একটা বাজেট বছর গড়িয়ে গেল তবু কোভিড ছাড়ে না। প্রধানমন্ত্রী বহু বড় বড় কথা বলেছিলেন, নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোভিডের মোকাবিলায় ভারত হবে 'আত্মনির্ভর'! রুখে দেওয়া দেখিয়ে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে! এরকম অনেক কিছু শুনিয়েছিলেন! আর আজ? কোভিডের প্রকোপ সবচেয়ে মারণঘাতী প্রতিপন্ন হয়েছে দুনিয়ায় যে প্রথম তিনটি দেশে, সেখানে ভারত ঘুরেফিরে রয়ে যাচ্ছে বরাবর। কোভিডের এই সংক্রমণে একদিকে জীবননাশ থামছে না, অন্যদিকে আরও অনেক দিক থেকে জর্জরিত হচ্ছে ব্যাপকতম জনজীবন। এ যন্ত্রণা কর্মহীনতার ভীড়ে পিষ্ট হওয়ার, নতুন করে কাজ উধাও হয়ে যাওয়ার; খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি,স্বাস্থ্য, শিক্ষার বঞ্চনা-প্রতারণার শিকার হয়ে চলার। এই দুঃসহ পরিস্থিতি জ্বলন্ত কিছু দাবি রাখে আশু উপশম পাওয়ার। দাবিগুচ্ছ উঠেছে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের উভয়পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রধান দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, যেহেতু রাজ্যওয়ারি সংগৃহীত রাজস্বের সিংহভাগের দখল নেয় কেন্দ্র। এই অবস্থায় খতিয়ে দেখা দরকার, কেন্দ্রীয় সরকার কি করছে, রাজ্য সরকার কি করছে? পরিস্থিতিতে এখন কোভিড ঝড়, লকডাউনের জেরে ঘনিয়ে আসা ভঙ্গুর অর্থব্যবস্থা, তার উপর ‘ইয়াসে’র তোড়ে জীবনযাপনের খোরাক যোগানোর সংকট আরও বাড়বে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন ভিটে মাটি ছাড়া, সহায় সম্বলহীন। কেন্দ্র গত বছরের আমফান ত্রাণের অর্থ বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে যথারীতি তীব্র বৈষম্য ও বঞ্চনা করেছিল। রাজ্যের তরফে যে পরিমাণ অর্থ ও দ্রব্যের দাবি করা হয়েছিল, তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দিয়েছিল মোদীর কেন্দ্র। আমফান ত্রাণের কিছু কিছু আত্মসাৎ করার ঘটনা ঘটেছিল সত্য, তবে মানুষের বিক্ষোভে তার অনেকটা ফেরত পাওয়া গিয়েছিল, সেসব ফেরত দেওয়াতে মুখ্যমন্ত্রীও চাপ দিয়েছিলেন। বিজেপি সদ্য সম্পন্ন হওয়া নির্বাচনে আমফান দুর্নীতি নিয়ে একপেশে রাজনীতি করেছে, জবাব দিতে পারেনি দুর্নীতির ছুতোয় রাজ্যের মানুষের ত্রাণের পাওনা অর্থ কেন্দ্র দেবে না কেন? শুধু কি তাই! রাজ্যের শাসকদের একচোখা নীতির কারণে কেন্দ্রের ঘোষিত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রকল্পের টাকা মার যেতে বসেছিল। আবার সেই মানুষের চাপেই রাজ্য সরকার বাধ্য হয় অযৌক্তিক অবস্থান বদল করতে, অগত্যা কৃষকদের নামের তালিকা পাঠানো শুরু করে। আর যে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার নতুন “তিন আইন'” এনেছে কৃষকদের সর্বস্বান্ত করতে, বিপরীতে কর্পোরেট পুঁজির থাবায় কৃষিকে তুলে দিতে, সেই বিজেপি পশ্চিমবাংলার কৃষকদের জন্য কতই না ‘দয়ার সাগর’ সাজার প্রচার চালিয়েছিল! ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি’ প্রকল্পের আর্থিক সাহায্যের ডালি সাজিয়ে। তারপর যেই নির্বাচনে বিজেপি হেরে গেল এখন কেন্দ্র এরাজ্যের কৃষকদের জন্য মাত্র এককালীন দু'হাজার টাকা করে দিয়ে হাত তুলে নিচ্ছে! অথচ প্রতিশ্রুতি ছিল আরও বেশি। বিগত বছরটির জন্য ছয় হাজার করে তিন কিস্তিতে দেওয়া হবে কৃষক পিছু মোট আঠারো হাজার টাকা। সংকট অনুপাতে এটুকু আর্থিক খয়রাতি এমন কিছু নয়। তারপর যদি তার শুধু মুড়োটা দিয়ে বাকী সব না দেওয়া হয় সেটা কাটা গায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতই। এতো চাষি সমাজের 'না হলেই নয়' অবস্থা সামাল দিতে যৎসামান্য অনুদান। তাও কেন্দ্রের এই প্রকল্প কেবল আবাদী জমির মালিক চাষিদের জন্য, ভাগচাষি-বর্গাচাষিদের জন্য নয়। কিন্তু শেষোক্ত