ভারতের অধঃপতিত যে গণতন্ত্রকে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বলে অভিহিত করেছে, তা সবথেকে ভালোভাবে কাজ করে রাত্রি কালে। ছেচল্লিশ বছর আগে মধ্যরাত্রে গণতন্ত্রের সাংবিধানিক দরজায় ভয়াবহ আঘাত দিয়েই জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। বর্তমানের ‘আচ্ছে দিন’-এর দুর্দশাগ্রস্ত জমানায় বিমুদ্রাকরণ ও লকডানের মত গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাগুলো সবই হয় রাতের দিকে। পশ্চিম বাংলায় অভিভূত করে দেওয়ার মতো গণরায় আসার দু-সপ্তাহ পর এই রাজ্যকে এখন নিশিথে চালানো নতুন একদফা ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গত ১৭ মে সিবিআই পাঁচ বছরের পুরনো দুর্নীতির একটা মামলায় চার রাজনীতিবিদকে গ্ৰেপ্তার করে, যাদের মধ্যে কলকাতার বর্তমান মেয়র এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় দফার মন্ত্রীসভার পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রীও রয়েছেন। দুপুরবেলায় তাঁরা এক সিবিআই আদালত থেকে জামিন পেলেও হাইকোর্ট মাঝরাতে এক একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে জামিনের ঐ আদেশে স্থগিতাদেশ জারি করে, ফলে চার অভিযুক্তকে গভীর রাতে জেলে পোরা হয়। যুক্তিসম্মত জামিনের আদেশে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ শুধু পদ্ধতিগত সমীচীনতাকেই লঙ্ঘন করেনি, অপ্রয়োজনীয়ভাবে অভিযুক্তদের জেলে পাঠিয়ে এক অশোভন দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে, সুপ্রিম কোর্ট যদিও করোনার এই পরিস্থিতিতে জেলে না পাঠানোর দ্ব্যর্থহীন পরামর্শ দিয়েছে।
পশ্চিম বাংলা জয় করার বিজেপির খোয়াবকে প্রবলভাবে প্রত্যাখান করা নির্বাচনী রায় বেরোনোর পর থেকেই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মিলতে থাকল যে, এই ফলাফলকে মেনে নিয়ে পরিস্থিতিকে শান্ত হতে দিতে বিজেপি রাজি নয়। নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক হিংসার ঘটনাগুলোয় শয়তানি করে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়া হয় এবং জাল রিপোর্ট ও ভুয়ো ভিডিওর সাহায্যে সেগুলোকে অতিরঞ্জিত করে তোলা হয়। গণরায়কে ‘সংখ্যালঘু ভেটো’ বলে অভিহিত করা হয় এবং সারা দেশে ও বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে প্রচার চালানো হয় যে, পশ্চিম বাংলায় তথাকথিত হিন্দু- বিরোধী সন্ত্রাস ও গণহত্যা চলছে।
পশ্চিম বাংলায় একটা দলের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য দেখানোর জন্য রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় কুখ্যাত হয়ে আছেন। বাংলার গণরায়ে অন্তর্ঘাত ঘটাতে তিনি এখন চেষ্টার কোনো কসুর করছেন না। উপরন্তু, নির্বাচিত সরকারের উপর দিয়ে এবং সাংবিধানিক ঔচিত্যের কোনো তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার এক স্বতন্ত্র কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে চলেছেন। নির্বাচন পরবর্তী হিংসার ঘটনাগুলো প্রশমিত হলেও এবং ভয়াবহভাবে বেড়ে চলা কোভিড-১৯ সংক্রমণের ব্যাপকতার প্রতি রাজ্য সরকার মনোযোগ দিতে শুরু করলেও রাজ্যপাল শিতলকুচি ও নন্দীগ্ৰাম পরিদর্শনে গেলেন। বিধায়ক ও মন্ত্রীরা যখন শপথ নিচ্ছিলেন, সেই সময় তিনি রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে এবং স্পিকারকে কিছু না জানিয়েই নারদা মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্ৰহণ চালিয়ে যেতে সিবিআই-কে অনুমতি দিলেন, আর এটা পশ্চিম বাংলায় প্রকাশমান চিত্রনাট্যের অঙ্গ হিসাবেই প্রতিভাত হল।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে নারদা স্টিং অপারেশন চালানো হয়েছিল ২০১৪ সালে, কিন্তু তার টেপগুলো প্রকাশ করা হয় ২০১৬-র নির্বাচনের ঠিক আগে, এবং তা সেবারের নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু হয়ে ওঠে। কলকাতা হাইকোর্ট ২০১৭ সালে মামলাটা সিবআই-এর হাতে তুলে দেয়। ইতিমধ্যে, মূল অভিযুক্তদের কয়েজন বিজেপিতে যোগ দেয়, যাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমানে বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় উপসভাপতি ও বিজেপি বিধায়ক মুকুল রায় এবং বিজেপি বিধায়ক সুভেন্দু অধিকারী, বর্তমানে