। প্রকৃত মৃত্যুর হার এর তিন থেকে আট গুণ বলে মনে করা হচ্ছে। এর অর্থ অতএব হল, কোভিড-১৯ সংক্রমণ এবং সরকারের অবহেলায় নিহত মানুষের সংখ্যা ২০ লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে — অর্থাৎ, দুই মিলিয়ন মৃত্যু! সোজা কথায়, এটা গণহত্যা ছাড়া কিছু নয়।
ভারতে কোভিড সৃষ্ট গণহত্যাকে মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতিগুচ্ছ এবং অগ্ৰাধিকারগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করেও দেখা যাবে না। গত বছর বহু দেশের সরকারই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় চিকিৎসা পরিকাঠামোকে উন্নত করা এবং টিকা আরও বেশি করে সংগ্ৰহ করার ওপর জোর দেয়। আর মোদী ও তাঁর মন্ত্রীসভা গত বছরটা কাটিয়েছেন করোনার ওপর বিজয়ী হওয়ার দম্ভ প্রকাশ করে; যে যুব ছাত্ররা এবং সমাজ আন্দোলনের মুসলিম কর্মীরা ভারতের সংবিধানের রক্ষায় হিন্দুশ্রেষ্ঠত্ববাদী এবং দরিদ্র-বিরোধী নাগরিক আইন ও নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন চালিয়েছিলেন, এমন বহুসংখ্যককে গ্ৰেপ্তার করার মধ্যে দিয়ে; তাঁর নিজের দলের যে দাঙ্গাবাজরা মুসলিমদের গণহত্যায় উন্মত্ত জনতাকে পরিচালিত করেছিল, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করে; অবৈধ পথে সংসদে তিনটে কৃষক-বিরোধী আইন জোরজবরদস্তি পাশ করানোর মধ্যে দিয়ে; যে সমস্ত কৃষক, ছাত্র ও অন্যান্যরা এই আইনগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় তাদের গ্ৰেপ্তার করে ও তাদের কালিমালিপ্ত করার তোড়জোড়ের মধ্যে দিয়ে; করোনিল, গোবর এবং কোভিড “নিরাময়ের” অন্যান্য হাতুড়ে ব্যবস্থাকে মদত জুগিয়ে; এবং ধর্মীয় সমাবেশ ও নির্বাচনী প্রচার সংগঠনের মধ্যে দিয়ে এই বার্তা পাঠিয়ে যে কোভিডের জন্য পালনীয় বিধির প্রতি মৌখিক আনুগত্য দেখালেই চলবে। এই অপরাধগুলোর জন্য জবাবদিহি প্রধানমন্ত্রী না করলে অন্য কে করবে?
মোদী টিকা সরবরাহের প্রথম বরাতটি দেন ভারতে কোভিড-১৯ টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন আগে -- অন্যান্য দেশ টিকা মজুত করে ফেলার বেশ কয়েক মাস পর। নির্বাচন হতে চলা রাজ্যগুলোকে মোদী প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁর দল নির্বাচনে জিতলে রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হবে, এবং এইভাবে তিনি টিকার মধ্যে রাজনীতিকে ঢোকান। কিন্তু মোদী প্রকৃতই যেটা করলেন তা হল, কেন্দ্র যে দামে টিকা কেনে, রাজ্যগুলোকে তার চেয়ে বেশি দামে টিকা কিনতে বাধ্য করে টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে টিকা বিক্রি থেকে প্রচুর মুনাফা করতে দেওয়া। মোদী সরকার ভারতের ১৫০টা জেলায় অক্সিজেন প্লান্ট তৈরির কথা ঘোষণা করে, কিন্তু এর জন্য দরপত্র ডাকতে সময় নেয় দীর্ঘ আট মাস। ফলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬২টা প্লান্ট তৈরির কথা থাকলেও তৈরি হয়েছে মাত্র ৩৩টা প্লান্ট। এখন আবার ভারতে শ্বাসরোধ হয়ে কাতারে-কাতারে মানুষ যখন মারা যাচ্ছে, মোদী তখন দিল্লীর কেন্দ্রস্থলের ঐতিহাসিক সৌধগুলোকে ধ্বংস করে “সেন্ট্রাল ভিস্টা” প্রকল্প গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছেন যা হবে তাঁর নিজের স্মারকসৌধ। এই অমানবিকতা ও অবহেলা দেখানোর জন্য মোদী ছাড়া অন্য কাউকে কি দায়ী করা যায়?
তাঁর পূর্বসূরি মনমোহন সিং-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কেলেঙ্কারিগুলোতে “মৌন” থাকার অভিযোগ এনে মোদী ক্ষমতায় আসেন। আজ মোদী কুড়ি লক্ষ ভারতবাসীর মৃত্যু নিয়ে মুখ বুজে রয়েছেন – আর মৃত্যুর এই সংখ্যাটা দিনদিন বেড়েই চলেছে। শুধু অক্সিজেন নয়, এমনকি প্রাথমিক তথ্যগুলোর জন্যও যে জনগণ তাঁর সরকারের চেয়ে বিরোধী দলের যুব শাখা এবং নাগরিকদের নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করছেন, সে সম্পর্কেও মোদী মৌন। এবং তিনি স্পষ্টতই আশা করছেন, তাঁর এই অপরাধগুলোর জন্য সমস্ত দায় তিনি নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন। তিনি এবং তাঁর বশংবদ মিডিয়া যদি এই অপরাধগুলো এবং সেগুলো সৃষ্ট মৃত্যুর ব্যাপ্তি ও ধ্বংসকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন, সে ক্ষেত্রেও মোদী আশা করছেন যে পরবর্তী নির্বাচনের আগে জনগণ সবই ভুলে যাবে।
তবে, মোদীর দ্বিতীয় দফা এবং কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সর্বনাশ থেকে রেহাই পেতে ভারত কিন্তু আর একটা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। মৃত্যুর তাণ্ডব নৃত্য এই মুহূর্তেই বন্ধ হওয়াটা ভারতের কাছে জরুরি -- আর তার জন্য প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মোদীর অবিলম্বে পদত্যাগ। তাঁর সঙ্গেই পদত্যাগ করতে হবে তাঁর সহকর্মী সুপারস্পেরডার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রী হর্ষবর্ধনকে। বিরোধী দল এবং শাসক দলের সদস্যদের নিয়ে এক জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে যারা কোভিড-১৯ সঙ্কটের দায়িত্বভার নিতে আগ্রহী : যেটা হবে দলীয় আনুগত্য বর্জিত এক সরকার যা পার্টি লাইন নির্বিশেষে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবে। যে সরকার জনপ্রিয়তা আদায়ের লক্ষ্যে নিজেকে চালিত করার পরিবর্তে জোর দেবে জনগণের জীবন রক্ষার ওপর। ভারতবাসীর জীবন রক্ষায় মোদী সরকারকে অবিলম্বে সরিয়ে তার স্থানে নিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত জাতীয় সরকারকে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১ মে ২০২১)