বর্গের চাষিদেরও ঐ ‘সম্মান নিধি’ প্রকল্পের অর্থ পাওয়া উচিত। সেটা না দেওয়া মানা যায় না। বিজেপি বাংলার নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দেয় রেশনে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। যদিও মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরপরই গণবন্টণ ব্যবস্থার কোটা থেকে এক বিশাল জনসংখ্যাকে ছেঁটে দেয়, প্রাপকদের প্রাপ্য পাওয়া জনিত বিভিন্ন ভাগে বর্গভুক্ত করে। নানা বাহানায় এইসব উৎকট কর্তনকাণ্ড সংগঠিত হয়। এসব যে ভাবের ঘরে চুরি করে করা হয়েছিল তা সদ্য কয়েকটি রাজ্যে এক লপ্তে বিধানসভা নির্বাচনের চাপের মুখে পরোক্ষে মানতে হয়েছে। বিশেষ করে বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে কেন্দ্রের পরিচালক দলটি গণবন্টণ ব্যবস্থা মারফত পণ্যদ্রব্য সরবরাহের বিষয়ে নতুন কিছু প্রতিশ্রুতি দেয়। তা পুনর্বিবেচনার পরিচয় হিসেবে ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক। বিজেপি বলেছিল সুলভে চাল-গম-আটা সহ কেজি প্রতি ত্রিশ টাকায় ডাল, পাঁচ টাকায় চিনি, তিন টাকায় নুন দেওয়া হবে। কিন্তু নির্বাচন চুকে যাওয়ার পরে আর সেসবের নাম করছে না। অভাবী মানুষের হকের পাওনা নিয়ে ভোটের আগে-পরে এরকম ছিনিমিনি করতে দেওয়া যায় না। কেন্দ্রকে তার হিসাব চোকাতেই হবে। হিসাব আরও নেওয়ার আছে। গতবছর লকডাউনের ফাঁস চড়ানোয় ছিন্নমূল হয়ে যায়, বেঘোরে শেষ হয়ে যায় অগণিত পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন! কেন্দ্র তাদের খাদ্য ও নগদ অর্থ কিছুই দেয়নি, ঘরে ফেরার পরিবহন খরচ দেয়নি, তাদের তালিকা তৈরি করেনি। বছর চলে গেল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর শূন্যগর্ভ ঘোষণার। ‘এক বছরের মধ্যে – এক দেশ এক রেশন কার্ড’ – পলিসি কার্যকর করার! এবার আবার লকডাউনের সময়ে সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে, তাদের পরিবার-পরিজনদের আহারাদির জন্য গণখাবার শিবির করতে হবে। যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করে তাদেরকে নগদ অর্থও দিতে হবে। বিভিন্ন সংগঠন ও মঞ্চ থেকে দাবি তোলা হয়েছে মাথাপিছু মাসিক ন্যূনতম সাড়ে সাত হাজার টাকা করে দেওয়া হোক। অন্তত যতদিন কর্মসংস্থানের স্বাভাবিক পরিস্থিতি না আসে ততদিন। এই দাবি পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমগ্র অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের জন্য।
পশ্চিমবাংলার নব নির্বাচিত সরকার গত একবছর বিনামূল্যে রেশনে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করছে। এবার 'দুয়ারে রেশন' দেওয়ার পাইলট প্রকল্প শুরু করেছে। এছাড়া এখানে সরকারী আর্থিক সাহায্যের বিভিন্ন “শ্রী”, “সাথী” ও “বন্ধু” প্রকল্প চালু আছে; মুখ্যমন্ত্রী তিন বর্গের মহিলাদের জন্য তিন ধরণের মাসিক হাত খরচের প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন। কথা অনুযায়ী এসব যাতে দুর্নীতি ও বৈষম্য মুক্ত ভাবে চলে তার দায়িত্ব প্রতি পদে পদে রাজ্য সরকারের। অভাবী মেহনতী-পথবাসী ও অন্যান্য অংশের মানুষদের জন্য অতি সুলভে দৈনন্দিন তৈরি খাবারের কেন্দ্র চালু করা দরকার, রেশনে বিনামূল্যে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে।
এককথায়, আজকের পরিস্থিতি বিচার করে সাধারণ মানুষের হকের পাওনা সব দিতেই হবে।
