গত ৪ মে ২০২১ পার্টির রাজ্য কমিটির এক অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে সাম্প্রতিককালে প্রয়াত কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। যথা দার্জিলিং জেলা ও শিলিগুড়ির পার্টি সংগঠক কমরেড অপূর্ব (অপূ) চতুর্বেদী, নদীয়ার নপাড়া অঞ্চলের কমরেড সিরাজ মোল্লা, হাওড়া জেলার কমরেড রঞ্জিত দে। কবি-প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ঠ বামপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রয়াত শঙ্খ ঘোষকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। এছাড়া কোভিড আক্রান্ত কর্মী-সমর্থক-দরদীদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয়। বৈঠকে আলোচিত বিষয় ও গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি নিম্নরূপ –
১) নির্বাচনী পর্যালোচনা – পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী ফলাফল স্পষ্টতই এক বিজেপি বিরোধী গণরায় হিসাবে উঠে এসেছে, যেখানে মেরুকরণ হয়েছে রাজনৈতিকভাবে, ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়। বিভিন্ন জেলাওয়াড়ি নির্বাচনী ফলাফলের চিত্রে যা পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। কেবলমাত্র তৃণমূলের সপক্ষে নয় এ রায় বিজেপি বিরোধী নানা স্তরের জনগণের এক প্রতিবাদী জনমত হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
২) বাংলার বুকে ফ্যাসিবাদী শক্তির দখলদারী রুখে দিতে বিভিন্ন ধরনের বাম গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল জনগণ পথে নেমেছিলো। একুশের ডাক,নো ভোট টু বিজেপি প্রভৃতি ব্যানারে বিভিন্ন সংগ্রামী শক্তির বিজেপি বিরোধী প্রচার যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে, ফলাফলে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে, সর্বস্তরে এক নৈতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ এ রাজ্যে এসে বিজেপির বিরুদ্ধে যে প্রচার করেছে সেটাও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। তৃণমূলের যে ৫ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি ঘটেছে তার পেছনে কাজ করেছে এই সমস্ত শক্তিগুলি এবং নাগরিক সমাজের এক সক্রিয় বিজেপি বিরোধী ভূমিকা।
৩) তৃণমূলের সপক্ষে তথা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ফলাফলের পেছনে প্রাথমিক ভাবে যে দিকগুলি কাজ করেছে তা হলো শ্রেণীগত বঞ্চনা তথা শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির উপর যে হামলাগুলি নামিয়ে আনা হয়েছে সেই দিকগুলি, যা আমরা তুলে ধরেছি। এছাড়া মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে কূৎসিত ভাষায় গালাগালি ও বিজেপির পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীত প্রতিক্রিয়া ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে। তৃণমূল সরকার বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পগুলিতে মহিলাদের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলি তুলে ধরেছিলো। এছাড়া বিজেপির হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান দৃষ্টিভঙ্গী চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে বাঙ্গালী ভাবাবেগ অনেকাংশে কাজ করেছে। তৃণমূলের পক্ষে এই গণরায়কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি।
৪) সিপিএম বাংলার জনগণের এই রায়কে বিচার বিবেচনা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফ্যাসীবাদের পক্ষে নাকি এ রাজ্যের বুকে যে কোনো মূল্যে তাকে প্রতিহত করতে হবে – নির্বাচনের এই প্রধান ইস্যুটাকেই তারা ধরতে অস্বীকার করেছে। তৃণমূল বিজেপি একই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ তাদের এই সূত্রায়ণ রাজ্যের মানুষ মেনে নেয়নি। ভুল রাজনৈতিক কৌশলের জন্যই তাদের ভোটের একটা বড় অংশ দ্বিমেরুকৃত রাজনীতির অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে এবং এ রাজ্যে বামশক্তির এক চরম অবনমন ঘটিয়েছে, যা অভূতপূর্ব। পঃ বাংলায় ধারাবাহিকভাবে বিরোধীপক্ষের কোনো ভূমিকা তারা গ্রহণ করেনি বরং যেন ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য অপেক্ষমান এক শক্তি হিসাবেই তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে। কংগ্রেস ও অন্য একটি শক্তির সাথে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জোট গঠনের কৌশল প্রয়োজনবাদী ও সুবিধাবাদী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে, বামমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আমরা সিপিএম তথা বামদের জয়ী আসনগুলিতে সমর্থন জানিয়ে তাদের থেকে রাজনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখার যে অবস্থান আমরা গ্রহণ করেছিলাম তা সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। সিপিএম কেন্দ্রীয়ভাবে বলছে যে বিজেপিকে ঠেকাতে মানুষ তৃণমূলকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু কেন সিপিএম বা সংযুক্ত মোর্চা নিজেকে এক বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারল না বা তার চেষ্টাই করল না সে ব্যাপারে তাদের বিশ্লেষণে আত্মসমালোচনা বা এমনকি আত্মজিজ্ঞাসাও নেই। এখনও রাজ্যে তাদের বহু নেতা পুরো ফলাফলটাকে আরএসএস-এর ছক বলে চালিয়ে যাচ্ছেন।
