আমেরিকার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক রানা আইয়ুব-এর একটি নিবন্ধ সম্প্রতি আলোড়ন তুলেছে। সেখানে খুব যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ ও তথ্য সমাবেশের মধ্যে দিয়ে রানা দেখিয়েছেন কীভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের ঔদাসীন্যর কারণেই করোনা মহামারির এই দ্বিতীয় ঢেউ গোটা দেশে এক মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। রানা আইয়ুবের লেখাটি শুরু হয়েছে ভারতের এক বিখ্যাত ফুসফুস বিশেষজ্ঞ (পালমনোলজিস্ট) ডাক্তার জলিল পার্কারের কথা দিয়ে। পার্কার দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন ভারতের অন্যতম সেরা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বলে পরিগণিত মুম্বাইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে। গত বছর তিনি নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন আইসিইউ’তে ভর্তি ছিলেন, প্রায় মৃত্যমুখ থেকে ফিরে এসেছেন। তারপরেও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময়ে সরকারী অব্যবস্থা আর অপরিণামদর্শিতা তাঁর ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন যে হাসপাতালে যদি রোগীদের জন্য বেড না থাকে, অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক না থাকে তাহলে ডাক্তার বা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীকে বাঁচাবেন কীভাবে? তাঁর আক্ষেপ যে, আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়ছে এবং আমরা আমাদের দেশবাসীকে একের পর এক মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছি।
রানা এই লেখায় কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে অনেক তথ্য পরিসংখ্যান দিয়েছেন। আমাদের এই লেখার সময় তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে মোট কোভিড আক্রান্তের সংখ্যায় ভারত এখন কেবল আমেরিকার পেছনে এবং আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি এই মুহূর্তে বিশ্বে সর্বোচ্চ। রানা বলেছেন সরকারী হিসাব মতে দেশে দৈনিক কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা ২,০০০-র আশেপাশে বলে বলা হলেও স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তারা বেসরকারিভাবে তাঁকে জানিয়েছেন সংখ্যাটা অন্তত এর পাঁচগুণ, প্রায় ১০,০০০ হবে। ২৩ এপ্রিল দিল্লীর বিখ্যাত গঙ্গারাম হাসপাতাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, তাঁদের হাসপাতালেই অক্সিজেনের অভাবে একদিনে ২৫ জন রোগীর মৃত্যুর কথা।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে নানাভাবেই ডেকে এনেছে সরকারের মারাত্মক উদাসীনতা ও অসচেতনতা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং সেখান থেকে রোগ দেশের কোণে-কোণে মারাত্মকভাবে ছড়িয়েছে। গতবছর যে সরকার কোভিড ছড়ানোর দায়ে তবলিগি জমাতের একটি সমাবেশকে অপরাধীকরণের দায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এবার তারা কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েতে যে শুধু অনুমতি দিয়েছে তাই নয়, উত্তরাখণ্ডের বিজেপি নেতারা সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপণ দিয়ে জানিয়েছেন যে কুম্ভমেলায় যোগদান নিরাপদ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন দেশে আছড়ে পড়ছে সেই সময়েই ২০ মার্চ উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর আশ্চর্য এই বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে যে কাউকেই কোভিডের কারণে কুম্ভমেলায় যোগদান থেকে বিরত করা হবে না। সেইসঙ্গে সেখানে তিনি এও বলেন যে ঈশ্বর বিশ্বাসের শক্তি কোভিড ভাইরাসের আতঙ্ককে মুছে দেবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী যখন ট্যুইট করে কুম্ভমেলায় যোগদানকে প্রতীকী করার কথা বলেছেন, তার আগেই এটা গোটা দেশে মহামারী ছড়ানোর ক্ষেত্রে ‘সুপার স্পেডার’-এর ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
সরকার সময় থাকতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ-এর ব্যাপারে যে কোনও প্রস্তুতিই নেয়নি, অক্সিজেন সরবরাহ থেকে হাসপাতাল বেড ও অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরি করার ব্যাপারে আশ্চর্য উদাসীনতা দেখিয়েছে তা ঠান্ডা মাথায় খুনের মতোই ভয়াবহ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে সরকারের তাবড় ব্যক্তিরা মূলত ব্যস্ত থেকেছেন পশ্চিমবঙ্গ সব বিভিন্ন নির্বাচন ও ক্ষমতা দখল নিয়ে। চরম উপেক্ষিত হয়েছে জনস্বাস্থ্যের দিকটি।
টাইম ম্যাগাজিনের এই নিবন্ধটির মতোই বিশ্বের আরো নানা দেশের নানা প্রখ্যাত সংবাদপত্র মোদী সরকারকে ভারতের এই মৃত্য মিছিল ও চূড়ান্ত চিকিৎসা সঙ্কটের জন্য দায়ি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামী সংবাদ সংস্থা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ তীব্র ভর্ৎসনা করেছে ভারতের বেপরোয়া মনোভাবকে।
তারা লিখেছে, “এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। খুব দ্রুত বিধিনিষেধ শিথিল করায় ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে বসে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছেন, সিনেমাহল খুলে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সরকার কুম্ভমেলায় ধর্মীয় জমায়েতের অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে, ভারত নিজেই বিপদ ডেকে এনেছে।”
ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে তুলোধোনা করেছে। সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়েছে, “ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেশের এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। তোষামোদকারীদের পরামর্শ শুনে আত্মবিশ্বাসে ভুগেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। নিজের বোধবুদ্ধি হারিয়ে চূড়ান্ত গাফিলতি করেছেন। উনি নিজের ভুল স্বীকার করে সিদ্ধান্ত সংশোধন করুন। তাঁর উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে কীভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা যায় সেটা দেখা। সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখুক। তাঁর দলের আদর্শের বাইরে গিয়ে এখন একতার বার্তা দেওয়া, জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অবনতির জন্য ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা মোদীকে তাঁর চিন্তাভাবনার অভাবের জন্য তুলোধোনা করবেন।”
ব্রিটেনের তথা বিশ্বের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্য ‘বিবিসি’র সমালোচনাটিও প্রণিধানযোগ্য। ‘বিবিসি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, “বেশ কয়েকটা কারণে ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধির দফারফা, মাস্কহীন মানুষ, একইসঙ্গে কুম্ভমেলায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়। এই রেকর্ড সংখ্যক রোগীর ভিড়ে হাসপাতালগুলিতে বেড ও অক্সিজেনের ঘাটতি হয়েছে। রোগীর পরিজনরা চিকিৎসার জন্য হাহাকার করছেন।”
অস্ট্রেলিয়ার ‘এবিসি নিউজ’এর রিপোর্ট অনুযায়ী, “বিপর্যয় খুব সহজে এবং পরিকল্পনামাফিক এড়ানো যেত। তিনটি কারণে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে - সরকারের প্রতিক্রিয়া, মানুষের ব্যবহার এবং করোনা ভ্যারিয়েন্ট।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘টাইম ম্যাগাজিন’এর কথা দিয়েই শেষ করা যাক। “শক্তি ও ক্ষমতার সঙ্গে প্রয়োজন ছিল দায়িত্ববোধের। দায়িত্ব থেকে এড়িয়ে গিয়েছে সরকার। মোসাহেবরা মন্ত্রিসভায় থেকে প্রধানমন্ত্রীকে করোনা মোকাবিলার জন্য শুধু বাহবাই দিয়ে গেছেন। এদিকে, টেস্টিং মন্থর হয়েছে, আর মানুষকে আরও বেপরোয়া হতে এবং করোনাকে পাত্তা না দেওয়ায় উৎসাহিত করেছে।”
- সৌভিক ঘোষাল