বাংলার বিধানসভার নির্বাচন রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। টানটান উত্তেজনা এবং অনেক ধরনের বিচার বিশ্লেষন, হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন করা সবই চলেছে। নির্বাচন কমিশন, সমগ্র কেন্দ্রীয় সরকার, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার প্রধান প্রধান মন্ত্রী, সিবিআই, গোয়েন্দা বিভাগ, কেন্দ্রীয় বাহিনী সকলকে কাজে লাগানো হয়েছে। ৮ দফা নির্বাচন, সবকিছু করেও আরএসএস ও বিজেপি বাংলা দখল করতে পারেনি। বাংলার জনগণের গণরায় ঐতিহাসিক এবং যা বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক বোধ ও পরিপক্বতার স্ফুরণ ঘটেছে। রায়ে, আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের বিমূর্ত ও জোর করে সূত্রায়ন করা জমাটবন্ধ একটা ভুল ধারনা বাংলার জনগণ সম্পূর্ন প্রত্যাখ্যান করেছে। তা হল “মোদী ও মমতা” এক এবং “বিজেমূল” শব্দবন্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভীষণ ভাবে ছোট করে দেখা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় এবারেও বামপন্থী জনগণ ও কর্মীদের ২০১৯-এর মতো বিজেপির কোলে অনেক জায়গায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কিছু জায়গায় অল্প ভোট হয়ত ফিরে এসেছে। আরও চিন্তার বিষয় তূণমূল কংগ্রেস বিরোধী প্রচার করেও তাদের গণভীতের একটা অংশ বিজেপিকে রুখে দিতে তূনমুল কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছেন। আমরা সিপিএমের নির্বাচনী দিশায় ও নেতৃত্বের ভাষণের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী জোরালো অবস্থান দেখতে পাইনি বা তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। নতুনতর জোট বা মোর্চা গঠনের ফলে কি হল তার কোন মূল্যায়ন এখনো অবধি দেখিনি। এই সব নিয়ে গভীর আত্মানুসন্ধান করা দরকার। বামপন্থার স্বার্থে তা প্রয়োজনীয়। কেন একজনও সিপিএমের প্রতিনিধি বা কংগ্রেসের প্রতিনিধি বিধানসভায় যেতে পারলো না। এত বড় ধরাশায়ী অবস্থা হবে তা কেন সিপিএমের নেতারা বুঝতে পারলেন না। আমরা বারবার বলেছিলাম বিজেপি বাংলায় মূল শত্রু, তারা তা মানেনি। বাংলায় তারা ক্ষমতায় আসতে চলেছে এই দিবাস্বপ্ন দেখানো হল। আজ তার অনুসন্ধান নীচের কমিটিগুলির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা নীতিগত ভাবে বামফ্রন্টের ২০১৬ জয়ী আসনগুলিতে সমর্থন করেছিলাম। ভবিষ্যতে বামপন্থী আন্দোলনকে বাড়ানোর স্বার্থে। আমরা কখনোই সংকীর্ণতা দেখাইনি। আমরা তৃণমুল কংগ্রেসের সাথে কোনো আঁতাত করিনি। তা স্বত্বেও কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের কাছ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক ধরনের নেতিবাচক পোস্ট দেখতে হয়েছে। যা অবশ্যই ভালো নয়। এত অনীতিনিষ্ঠ বিতর্ক ও ব্যক্তিগত আক্রমণ বামপন্থী বিতর্কে আমরা কখনোই দেখিনি। কোন কোন সিপিএমের কর্মী ও সমর্থক যেভাবে আমাদের পার্টির প্রতিটি কথার ওপর বিরুপ মন্তব্য করছেন, তা বামপন্থী অভিধানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে, বামপন্থী সংস্কৃতিকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো। দায়িত্বহীনভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব কেন করতে হচ্ছে তারাই বলতে পারবেন। জানি না বাংলার গণরায়কে কেন ইতিবাচক হিসাবে দেখা হবে না। জনগণের কাছে থেকে কিছু নেওয়ার থাকে না বলে মনে করছেন। তা না দেখলে কোন শিক্ষা নিতেপারা যায় না। বামফ্রন্টের ক্ষমতায় থাকার চশমা যতদিন না সরাবে, ততদিন পরিস্কার ও স্বচ্ছ ভাবে দেখতে পারবেন না বাস্তব জীবনে কি হচ্ছে।
যে সমস্ত ভুল পদক্ষেপের জন্য ২০১১ সালে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ২০০৬ সালের বিজয়, আমরা ২৩৫, বলপূর্বক কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ ও তার পরিণতি ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে আমরা দেখলাম। আজও তার গভীরে গিয়ে আত্ম সমালোচনা হল না। নির্বাচন হল আমাদের নীতিমালা ও কাজের বিচারের আয়না। যেখানে আসল ছবি উঠে আসে। শুধু ‘চক্রান্তের তত্ব’ কথা বলে অনুসন্ধানকে কানাগলিতে নিয়ে যাওয়া যায়। যাক সে কথা। আমরা