গোটা দুনিয়া যখন কোভিড-১৯ অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, মোদী সরকার তখন প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় ‘চমকপ্রদ সাফল্য’ দেখাতে নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছিল। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে মোদী জানালেন, করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় ভারত কিভাবে দুনিয়াকে সাহায্য করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপির জাতীয় নেতৃত্ব প্রস্তাব গ্রহণ করে মোদীর ‘বিচক্ষণ, সংবেদনশীল, অঙ্গীকারবদ্ধ ও দূরদর্শী’ নেতৃত্বকে অভিবাদন জানাল যা নাকি ‘কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে বিশ্বের কাছে গর্বিত ও বিজয়ী দেশ হিসাবে তুলে ধরেছে’। মার্চ মাসের গোড়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন ঘোষণা করলেন যে ভারত কোভিড-১৯-এর ‘খেলা শেষ’ করে এনেছে। তিনি আহ্বান জানালেন যে কোভিড-১৯ নিয়ে যেন রাজনীতি না করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ভারতকে বিশ্বের ওষুধ তৈরির কারখানা বলে বর্ণনা করলেন।
নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যেতেই মোদী সরকার নিজেকে নির্বাচন যন্ত্রে পরিণত করল। যেখানে নির্বাচন ছিল না সেখানে কুম্ভ মেলা হল। এই মেলাকে রহস্যজনকভাবে এক বছর এগিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু মার্চ মাসের শেষে মহারাষ্ট্র থেকে কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সংবাদ আসতে লাগল। এবং তারপর এপ্রিল মাস আমাদের প্রচণ্ড ধাক্কা দিল। এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ প্রতি চারদিন অন্তর দশ লক্ষ নতুন সংক্রমণ আগের সংখ্যার সঙ্গে যোগ হতে থাকল। মৃতের সংখ্যা প্রতি দিন ২০০০ ছাড়িয়ে যেতে থাকল। ক্রমেই বেশি-বেশি শহর ও রাজ্য থেকে হাসপাতালে শয্যার অভাব, অক্সিজেনের জন্য হাহাকার এবং এমনকি মৃতদেহ দাহ করার স্থানের অভাবের রিপোর্ট আসতে লাগল। স্বঘোষিত নেতৃত্বকারী দেশ আজ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখে অতিমারীর সদর দপ্তর, যে দেশের সরকার দেশকে এক মহা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অতিমারীর প্রাদুর্ভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স ও গ্ৰেট ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলো সহ অনেক দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। তবে টিকা তৈরি করে ফেলার সাথে-সাথে অনেক দেশই গণ টিকাকরণের পথে গিয়ে ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে। ভারতের ভাগ্য ভালো যে এখানে সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর হার অনেকটা কম ছিল। এর ফলে কিছুটা সময় আমরা পেয়েছিলাম। এই সময়কে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটানো যেত। সত্যি বলতে ২০২০ সালে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব কঠিন কোনও পরীক্ষার মুখে পড়েনি, বরং লকডাউনের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মানবিক সংকটই আমাদের দেশে ২০২০’র কোভিড সঙ্কটের বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে কার্যত অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আমরা এখন জানি নভেম্বর মাসেই সংসদীয় কমিটি সরকারকে দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে সতর্ক করে রিপোর্ট দিয়েছিল, তথাপি সরকার ক্রমাগত অক্সিজেন রফতানি করে গেছে এবং টিকাকরণ অভিযানকে জোরদার করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
এর চেয়েও নিকৃষ্ট ব্যাপার হল, সংক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ার লক্ষণগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরও সরকার সেগুলোকে উপেক্ষা করল। উত্তরাখণ্ড সরকার এবং বিভিন্ন আখড়া কুম্ভ মেলায় স্নানের কর্মসূচী চালিয়ে গেল (এমনকি একেবারে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত, এ বছরের সম্ভবত শেষ ‘সাহি স্নান’, তা পালন করা হল)। এবং নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তাঁদের রোড-শো ও বড়-বড় জমায়েতগুলো চালিয়ে গেলেন। অভূতপূর্ব ভাবে নির্বাচনকে আট পর্বে প্রলম্বিত করে নির্বাচন কমিশনও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলল, পশ্চিমবাংলায় কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা ভয়াবহ ভাবে বেড়ে চললেও শেষ তিন দফাকে এক দফায় সাঙ্গ করতে তারা অস্বীকার করল। মাদ্রাজ হাইকোর্ট একেবারে যথার্থভাবেই নির্বাচন কমিশনকে তিরস্কার করেছে, এবং ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক পদস্থ কর্তা সোজা কথাটা সোজা ভাবে বলেছেন নরেন্দ্র মোদীকে রোগ ছড়ানোর “সুপার স্প্রেডার” হিসেবে অভিহিত করে।
