পশ্চিমবাংলায় যখন বিধানসভা নির্বাচন চলছিল, সেই সময় যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে অনুষ্ঠিত হল পঞ্চায়েত নির্বাচন। ১৫ এপ্রিল শুরু হয়ে কয়েকটা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে নির্বাচন শেষ হয় ২৯ এপ্রিল। কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে যে রাজ্যগুলো ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, উত্তরপ্রদেশ তার অন্যতম। সংক্রমণের এই ব্যাপকতার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সমীচীন হয়নি বলেই অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কেননা, নির্বাচন অনুষ্ঠান রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এক কর্মকাণ্ড এবং তারমধ্যে নিহিত থাকে সংক্রমণের আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। প্রথম ঢেউয়ের সময় সংক্রমণকে উত্তরপ্রদেশের গ্ৰামাঞ্চলে খুব বেশি ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সংক্রমণের হারের দিক থেকে শহর ও গ্ৰামাঞ্চল প্রায় সমান-সমান এবং এর পিছনে পঞ্চায়েত নির্বাচনের অবদান আছে বলেই ব্যাপকতর স্তরে বিশ্বাস। কোভিড নিয়ন্ত্রণে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের ব্যর্থতা উত্তরপ্রদেশের জনগণের কাছ থেকে আড়াল করা যায়নি। এরসঙ্গে বিভিন্ন স্তরের অপশাসন যুক্ত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং তার প্রতিফলন পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে পড়ে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি একেবারে ধূলিসাৎ না হলেও একটা ধাক্কা যে খেয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। এই কথাটাও ধর্তব্যের মধ্যে রাখতে হবে যে, গোটা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়েই আদিত্যনাথের দল পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।
উত্তরপ্রদেশ পঞ্চায়েত নির্বাচনের রয়েছে চারটে স্তর – নির্বাচিত হন গ্ৰাম পঞ্চায়েত সদস্য, গ্ৰাম প্রধান, ক্ষেত্র পঞ্চায়েত (ব্লক পঞ্চায়েত) ও জেলা পঞ্চায়েত। এই চারটি স্তরে মোট পদের সংখ্যা ৮.৬৯ লক্ষ – গ্ৰাম পঞ্চায়েত সদস্য ৭.৩২ লক্ষ, গ্ৰাম প্রধান ৫৮,১৭৬, ক্ষেত্র পঞ্চায়েত ৭৫,৮৫২, জেলা পঞ্চায়েত ৩,০৫০। নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত না হলেও প্রতিটি দলই তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে এবং নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর সেই অনুসারেই নির্ধারিত হয় প্রতিটি দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা। জেলা পঞ্চায়েতই পঞ্চায়েত স্তরে ক্ষমতার প্রধান আধার হওয়ায় এই স্তরে লাভ করা আসন দিয়ে কোন রাজনৈতিক দল কেমন ফল করল তার একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।
ফলাফলে দেখা গেছে, বিজেপি’র গড় বলে পরিচিত এমন অনেক জেলাতেই বিজেপি তেমন ভালো ফল করতে পারেনি। তার তুলনায় সমাজবাদী পার্টি (এসপি) এবং কোথাও বিএসপি’র ফল ভালো হয়েছে। অযোধ্যার কথা ধরা যাক। এই জেলায়, জেলা পঞ্চায়েত আসন সংখ্যা ৪০-এর মধ্যে এসপি পেয়েছে ২৪টা আসন এবং বিজেপি’র প্রাপ্ত আসন সংখ্যা মাত্র ৮। রাম মন্দির নির্মাণের তোড়জোড় নির্বাচনী ফলাফলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই দেখা যাচ্ছে। বারাণসীতে ৪০টা আসনের মধ্যে এসপি পেয়েছে ১৫টা ও বিজেপি পেয়েছে ৮টা আসন; লক্ষ্মৌয় ২৫টা আসনের মধ্যে এসপি পেয়েছে ১০টা আসন আর বিজেপি’র প্রাপ্ত আসন সংখ্যা মাত্র ৩; যোগী আদিত্যনাথের নিজের জেলা গোরক্ষপুরে জেলা পঞ্চায়েত আসন সংখ্যা ৬৮ – এরমধ্যে বিজেপি ও এসপি’র প্রাপ্ত আসন সংখ্যা যথাক্রমে ২০ ও ১৯, প্রায় সমান-সমান; বিজেপি’র প্রভাবের শক্তিশালী জেলা বলে পরিচিত মথুরায় আবার বিএসপি ভালো ফল করেছে – বিএসপি’র ১২টা আসনের তুলনায় বিজেপি পেয়েছে ৮টা আসন। জেলা পঞ্চায়েতের মোট ৩,০৫০ আসনের মধ্যে এসপি’র প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ৭৪৭, আর বিজেপি পেয়েছে ৬৯০ আসন। এই পদে অনেক নির্দলীয় প্রার্থীও বিজয়ী হয়েছে।
সিপিআই(এমএল) পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দু’টো জেলা পঞ্চায়েত আসনে জয়ী হয়েছে – আসন দু’টি হল সিতাপুর জেলার ১৪নং ওয়ার্ড এবং দেবারিয়া জেলার ২৬নং ওয়ার্ড। এছাড়া, কিছু গ্ৰাম পঞ্চায়েত ও গ্ৰাম প্রধান পদেও সিপিআই(এমএল) প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
আদিত্যনাথ সরকার রাজ্যের জনগণের কাছে সুশাসনের কোনো নজির রাখতে পারেনি। রাজনীতিবিদ-দুর্বৃত্ত গাঁটছড়া ও দুর্নীতি উত্তরপ্রদেশে এক বিস্তৃত পরিঘটনা। বিরোধীমত আদিত্যনাথ একেবারেই বরদাস্ত করেন না এবং বিরোধী মত প্রকাশকারীদের ওপর দমন নামিয়ে অনেককেই জেলে পোরা হয়। দলিত ও সংখ্যালঘু নিপীড়ন উত্তরপ্রদেশে এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। ‘সিএএ’ বিরোধী আন্দোলনকারীদের যোগী সরকারের প্রবল পীড়নের মুখে পড়তে হয়েছে। নারীদের নিরাপত্তাও যোগীরাজ্যে খুব একটা সুরক্ষিত নয়। হাথরসের দলিত কন্যার গণধর্ষণ ও নিহত হওয়ার ঘটনায় রাজ্য প্রশাসন যেমন ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করে, ঐ ঘটনা আবার দলিত উৎপীড়নের প্রশ্নাতীত বাস্তবতাকেও নির্দেশিত করে। আর কোভিড মোকাবিলায় যোগী সরকার চরম অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছে। অক্সিজেনের জন্য চারদিকে হাহাকার রব উঠলেও অক্সিজেনের সঙ্কটকে আদিত্যনাথ শুধু অস্বীকারই করেননি, যে সমস্ত হাসপাতাল অক্সিজেন অমিলের কথা বলেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি গ্ৰহণের, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ফরমানও জারি করেছেন। জীবনদায়ী ওষুধের লভ্যতা বা ঐ সমস্ত ওষুধ নিয়ে কালোবাজারি রুখতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কোভিডে মৃতের প্রকৃত সংখ্যাকে গোপন করতে শ্মশানকে উঁচু প্লাস্টিক ও টিন দিয়ে ঘিরেছেন। সারি-সারি অনির্বাণ চিতার ছবি কেউ তুললে তাতে শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিধান দিয়েছেন। এই সমস্ত কিছুই যোগী সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে তীব্র করে তুলে শাসক দলের সমর্থন ভিত্তিতে ধাক্কা দেয়।
অনেক ভাষ্যকারের অভিমত হল, উত্তরপ্রদেশের এই পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল ২০২২ সালে হতে চলা বিধানসভা নির্বাচনের সেমিফাইনাল। ২০২২’র ফাইনালে বিজেপি রাজ্যের শাসন ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয় কি না তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে, হিন্দুত্ব দিয়ে যে আর সব সময় বাজিমাৎ করা যাচ্ছে না তা সুস্পষ্ট রুপে ধরা পড়ল – পশ্চিমবাংলা বিধানসভা এবং উত্তরপ্রদেশ পঞ্চায়েত, উভয় নির্বাচনেই।