প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার অপসারিত হোক
vindictive government be removed

কোভিড-১৯ সংক্রমণের ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষেবা যত অমিল হচ্ছে, মানুষ তত মরিয়া হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেদন জানাচ্ছেন — শয্যা-অক্সিজেন-জীবনদায়ী ওষুধের জন্য; টিকা কবে ও কোথায় মিলবে তার হদিস পাওয়ার জন্য। কিন্তু কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার বা উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি সরকারের কাছে এগুলো সবই সরকারকে অপদস্থ করার সংগঠিত প্রয়াস রূপে দেখা দিচ্ছে। এবং যাঁরা এই আবেদনগুলো জানাচ্ছেন বা অক্সিজেন, ওষুধ, টিকা না মেলায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তাদের শায়েস্তা করতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারগুলো উঠে পড়ে লাগছে। সমাজ মাধ্যমে ব্যক্ত টুইট বা সাহায্যের আবেদনগুলোকে জনগণের যন্ত্রণা বা অসহায়তার প্রকাশ রূপে বিবেচনা না করে সবাইকেই শত্রু জ্ঞানে সরকার সেই অসহায় মানুষগুলোর বিরুদ্ধে তার পরাক্রম জাহির করছে।

সম্প্রতি টিকা সঙ্কট ভয়াবহ আকার নিয়ে ভারতীয় জনগণের সামনে হাজির হয়েছে। যাঁরা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাঁরা দ্বিতীয় ডোজ কবে কোথা থেকে পাবেন তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারছেন না। আর যাঁরা প্রথম ডোজও পাননি, নির্দিষ্ট অ্যাপে নাম তুলেও টিকার ঠিকানা পাওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না (সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কর ক্ষেত্রেই এটা ঘটছে)। এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে দিল্লীতে সম্প্রতি অনেক জায়গাতেই কিছু পোস্টার দেখা গেল। পোস্টারগুলোতে লেখা ছিল -- “মোদীজি, আমাদের সন্তানদের টিকা কেন বিদেশে পাঠিয়েছেন?” সাধারণ মানুষ এর মধ্যে সরকারের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াসের পরিবর্তে ভ্রান্ত টিকা নীতির প্রতিফলন দেখতে পেলেও অমিত শাহর পুলিশ এটাকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ধরে নিয়ে রাস্তায় নামল। পোস্টার ছেঁড়া হল, অন্ততপক্ষে ২৫টা এফআইআর হল, ২৫ জনকে গ্ৰেপ্তার করা হল। যাঁদের গ্ৰেপ্তার করা হল তাঁরা সবাই দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ – অটোচালক, দিনমজুর, ছাপা কারখানার শ্রমিক, ইত্যাদিরা। লকডাউনের পরিস্থিতিতে রুটি-রুজি অর্জনের উপায় বন্ধ হওয়ায় তাঁরা শুধু পোস্টারগুলো লাগানোর বিনিময়ে কিছু অর্থ উপার্জনেই প্রয়াসী হয়েছিলেন। গ্ৰেপ্তারের এই অভিযানের পর রাহুল গান্ধি সহ বিভিন্ন বিরোধী নেতা বললেন, তাঁরা ঐ পোস্টার শেয়ার করছেন, কেউ নিজের বাড়ির দেওয়ালে ঐ পোস্টার লাগালেন। আপ দলের নেতা দুর্গেশ পাঠক আবার দাবি করলেন, দিল্লীতে পোস্টার তিনিই লাগিয়েছেন। বিরোধী নেতারা মোদী সরকারের কাছে আহ্বান জানালেন, পোস্টারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য পুলিশ তাঁদের গ্ৰেপ্তার করুক। পুলিশের হাত অবশ্য পোস্টার লাগানো ঐ দরিদ্র মানুষগুলোর বাইরে বিরোধী নেতাদের দিকে আর এগোয়নি।

উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার জলে কোভিডে মৃত শত-শত লাশের ভেসে যাওয়া এখন পুরনো খবর। এখন বরং জনসাধারণকে আলোড়িত করছে গঙ্গার সুদীর্ঘতীর বরাবর হাজার-হাজার মৃতদেহ বালিতে পুঁতে রাখার খবর। সংবাদে প্রকাশ, উত্তরপ্রদেশের ২৭টা জেলায় গঙ্গার ধারে কবর দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েক হাজার মৃতদেহ। কনৌজের মহাদেবী গঙ্গার ঘাটে বালিতে পোঁতা হয়েছে ৩৫০টার বেশি দেহ, কানপুরে শেরেশ্বের ঘাটে কবর দেওয়া হয়েছে অন্তত ৪০০টা দেহ, উন্নাওয়ের দুটো ঘাটে বালির নীচে চাপা পড়েছে অন্তত হাজার খানেক মৃতদেহ — এমনটাই জানিয়েছে ১৭ এপ্রিলের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন। মৃতদেহগুলোকে প্রথাগত পথে সৎকারের সামর্থ্য যাদের হয়নি, কাঠ-চুল্লির খরচের জোগান যাদের ক্ষমতার বাইরে থেকেছে, তারাই এই পথে মৃতদেহের সৎকারকে বেছে নিয়েছে। আর মৃতদেহগুলোকে বালির নীচে থেকে তুলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে কুকুর-শিয়ালের বাহিনী, অপরিমেয় আহারের সন্ধান পেয়ে আকাশে মেতেছে চিল-শকুনের দল। মরণের পরেও মৃতদের সম্মান-মর্যাদা পাওয়া উচিৎ বলে চর্চা কিছুদিন ধরে কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মৃতদেহ নিয়ে শিয়াল-কুকুর, চিল-শকুনের টানাটানি মৃতের প্রতি কোনো সম্মানকে নির্দেশিত করে? যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন আশাকরি এ সম্পর্কে অবহিত আছেন। সেক্ষেত্রে, এই পথে মৃতদেহের সৎকারকে আটকাতে সক্রিয় হওয়ার কোনো ব্যগ্ৰতা কি তাঁরা দেখাচ্ছেন? নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব নিয়ে তোলা আঙুল কি যোগী আদিত্যনাথ সহজভাবে নেবেন? শোনা যাচ্ছে, কোভিড মোকাবিলা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের ওপর অসন্তুষ্ট হলেও রাজ্যের বিজেপি বিধায়করাও সে কথা প্রকাশে ভয় পাচ্ছেন, কারণ, তাঁদের ওপর জাতীয় সুরক্ষা আইনের প্রয়োগ হবে!