যে সরকার সতর্কতা শিথিল করে তোলার দিকে দেশকে নিয়ে গেল এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় ও সম্পদের অপচয় ঘটিয়ে ভারতের কোভিড মোকাবিলার পন্থাকে দুর্বল করে তুলল, তারাই এখন নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচাতে আর কর্পোরেটদের মুনাফাকে জনগণের জীবনের চেয়ে ঊর্দ্ধে স্থাপন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সামাজিক মাধ্যমের মঞ্চগুলোকে সমালোচনা মুছে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে যাঁরা অক্সিজেনের অভাব নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এবং বিরোধী পক্ষকে নিশানা করতে এবং সব দোষ জনগণের ঘাড়ে চালান করতে মিডিয়াকে নামানো হচ্ছে। সংবেদনশীল ও কর্মঠ কোনও সরকার থাকলে যে জীবনগুলিকে নিশ্চিত বাঁচানো যেত সেরকম হাজার হাজার জীবন বলি হয়ে যাচ্ছে এই অপদার্থ সরকারের জন্য, আর সেই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে আড়াল করতে সমালোচনা করা হচ্ছে এক অনির্দিষ্ট বিমূর্ত ‘সিস্টেম’- কে। বিশ্ব স্তরে আজ আমরা যে ভয়ঙ্কর কর্পোরেট মুনাফাবাজি দেখতে পাচ্ছি, তার জায়গায় নিদারুণভাবে প্রয়োজন পেটেন্ট-মুক্ত গণ টিকার জমানা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকেও অবিলম্বে টিকার ওপর থেকে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা স্বত্বের অধিকার তুলে নিতে হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্ৰেট ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেন তাতে বাধা না দেয়। তবে, ভারত বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে এই দাবিটি তুললেও পরিহাসের ব্যাপার হল, মোদী সরকার নিজেই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নির্মম কর্পোরেট মুনাফাবাজির কিছু কদর্য দৃষ্টান্তে সক্রিয়ভাবে মদত জোগাচ্ছে। বিনা খরচে সবার জন্য টিকাকরণের দায়িত্ব না নিয়ে বিজেপি টিকাকে সংযুক্ত করছে ভোটের সঙ্গে এবং টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে ‘সুপার প্রফিট’ করার অবাধ ছাড়পত্র দিচ্ছে; এবং আরও অনুমোদন দিচ্ছে স্বেচ্ছাচারীভাবে নির্ধারিত ভিন্ন-ভিন্ন দামে টিকা বিক্রির অধিকারে; টিকার দাম কেন্দ্রের জন্য হবে ১৫০ টাকা, রাজ্য সরকারগুলোর জন্য ৪০০ ও ৬০০ টাকা এবং বেসরকারী হাসপাতালগুলোর জন্য হবে ৬০০ ও ১২০০ টাকা।
জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারের অপরাধসম অবহেলাকে আরও একবার আড়াল করতে, জনগণের ক্ষতিপূরণের কোনও ব্যবস্থা না করেই বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। জনগণ কিন্তু গত বছরের লকডাউন থেকে অনেক কিছু শিখেছে, জনগণ এবার যথেষ্ট সতর্ক ও ক্রুদ্ধ। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কতাগুলোকে মেনে চলে আমাদের পীড়িত জনগণের জন্য সাহায্যের আয়োজনে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। বিহার ও ঝাড়খণ্ডে আমাদের বিধায়করা তাঁদের আন্তরিক ও নিবেদিত ভূমিকার জন্য জনগণের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রশংসা পাচ্ছেন। অনেকগুলি মহানগর ও জেলা শহরে কমরেডরা কোভিড সেবায় হেল্পলাইন চালাচ্ছেন। আমাদের কাজের সমস্ত এলাকায় এই উদ্দীপনা ও জনসেবার মডেলকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। প্রতিটি মৃত্যুই আজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নীতি নির্ধারণ ও সরকার পরিচালনার প্রশ্নে গণ স্বাস্থ্যের কী অপরিসীম গুরুত্ব, দেখিয়ে দিচ্ছে এক আধুনিক সভ্য সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে কেন পদে পদে সঙ্ঘ-বিজেপির হিন্দু রাষ্ট্রের ছকের এত গভীর সংঘাত। আমাদের এইসব মৃত পরিজন ও সহনাগরিকদের প্রতি শোক জ্ঞাপনের একমাত্র উপায় হল সরকারকে দায়ী করে সরকারী কর্মনীতিতে প্রগতিশীল পরিবর্তন আনা এবং দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নির্ধারক পরিবর্তন আনার লড়াই তীব্র করে তোলা।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ এপ্রিল ২০২১)