যিনি বিজেপি বিধায়ক দলের এবং পশ্চিম বাংলা বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা। যে সিবিআই এতদিন এই মামলা নিয়ে তেমন তৎপরতা দেখায়নি, তারা সহসাই এই মামলা নিয়ে অমন উঠেপড়ে লাগল কেন, বিশেষভাবে পশ্চিম বাংলা যখন আট দফায় প্রলম্বিত নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে সদ্য বেরিয়ে এসেছে এবং অতিমারীর প্রবল প্রকোপ বৃদ্ধির মোকাবিলার চেষ্টা করছে? আর বিজেপিতে আশ্রয় নেওয়া অভিযুক্তদের পুরোপুরি বাদ দিয়ে বেছেবেছে শুধু তৃণমূল নেতাদেরই বা নিশানা বানানো হচ্ছে কেন? প্রসঙ্গত, যে চার নেতা গ্ৰেপ্তার হয়েছেন তাদের মধ্যে শোভন চট্টোপাধ্যায়ও রয়েছেন, যিনি ছিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা এবং যিনি কিছুদিন আগে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আবার বিজেপি ছাড়েন।
এই মুহূর্তে সিবিআই-এর হস্তক্ষেপের মধ্যে শুধুই অতীত, বর্তমান ও সম্ভাবনাময় দলবদলুদের নিয়ন্ত্রিত করা ছাড়াও আরও কিছু রয়েছে। সেই প্রশ্নাতীত বার্তাটা হল, যে রাজ্য বিজেপির ডবল ইঞ্জিনের টোপ গিলতে অস্বীকার করবে, তাকে তার স্পর্ধার কারণে গুরুতর মূল্য চোকানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। দিল্লীকে এর মূল্য দিতে হয়েছে। আম আদমি পার্টি বলতে গেলে কোনো বিরোধী ভূমিকার মধ্যেই যায়নি, জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা হরণ থেকে দিল্লী দাঙ্গা এবং দাঙ্গা পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের একগুচ্ছ কর্মীদের গ্ৰেপ্তারের মত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে বিজেপির বানানো বৃত্তান্তে সায় দেওয়ার পরও তাদের ঐরকমভাবে ভুগতে হয়েছে। আর এটাও তো ঠিক যে, বিজেপির কিছু নেতা ভোট দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় না আনার জন্য পশ্চিম বাংলার জনগণকে এক ঐতিহাসিক ভুল করার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।
পশ্চিম বাংলায় যা ঘটল সেটাকে শুধু দুর্নীতি-অভিযুক্ত কয়েকজন রাজনীতিবিদকে কেন্দ্র করে রূপ নেওয়া আর একটা বিতর্ক বলে মনে করলে চূড়ান্ত ছেলেমানুষী হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সিবিআই-কে বা রাজ্যপালের দপ্তরকে কাজে লাগানোর বিরোধিতা করে কখনই দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের পক্ষ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না কিংবা দুর্নীতির ঘটনাগুলোতে জড়িতদের শাস্তি থেকে অব্যাহতির পক্ষেও সওয়াল করা হচ্ছে না। আসল বিষয়টা হল, পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে জয়ী হতে না পেরে বিজেপি গণরায়ে অন্তর্ঘাত হানতে চেষ্টার কোনো কসুর করছে না। সিবিআই ও রাজ্যপালের যুগপৎ হস্তক্ষেপ হল পশ্চিম বাংলা জয়ে বিজেপির ব্যর্থ প্রচেষ্টাকে অন্য উপায়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলার গণরায়ে বিজেপি আতঙ্কিত বিশেষভাবে এই কারণে যে, ঐ রায় মোদী সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা ও অযোগ্যতার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে সঞ্জীবিত করে তুলেছে এবং মোদী সরকারের সাপেক্ষে এক শক্তিশালী জাতীয় বিরোধী পক্ষ ও রাজনৈতিক বিকল্প লাভে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে দৃঢ়তর করেছে। এই জন্যই পশ্চিম বাংলার গণরায়ে অন্তর্ঘাত হানার ও তাকে বানচাল করার এই মরিয়া প্রচেষ্টা। পশ্চিম বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন চাপিয়ে দিলে তা হবে ভারতীয় রাষ্ট্র কাঠামোর সাংবিধানিক ভিত্তি ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে চালানো এক সার্বিক যুদ্ধ। তা শুধু কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিস্থিতিতে মোদী সরকারের সর্বনাশা ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগই হবে না, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের ধ্বংসসাধনকেও নির্দেশিত করবে। আর তাই সারা ভারতের বিরোধী দলগুলো এবং জন আন্দোলনগুলোকে পশ্চিম বাংলায় মোদী সরকারের চক্রান্তমূলক হস্তক্ষেপকে ধিক্কার জানাতে হবে এবং পার্টিজান রাজ্যপালকে অবিলম্বে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ মে, ২০২১)