নারীরাই কি এবারের নির্বাচনে ত্রাতা হয়ে উঠলেন?
Did women become the savior

শেষ পর্যন্ত সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করেও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে পর্যদুস্ত হল বিজেপি। মোদী-শাহ-নাড্ডা-আদিত্যনাথ জেলায় জেলায় গেলেন, নেতা-নেত্রী কেনা হল, জাতীয় সংবাদ মাধ্যম বিজেপি’কে বাংলার ত্রাতা হিসেবে প্রচারও করল লাগাতার। তবু শেষ বিচারে জনতা রায় দিল প্রাক্তন শাসক দলের পক্ষে। সকলেই, এমনকি বামেরাও স্বীকার করলেন, এবার ভোট হয়েছে বিজেপির পক্ষে/বিপক্ষে।

দীর্ঘ দশ বছর শাসনকালের পরও কোনো রাজ্যে শাসকবিরোধী ধারা গড়ে উঠবে না, এ প্রায় অসম্ভব। এ রাজ্যেও দুর্নীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণে শাসকদলের প্রতি ক্ষোভ ছিল। বিজেপি চেষ্টার কসুর করেনি নিজেদের যোগ্য বিকল্প হিসেবে প্রচার করতে। কংগ্রেস ও বাম শাসন পূর্বে দেখা গেছে, তৃণমূল শাসনও দেখা গেল, এবার তাদের সুযোগ দেওয়া হোক ‘সোনার বাংলা’ গড়ার, এই ছিল তাদের বক্তব্য৷ তা সত্ত্বেও তৃণমূল প্রায় ৪৮% ভোট, আর ৭৩% আসন জিতল। এই সামগ্রিক ফলাফলে নারী-ভোটারদের ভূমিকা কী? কেনই বা তাঁরা সে ভূমিকা নিলেন?

রাজ্যে ৭.৩২ কোটি ভোটারের মধ্যে ৩.৫৯ কোটি নারী৷ তাঁরা ভোটে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মহিলা মতদানকারীর সংখ্যা প্রতি ভোটেই বাড়ে। মমতা ব্যানার্জির মুসলিম ভোট ব্যাংক নিয়ে আলোচনা হয়। অথচ মুসলমানরা জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ হন যদি, তবে মহিলারা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তাই এই নির্দিষ্ট লিঙ্গপরিচয়ের মানুষের ভোটের অভিমুখ ও তার কারণও পর্যালোচনা করা দরকার৷

২০১৯ সালে সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভলপিং সোসাইটিজ’এর তত্ত্বাবধানে লোকনীতি সংস্থা এক ভোট পরবর্তী সমীক্ষা করে জানায়, ভারতবর্ষের মধ্যে তৃণমূলই একমাত্র দল যা পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের ভোট পেয়েছে বেশি। তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের ৫১% এসেছে মহিলাদের থেকে। আর পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ভোটারের ৪৭% তাদের ভোট দিয়েছেন, যেখানে বিজেপিকে দিয়েছেন ৩৭% মহিলা। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তাদের প্রাপ্ত ভোটের ৫২% ছিল মহিলা ভোট, আর তখন পশ্চিমবঙ্গের ৪৮% মহিলা ভোটার তাঁদের ভোট দেন। তৃণমূলের মহিলা প্রার্থীর সংখ্যাও ক্রবর্ধমান। এবারেই প্রার্থী তালিকায় ছিলেন ৫০ জন মহিলা। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মহিলা প্রার্থী ছিলেন ৪১% সিটে।

আপাতভাবে, এসবই আশার কথা। একথাও অনস্বীকার্য যে তৃণমূল মহিলা ভোট টানার চেষ্টা করে নানা জনকল্যাণমূলক ক্যাশ টাকা বা সামগ্রী প্রদানের স্কিমের মাধ্যমে। ‘কন্যাশ্রী’ আর ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প যথাক্রমে মেয়েদের পড়াশোনা আর বিয়ের জন্য প্রদেয়। ‘সবুজ সাথী’র মাধ্যমে গ্রামের মেয়েরা পায় সাইকেল এবং কিছু শিক্ষাঋণের ব্যবস্থাও আছে। ২০১৩ সালে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প চালু হয়েছিল মেয়েদের স্কুল-ড্রপ আউট ও বাল্যবিবাহ রোখার জন্য। তা ২০১৭ সালে ইউনাইটেড নেশনস-এর পাব্লিক সার্ভিস পুরস্কারেও ভূষিত হয়ছে। সাম্প্রতিক কালে যে ‘স্বাস্থ্য সাথী’ নামক বীমা প্রকল্প চালু হল, তাতেও কার্ডটি দেওয়া হচ্ছে বাড়ির বয়ঃজ্যোষ্ঠ মহিলার নামে, এতে তাঁর অস্তিত্বকে স্বীকৃতিই দেওয়া হয়। এবছরের ম্যানিফেস্টোয় তৃণমুল লিখেছে পরিবারের বয়োবৃদ্ধ মহিলাটিকে ৫০০-১০০০ টাকা মাসিক ভাতা দেওয়ার কথাও। প্রতিপক্ষ এসবকে ‘ঘুষ’ বা ‘ভিক্ষা’ বললেও দরিদ্র বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মহিলাদের জীবনে এসব আশ্বাসের গুরুত্ব আছে।