এই কদিন আগেই রায়বেরিলি জেলা প্রশাসন তিন সাংবাদিকের কাছে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছে। তাঁদের অপরাধ, জেলায় অক্সিজেন ঘাটতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলা একটা পোস্ট তাঁরা শেয়ার করেন। ঐ পোস্টে বলা হয়েছিল, রায়বেরিলির জন্য নির্ধারিত অক্সিজেনের কোটাকে কাটছাঁট করে অক্সিজেন পাঠানো হচ্ছে অন্য জেলায়। প্রশাসনের পাঠানো নোটিসে হুমকি দেওয়া হয়েছে, কেন তাঁরা ঐ পোস্ট শেয়ার করেছিলেন সে সম্পর্কে সন্তোষজনক উত্তর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিতে না পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অল্প কিছুদিন আগেও আমেথি জেলায় শশাঙ্ক যাদব নামে ২৬ বছরের এক যুবককে পুলিশি হয়রানির মুখে পড়তে হয়। অসুস্থ দাদুর জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে না পেরে ঐ যুবক অক্সিজেন পাওয়ার জন্য টুইটারে আবেদন জানিয়েছিলেন। পুলিশ দাবি করেছিল, ঐ আবেদন ছিল অসৎ উদ্দেশ্য প্রসূত। জেলায় অক্সিজেনের কোনো অভাব নেই, আতঙ্ক ছড়াতেই অক্সিজেনের ঐ আবেদন পোস্ট করা হয়েছিল! তারপর মহামারী আইন ও ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারায় ঐ যুবক অভিযুক্ত হল।

দিনের কথা নয়, গত ৩০ এপ্রিল ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়, এল নাগেশ্বর রাও ও এস রবীন্দ্র ভাটকে নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ এক রায়ে বলে, কোভিড চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় কোনো সামগ্ৰীর জন্য কেউ সামাজিক মাধ্যমে আবেদন জানালে বা ক্ষোভ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। বেঞ্চ প্রধান চন্দ্রচূড় বলেন, “নাগরিক বা বিচারপতি হিসাবে আমার কাছে এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। নাগরিকরা ইন্টারনেটে বা সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করলে, তার বিরুদ্ধে কোনো দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। আমরা চাই না প্রকাশ করা কোনো তথ্যকে চেপে দেওয়া হোক। এটা সঙ্কট মোকাবিলার সবচেয়ে জঘণ্য পথ।” তিনি আরও বলেন, এরকম ঘটলে “আমরা এটাকে আদালত অবমাননা বলে গণ্য করব।”

এ সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা, যোগী আদিত্যনাথরা সুপ্রিম কোর্টকে অবজ্ঞা করে ক্ষোভ প্রকাশকারী নাগরিকদের বিরুদ্ধে এক হাত নিতে উদ্যত হচ্ছেন। এর আগেও সরকারের সমালোচক নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে গ্ৰেপ্তার করে জেলে পোরা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলো বলতে চাইছে — অক্সিজেন-ওষুধ-টিকার অভাব নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যক্ত ক্ষোভকে সুনজরে দেখা হবে না। সবকিছু ঠিক আছে (উত্তরপ্রদেশে অক্সিজেনের চরম হাহাকারের মধ্যে যোগী আদিত্যনাথ যেমন অক্সিজেনের কোনো অভাব নেই বলে দাবি করেছিলেন) এমন মনোভাব প্রকাশ করে সরকারের ভাবমূর্তিতে পালিশ লাগানোই নাগরিকদের পক্ষে অভিপ্রেত। আর এর বিপরীতটা ঘটলে সরকার দাঁত-নখ বার করতে দ্বিধা দেখাবে না। টিকার অভাব নিয়ে দিল্লীতে পোস্টার লাগানোর পরিপ্রক্ষিতে দিল্লী পুলিশ এই ছেঁদো যুক্তি দিল যে, পোস্টার লাগিয়ে জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করা হচ্ছে, দৃশ্যদূষণ ঘটানো হচ্ছে। আর অক্সিজেন-ওষুধের অমিল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের ক্ষেত্রে আদিত্যনাথ প্রশাসনের যুক্তি হল – যারা এগুলো করছে তারা সব সমাজবিরোধী, কোনো অভাব না থাকা সত্ত্বেও এরা গুজব ছড়াচ্ছে, রাষ্ট্রের দমনই এদের প্রাপ্য। নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার, বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলো এভাবে সমালোচনার প্রতি আক্রোশপরায়ণ এবং ক্ষোভ প্রকাশকারী নাগরিকদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করছেন। তবে আমরা, ভারতীয় নাগরিকরা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে, প্রশ্ন করার অধিকারকে কোনোভাবেই খর্ব হতে দেব না। নিজেকে সংশোধন করার কোনো অভিপ্রায় সরকারের আছে বলে দেখা যাচ্ছে না। তাদের অপসারণে আমাদের তাই সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-18