চতুর্দিকে দেখি, যতদূর পর্যন্ত চোখ যায়, খবর এসে কানে পৌঁছায়; বিভক্ত গ্রামসমাজ! ভোটের পর এই বিভাজন চরম আকার ধারণ করে, রক্ত ঝরে মাটির বাড়িগুলিতে। কেউ মারতে আসে, কেউ বাঁচার চেষ্টায় লাঠি ধরে। ঘটনা ঘটে। সত্যি মিথ্যা মিশিয়ে এফআইআর হয়। হাজারে হাজারে খেতমজুর, তপশিলিভুক্ত দরিদ্র মানুষ রাতের বেলা পুলিশী হামলার ভয়ে মাঠের মধ্যে দিন কাটায়। আসল অপরাধীরা সাবধানে থাকে। সাধারণ মানুষকে পুলিশ শাসকের চাপে জেলে ঢোকায়।
আহত মানুষের চিকিৎসা হয় না। কারণ তাতে শাসক ভুক্ত অপরাধীর অপরাধের প্রমাণ পোক্ত হয়! যারা আজ মার খাচ্ছে, ঘরছাড়া; বিজেপি জিতলে হয়তো তারা উল্টো পক্ষের উপর এর চেয়েও বেশি করতো! হয়তো কেন বলছি, সত্যিই করতো।
“খেলা হবে” -এর দুই পক্ষই গরিব মানুষ- এসসি, আদিবাসী, খেতমজুর! এক অশুভ চক্রব্যুহে এরা ফেঁসে গেছে সবাই। সেই গত শতকের ৯০-এর দশক থেকে। চলছে খেলা। রক্তাক্ত কৃষিভূমি – পুনরাবৃত্তিই শুধু দেখছি, দেখে চলেছি।
এই দিগন্ত বিস্তৃত হিংসায় লাভ আছে অনেকের। দরিদ্রদের মধ্যে মুখিয়া দুই একজন আর উপরের ভদ্রলোক নেতা। বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারলে পঞ্চায়েতের উপর দখলদারি নিশ্চিত!
এবারের নির্বাচনী যুদ্ধ কোনো সাধারণ লড়াই ছিল না। এটা ছিল ফ্যাসিবাদকে আটকানোর লড়াই। বিজেপির হাত থেকে বাংলা বাঁচানোর লড়াই। গত দশ বছর কোনায় কোনায় বিস্তৃত যে দুর্নীতি আর দমনের সাক্ষী গ্রাম, তাতে এই নির্বাচন জেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সহজ ছিল না।
মহারণ শেষে এই যে বিজেপি-বিরোধী মহারায়, তার কারণ এটা ছিল ফ্যাসিস্ট বিরোধী সকলের লড়াই। ধনেখালির লড়াই যদি দেখি, তবে এখানে টিএমসি বিরোধী ভোট এক লক্ষ। এরা মূলত গরিব। এরা ঘরছাড়া, সন্ত্রস্ত। এই যদি চলতে থাকে তবে বিজেপির পক্ষে কিছু দিনের মধ্যেই মাটি ফিরে পাওয়া কঠিন হবে না।
অশুভ চক্রমুক্তি কিভাবে সম্ভব? এমনটা ভেবে যে ফ্যাসিবাদ তো হেরেছে, সুতরাং যারা মার খাচ্ছে ঠিকই আছে। নাকি দরিদ্র মানুষকে শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদের বিপদ বুঝিয়ে? নাকি অপেক্ষা করে? আগে ওরা মার খাক। পরে দেখা যাবে! নাকি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে?
সরাসরি পাশে না থেকে রাজনীতির উন্নত ভার্সন মাটিতে শিকড় মেলতে পারে?
এর সন্ধান করতে হবে ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের। অবশ্যই পেতেও হবে।
গত পরশু ধনেখালি ১ নম্বর পঞ্চায়েতের তালবোনা মুদিপাড়ায় (দিনমজুর পাড়া) দুটি টিউবওয়েল থেকে বিরোধী দলের লোকেদের জল খাওয়া নিষিদ্ধ করে তৃণমূল। আমরা হস্তক্ষেপ করি। কল খোলে। ওদের রাগ বাড়ে।
গতকাল এক আশা কর্মী মহিলার বাড়ির উপর হামলা করে। “কেন বিরোধীদের পরিষেবা দিয়েছো” কুৎসিত গালিগালাজ করে। আমাদের সাহসে ওই আশা কর্মী পুলিশে জানায়। আবার গ্রামে পুলিশ ঢোকে।
সন্ধ্যার সময় গ্রামের অত্যাচারিত মেয়েরা কমরেড রুমা আহেরীর বাড়ি জড়ো হন। আমাদের সাথে কথা বলতে চান। সে সময় ছিলাম পাশের বেলমুড়ি পঞ্চায়েতের এক আদিবাসী পাড়ায়, মল্লিকপুরে, যেখানে এক আদিবাসী মহিলা আগের দিন খেতের কাজ শেষে, খাবার জন্য কলে বাসন ধুতে গিয়ে শাসক দলের বাইক বাহিনীর আচমকা হামলায় মাথায় মারাত্মক আঘাত নিয়ে শয্যাশায়ী!