বিজেপিও আপাতভাবে এবারের ম্যানিফেস্টোয় মেয়েদের ভোট ব্যাংকে বিশেষ জোর দিয়েছিল। নারীদের জন্য ছিল বিনামূল্যে সরকারী পরিবহণ ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি, সরকারী চকরিতে ৩৩% সংরক্ষণের আশ্বাস ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে লেখাপড়ার ব্যবস্থার কথা। কিন্তু মনে হয় সরকারী চাকরি, শিক্ষা বা পরিবহণ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি নারীদের আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ সকল সরকারি পরিষেবারই বেসরকারীকরণে বিজেপি সারা দেশ জুড়েই তৎপর।

উপরন্তু বিজেপি যে নারীবিদ্বেষী-বর্ণবিদ্বেষী-ব্রাহ্মণ্য-পিতৃতান্ত্রিক আরএসএস ভাবধারার বাহক, তা বাংলা তথা সারা ভারতে অজানা নয়। দিল্লী ও ইউপি’র অচেনা হিন্দুত্ববাদী পুরুষেরা যখন বারবার আসছিলেন, অচেনা ভাষায় বলছিলেন, বাংলায় মেয়েরা সুরক্ষিত নয়, তখন তা স্বস্তির চেয়ে ভয়ের সঞ্চার করছিল বেশি৷ মধ্যবিত্ত শহুরে নারী বিরক্ত হচ্ছিলেন, কারণ তিনি জানেন উত্তর প্রদেশের ধর্ষণ পরিসংখ্যান। জানেন ওই দলের হাথরসের ধর্ষিতাকে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বা কাঠুয়ার ধর্ষকের সমর্থনে মিছিলের কথা। কিন্তু এরাজ্যের খেটে খাওয়া নারীদের মনেও সংশয় তীব্র হচ্ছিল। নারী সুরক্ষা নামে এরা নারীদের আবার চার দেওয়ালে আবদ্ধ করতে চায় না তো? পশ্চিমবঙ্গের নারী শ্রেণি নির্বিশেষে তার যাতায়াতের, মেলামেশার স্বাধীনতা নিয়ে সচেতন। আদিত্যনাথের এখানে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড গঠনের ‘আশ্বাস’ তাদের কানে ‘হুমকি’ হিসেবেই পৌঁছোয়।

অতঃপর প্রধানমন্ত্রী যখন হিসহিসে স্বরে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘দিদি, ওওও দিদি’ বলে মস্করা করেন, তখন তা তাঁর দলের নারীবিদ্বেষেরই দ্যোতক হয়ে ওঠে। যখন দিলীপ ঘোষ মুখ্যমন্ত্রীর শাড়ির দৈর্ঘ্য স্থির করে দেন, তাঁকে বারমুডা পরতে বলেন, তা নিন্দিত হয় সেইসব নারী অধিকার কর্মীদের দ্বারাও, যারা হয়ত তৃণমূল সমর্থক নন। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনও পায় প্রচুর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অংশগ্রহণ, যারা হয়ত মুখ্যমন্ত্রীর গুণমুগ্ধ নয়। কিন্তু তারা ভাবে, “যদি মুখ্যমন্ত্রীকেই এমনতরো বলা যায়, তবে আমরা কতটা নিরাপদ?” অন্যদিকে তৃণমূল তৈরি করে ‘হুইলচেয়ারে আহত একাকী নারী’র এক আকর্ষক রূপকল্প, যা ভোটারদের সহমর্মিতা পেতে সক্ষম হয়।

একথা স্বীকার করা ভাল যে এবারের ভোটে জয় পরাজয়ের খতিয়ানে নারীদের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। নারীরাই নিশ্চিত করেছে যে তারা বিজেপিকে চায়না৷ নারীরাই অতএব হয়েছে শাসকদলের ত্রাতা। অথচ পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক প্রচারের সময় প্রচারকারীদের সঙ্গে বিদগ্ধ আদানপ্রদান হয় সচরাচর পরিবারের পুরুষটির। নারীরা থাকেন মৌন, বিশেষত গ্রামে-গঞ্জে। ধরেই নেওয়া হয়, স্বামী বা পিতা যে চিহ্ন ভোট দেবেন, তিনিও সে চিহ্নেই দেবেন৷ কিন্তু অনুমান, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষটি হিন্দুত্ববাদীদের ভোট দিলেও, নারীরা ভোট দিয়েছেন, আস্থা রেখেছেন অন্যত্র। নতুন সরকারের উচিত সেই অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। কী কারণে, কীসের আশায় তাঁরা ভোট দিলেন, তা অনুধাবন করা ও সেই কর্মসূচিগুলি, সেই আশ্বাসগুলি আশু বাস্তবায়িত করা৷

তাঁদের আরও অনুধাবন করা উচিত, কামদুনি কাণ্ডের সুরাহা এখনও হয়নি বা পার্ক সার্কাসের ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলা ভুল হয়েছিল৷ নারী প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাঁরা হয়ত আরেকটু চিন্তাশীল হতে পারেন। সেলিব্রিটি নারী নয়, তাঁরা এমন নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন যাঁরা প্রকৃতই নারীদের উন্নতির কথা ভাববেন, ক্যাশ অর্থ প্রদানের স্কিমগুলির বাইরেও সার্বিক উন্নতির কথা ভাববেন। বেকারত্ব কিন্তু নারীরও সমস্যা, শুধু পুরুষের না৷ তারও আশু সমাধান প্রয়োজন।

আর নাগরিক সমাজের আরও গভীর অন্বেষণ করা প্রয়োজন, কীভাবে ফ্যাসিবিরোধী শক্তি হিসেবে নারীদের সঙ্ঘবদ্ধ করা যায়৷

- শতাব্দী দাশ 

খণ্ড-28
সংখ্যা-17