ডাক্তার স্মরজিত জানা — যৌনকর্মী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ
Doctor Smarjit Jana

সানাউল্লাহ নামক এক ডাকাতের নাম থেকে হয়ে গেল সোনাগাছি। কথিত আছে যে ডাকাত হলেও মৃত্যুর পর সানাউল্লাহ গাজি হিসাবে সম্মানিত ও বন্দিত হয় এবং এলাকার নাম হয়ে যায় সানা গাজি লেন। একজন ডাকাত বা গাজির হারেম কখন থেকে যে দেহব্যবসার কেন্দ্র হয়ে গেলো এটা নিয়ে ইতিহাসে স্পষ্ট কিছু লেখা নেই। ১৮৬৮র ‘ইন্ডিয়ান কন্টাজিয়াস ডিজিজ অ্যাক্ট’ চালু করার সময় এলাকাটি প্রথম প্রশাসনের নজরে আসে। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ১৯৯২ সালে এলাকায় ভিন্ন ধরনের কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়। এক উজ্জ্বল ও উদ্যমী ডাক্তারের নেতৃত্বে কিছু তরুণ তরুণী সোনাগাছিতে এইচআইভি-এসটিডির ওপর সমীক্ষা শুরু করে। তাঁর নাম ডক্টর স্মরজিত জানা; তিনি তখন ‘অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন এন্ড পাবলিক হেলথ’এর সাথে যুক্ত। শুরুর দিনগুলি ছিল কঠিন। এলাকার দাদা, দালালদের হুমকি, পুলিসের হুজ্জুতি তো ছিলই, সর্বোপরি খোদ যৌনকর্মীরা, যাদের স্বার্থে সমীক্ষাটা করা হচ্ছিলো, তাঁরাই অসহযোগিতা করছিলেন। তাঁদের ধারণা মানুষ যদি জেনে যায় যে তাঁরা যৌনরোগে আক্রান্ত তাহলে তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ততদিনে চেন্নাইয়ের (তৎকালীন মাদ্রাজ) রেড লাইট অঞ্চলে এইডসের প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। ডঃ জানা দেখলেন এই প্রাণনাশক ব্যাধি যাতে কলকাতার নিষিদ্ধপল্লিগুলিতে ছড়িয়ে না পড়ে সেটার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তিনি STD-HIV Intervention Program (SHIP) শুরু করলেন। ধীরে ধীরে যৌনকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে লাগল। তাঁরা বুঝলেন তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই এই স্বেচ্ছাসেবকদের কথা শোনা প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে সমীক্ষায় দেখা গেল প্রায় ৮০% কর্মী কোনও না কোনও যৌনরোগে আক্রান্ত। অল্প সংখ্যক এইডসে আক্রান্ত। ডঃ জানা মনে করলেন একমাত্র নিরাপদ যৌনসংসর্গ অনুশীলন করলেই রোগের এই সুনামি আটকানো সম্ভব। এরজন্য অতি আবশ্যিক হচ্ছে কন্ডোম ব্যবহার। আবারও প্রবল বাধা আসে। যৌনকর্মীরা নিজেরাই দ্বিধান্বিত কারণ তাঁদের মক্কেলদের চূড়ান্ত অনীহা। তাঁরা ব্যবসার ক্ষতি হওয়ার ভয় করে। এক দীর্ঘ ও কঠিন লড়াই শুরু হয়। এতে এই ব্যবসায় সমস্ত অংশীদার যেমন ম্যাডাম, দালাল, পুলিশ, এলাকার গুন্ডা, ক্লাব এবং অবশ্যই ক্লায়েন্টদের চেতনা বৃদ্ধির প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রায় একবছর বাদে দেখা যায় নিরাপদ যৌনসংসর্গ অনুশীলন করছেন এরকম কর্মীর সংখ্যা ন্যূনতম থেকে বেড়ে হয় ৫৫%। এই প্রকল্প যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের এক প্রমাণস্বরুপ যেটির সাফল্য ডঃ জানাকে দেশে বিদেশে বিখ্যাত করে দেয়।

যৌনকাজকে একটা অপরাধমূলক কাজ হিসাবে গণ্য করা হয়। এরফলে পুলিশের হাতে যত্রতত্র হেনস্থা হতে হয়। এলাকার দাদারা জুলুম করে, ম্যাডামরা বঞ্চনা করে এবং মক্কেলরা তাঁদের অসহয়াতা এবং নিরাপত্তাহীনতার সুযোগ নেয়। ডঃ জানা মনে করতেন এই অবস্থা থেকে কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে এবং সেটার জন্য এই কাজকে একটি পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। সাধারণ মানুষ যেমন রুটিরুজির জন্য নানা পেশায় যুক্ত হয় এই কাজও সেরকমই একটি পেশা। তিনি মনে করতেন এখানে নৈতিকতা বা অনৈতিকতার কোনও স্থান নেই। কেউ যদি স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসে তাহলে তাঁকে আটকানোর কারো অধিকার নেই। তবে নাবালিকা এবং জোর করে কাউকে এই পেশায় নিযুক্ত করার তিনি সবসময় বিরোধিতা করেছেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি সোনাগাছিতে ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’ নামক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথমেই তিনি এই কর্মীদের পরিচয় পত্র, যেমন ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, তৈরি করার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি এঁদের ব্যাংকে খাতা খুলতে উৎসাহিত করেছেন, কোওপারেটিভ শুরু করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর নেতৃত্বে এই সংগঠন যৌনকর্মীদের অধিকার সম্পর্কে সর্বদা সোচ্চার থেকেছে। তাঁরা সামাজিক নিরাপত্তার দাবি তুলেছেন - বৃদ্ধাদের পেনশন, অন্তঃসত্বা মহিলাদের ভাতা, শিশুকন্যাদের সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি। সর্বোপরি তাঁরা তাঁদের পেশার আইনি স্বীকৃতি দাবি করেছেন। এই দাবি এখনো অধরা, সুপ্রিম কোর্টে কেস চলছে। এই সব দাবিতে এক সময় তাঁরা মে দিবসে নিয়মিত মিছিল করতেন। তাঁদের শ্লোগান, ‘গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই’ সমাজে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

আমাদের সমাজে এনজিও’দের কাজকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। মনে করা হয় এঁরা বিদেশ থেকে টাকা পায় এবং নয়ছয় করে। সত্যি মিথ্যা যাই হোক দুর্বারের নামেও একই অভিযোগ রটেছে এবং সেটার ছিটে ডঃ জানার গায়েও পড়েছে, যার ফলে তিনি সবসময়ই বিতর্কিত থেকেছেন। কিন্তু যৌনকর্মী এবং যৌনপেশাকে সম্মানপ্রদান ও স্বীকৃতির জন্য তিনি যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন একথা অনস্বীকার্য। গত ৯ মে তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন। তাঁর মৃত্যুতে যৌনকর্মীরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন।

 - সোমনাথ গুহ  

খণ্ড-28
সংখ্যা-17