৫) নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি ও আমাদের কাজ – নির্বাচনী ফল প্রকাশের পরই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হিংসার ঘটনাবলী দেখা যাচ্ছে। তৃণমূলের দুষ্কৃতিরা বিরোধীদের উপর হামলা নামিয়ে এনেছে। নীচু তলায় গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ তথা গরিব মেহনতি মানুষের জীবন-জীবিকার উপর হামলার এই ঘটনাবলীর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে রাজ্য জুড়ে বিজেপি একে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চক্রান্ত শুরু করেছে। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তারা একটি সম্প্রদায়কে আক্রমণের লক্ষবস্তু বানাচ্ছে এবং দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা ও প্ররোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে তারা ব্যবহার করছে, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে চাইছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কলকাতায় তাৎক্ষণিকভাবে পথে নেমে প্রতিবাদী কর্মসূচী গ্রহণ করেছি।
স্লোগান – সরকার চলুক সন্ত্রাস নয়। শান্তি চাই দাঙ্গা নয়। লড়াই হোক করোনার বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলার এই সুস্পষ্ট রায়কে নসাৎ করার বিজেপির গভীর চক্রান্তর বিরুদ্ধে আমাদের প্রচার ও প্রতিবাদী কর্মসূচী অব্যাহত রাখতে হবে। পার্টি ও গণ সংগঠনের ব্যানারে জেলাগুলিতে ও ব্লকে ব্লকে প্রচার কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা করা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে ধরতে হবে। হিংসার ঘটনাবলীতে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন মারা গেছে। সন্ত্রাসের ঘটনাবলীতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের দায়দায়িত্বর প্রশ্ন তুলে ধরে আমাদের প্রচারে নামতে হবে।
৬) ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিগুলির ঐক্যবদ্ধ কার্যকলাপকে আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখে বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। যথা একুশের ডাক ফোরামের মাধ্যমে নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন শক্তির সাথে আন্তঃক্রিয়া চালানো। এই প্রথমবার বিধানসভায় বামদের কোনো প্রতিনিধি নেই, বিরোধীপক্ষের অবস্থানগত ভারসাম্য এক দিকে ঝুঁকে রয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতাকে মোকাবিলা করতে রাস্তার লড়াইয়ের মাধ্যমে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সতর্কতা সজাগতা বজায় রাখতে হবে। বামপন্থার পুনর্জাগরণ বা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আমাদের ছাত্র-যুব-নতুন প্রজন্মর কর্মীদের ইতিবাচক রাজনৈতিক ভূমিকা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুন অনুশীলনে নতুন কর্মীদের দায়দায়িত্বে নিয়ে আসার লক্ষ্যে জেলা কমিটিগুলিকে পরিকল্পনা নিতে হবে।
৭) আমরা যে কেন্দ্রগুলিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি তার মধ্যে কয়েকটি কেন্দ্রে আমরা উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে নির্বাচনী প্রচারকাজ করতে পেরেছি। সেখানে স্বল্প হলেও আমাদের ভোট কিছুটা বেড়েছে। যথা ধনেখালি, ফাঁসিদেওয়া, খরগ্রাম, মন্তেশ্বর (বিগত উপনির্বাচনের তুলনায়) প্রভৃতি। কিন্তু কিছু আসনে আমাদের প্রাপ্ত ভোট আগের তুলনায় কমেছে। সেখানে সংগঠনের অবস্থা বা আমাদের কাজকর্ম গুটিয়ে এসেছে কিনা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে এবং সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে তোলার কার্যকরী পদক্ষেপগুলি নিতে হবে।
৮) করোনা পরিস্থিতি – বর্তমানে করোনা পরিস্থতি ক্রমশ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিজেপি তার বাংলা দখলের মরিয়া প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ৮ দফায় ভোট করেছে, বড় বড় জমায়েত ও রোড-শো করেছে। রাজ্যের বুকে কোভিড সংক্রমণ বাড়িয়ে তোলার পেছনে এটা অন্যতম একটা কারণ হিসাবে কাজ করেছে। স্বাস্থ্যবীমা কার্ডের নামে মানুষকে সম্পূর্ণ প্রবঞ্চনা করা হয়েছে, নীচুস্তর থেকে শুরু করে সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন চরম অবহেলিত রয়েছে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বেড, অক্সিজেন, করোনা টিকা সব কিছুর এক চরম সংকট চলছে। মানুষ কার্যত অসহায়। সরকারী নীতির বিরুদ্ধে নানাবিধ জরুরি দাবিতে আওয়াজ তোলার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি এলাকায় আমাদের যুব ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা খুবই প্রশংসনীয়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি জেলায় সমন্বিত করার প্রচেষ্টা চলছে। উপসর্গ থাকলেই ভর্তি করা, অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবরাহ, সকলের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রগুলিতে কোভিড টিকাকরণ ও করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা, ব্যপক মাত্রায় সেফ হোম আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা প্রভৃতি দাবিগুলিকে তুলে ধরতে হবে। এলাকাস্তরে জনগণের পাশে দাঁড়াতে আমাদের উদ্যোগগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে। আমরা পুনরায় লকডাউনের সংকটের দিনগুলির সন্মুখীন হতে চলেছি। গরিব মেহনতি মানুষের কাজ, খাদ্য, নগদ ভর্তুকি ও নিরাপত্তার একপ্রস্থ দাবিসনদ সূত্রবদ্ধ করে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। রাজ্যে কয়েকটি স্থানে মহিলা নিগ্রহর ঘটনা ঘটছে। এতে আমাদের ছাত্র যুব ও মহিলা সংগঠনকে দ্রুত তৎপরতার সাথে যথাযথ ভুমিকা গ্রহণ হবে।
৯) আংশিক করোনা লকডাউন ও রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বাধ্যতামূলকভাবে দেশব্রতী প্রকাশনা আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে। পত্রিকার ডিজিটাল সংখ্যা প্রকাশিত হবে।
অভিনন্দন সহ,
সিপিআই(এলএল) লিবারেশন
পঃ বঙ্গ রাজ্য কমিটি