আগামীকাল হসপিটালে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে জয়হরিপুর পৌঁছে কমরেড সজল দে, কমরেড সম্রাট মাহেলী সহ যাওয়া হল তালবোনা। সেখানে আলোচনা চলছিল বিজেপির রাজনীতি কেন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সাফল্য পেল না; কেন আমাদের একসাথে গরিব মানুষের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে – এসব নিয়েই।
আধঘণ্টার মধ্যেই খবর এলো, শাসক দলের লোক বাইরে জমায়েত করছে। আমরা চলে গেলেই এই বাড়িতে হামলা করবে।
স্বভাবতই আমরা থেকে যাওয়া স্থির করলাম। ওরা আর কতো অপেক্ষা করবে! বাড়িতে হামলা করলো। আমাদের বাইক দুটো ভাঙ্গলো। কমরেড রুমাদির ছাদের অ্যাসবেসটস চাল ভাঙ্গলো। এরপর ঘরে ঢুকে রুমাদিকে টেনে বাইরে বার করতে চাইলো। দ্রুত দরজার মুখেই আমরা বাধা দিলাম। প্রায় মিনিট ১৫। ওরা যখন কিছুতেই ঘরে ঢুকতে পারলো না, তখন আমাকে ও কমরেড সজল দে’কে টেনে বাইরে বার করতে চাইলো। আমাদের দুজনেরই জামা ছিঁড়ে দিলো। এরা জনা দশেক মেয়ে! দরিদ্র পরিবারের। এরা সবাই জানে বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের প্রচার যুদ্ধ। এই পাড়াতেও মাইক নিয়ে “বিজেপিকে একটাও ভোট নয়” সভা করেছি আমরা। ফলে জাতশত্রু জ্ঞান করতে পারছে না!
এরা পেরে উঠছে না দেখে এতক্ষণ পরে মেঘের আড়াল সরিয়ে সামনে উদয় হলো বুথ সভাপতি মেঘনাদ, মেঘনাদ আহেরী। সজলকে বললো, কেন এসেছিল! আমাকে বললো, তোমাকে জ্যান্ত ফিরতে দেবো না।
ইতিমধ্যে আমাদের টানাটানি করছে দেখে পুলিশে ফোন করি। মিনিট তিরিশের মধ্যে পুলিশ ঢোকে। ওরা গা ঢাকা দেয়!
আমরা ঠান্ডা মাথায় ধৈর্যশীল চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক বড়ো ঘটনা ঘটতে পারতো কালকে। বিশেষত একবার যদি প্রতিরোধটা ভেঙ্গে পরতো! ওদের সবার হাতে ছিল চ্যালা কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি।
ফ্যাসিবাদকে রুখতে গেলে চাই গণতন্ত্র, চাই গণতন্ত্রের শক্তিশালী ভূমিকা – আক্রান্ত গ্রামে, মানুষের পাশে এবং উপরে রাজধানী শহরে, জেলা শহরে, ব্লক সদরে সাহসিক বহুমুখী উদ্যোগ। আমরা কি পারবো?
না হলে ৭৭ এমএলএ সহ শক্তিশালী বিরোধী অবস্থানে থাকা বিজেপির পক্ষে খোলা মাঠ পড়ে থাকছে। সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ এবং গণতন্ত্রের জন্য মানুষের হাহাকারকে ফ্যাসিবাদ তার পক্ষেই কাজে লাগাবে।
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আজ শপথ নিলেন। গণতন্ত্র রক্ষা করা হবে বললেন।
পারবেন কি গ্রামস্তর পর্যন্ত কর্মী বাহিনীকে সামলাতে? নাকি বিভক্ত গ্রামসমাজ অশুভ শক্তির মৃগয়াক্ষেত্র, চারণভূমিই থেকে যাবে?
সজল অধিকারী
ধনেখালি, হুগলি, ৫ মে ২০২১