সবাই দেখলাম জনগণ এবং একমাত্র জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে তা আবারও আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। মোদীর "আসল পরিবর্তনের" আহ্বান বা তাদের “ভেক গনতন্ত্রের” দাবি ধোপে টেকেনি। ছল চাতুরী করে, কৃত্রিম ভাবে বা মিথ্যার বেসাতি করে কোনো মহৎ কাজ করা যায় না। আমাদের বাংলার এই নির্বাচনের ফলাফলে এটাও বোঝা দরকার কংগ্রেসের ‘জরুরী অবস্থা’ জারীর পর ৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের জাতীয় বিপর্যয়ের পালা শুরু হয়েছিল। কংগ্রেস তার জাতীয় ভাবমূর্তি হারিয়ে ফেলেছিল। সেই অবস্থা থেকে কংগ্রেস আর ফিরে আসেনি। বর্তমানে বিজেপির বাংলায় নির্বাচনী রায় এই রকম একটা সুদূর প্রসারি প্রভাব ফেলবে। ইতিমধ্যে তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গত বিহার বিধান সভার নির্বাচন থেকে শুরু, সাথে সাথে ত্রিপুরা ও উওরপ্রদেশের স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন। একই প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাস পর কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনে মোদী ও শাহ ম্যাজিক আর কাজ করবে না। ইতিমধ্যে মোদী ভাবমূর্তি ধাক্কা খেতে শুরু করেছে। তা মেরামত করা শুরু করতে হয়েছে। মোদীর কুমিরের কান্নাকেও মানুষ চিনতে ভুল করেনি। ভারতবর্ষের কৃষি ও কৃষককে কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া, শ্রমিক-কর্মচারীদের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া, জাতীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া এবং সর্বপরি দেশের স্বকীয়তা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো ভেঙে দেওয়া, সংবিধানকে নিজের মতো ব্যবহার করা, প্রভৃতি দিকগুলির জন্য দেশের জনগণ আর মোদী ও বিজেপিকে মেনে নিতে পারছেন না। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সোশ্যাল মিডিয়াতে এবং বিভিন্ন বুদ্ধিজীবিদের লেখাতেও মোদীর পদত্যাগের আওয়াজ উঠেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক রায় থেকে আমাদের সবার শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।
বাংলার জনগণের এই ঐতিহাসিক রায়কে ইতিবাচক হিসাবে বিচার করা উচিৎ। যে সমস্ত রাজনৈতিক পার্টি এবং জাতীয় সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্ব বাংলায় কলকাতা, নন্দিগ্রাম, সিংগুর, শিলিগুড়ি সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার আবেদন করে গেছেন। সাংবাদিক সন্মেলন করেছেন। বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন, লিবারেল বাম, বিভিন্ন ধরনের বিজেপি বিরোধী শক্তি সংগঠন, ব্যক্তি এই প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে আগামী দিনের জন্য কথা হোক। এই গণরায়ের ফলে নতুনভাবে যে সরকার এসেছে তাতে যে সমস্ত শক্তি যারা বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করেছে তাদের প্রচারের ভোটও আছে। মূলত বিজেপি বিরোধি ভোটই তূণমুল কংগ্রেস পেয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার এবার বিধানসভায় বিরোধী পক্ষ একমাত্র বিজেপি, তারা ৩ জন থেকে ৭৭ বিধায়ক হয়েছে। তাদের দিক থেকে ভালো। যারা তূনমুল কংগ্রেস বিরোধী প্রচার করে এবং নতুন ধরনের জোট করেও ব্যর্থ হয়েছে, কংগ্রেস ও বামপন্থীদের কোন প্রতিনিধি নেই। গভীর চিন্তার বিষয়। কিন্তু বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করে একটা শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেছে, আজকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। এবং বিধানসভার বাইরে সক্রিয় বিরোধী ভূমিকা নিতে তাদের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতা না পাওয়ার জন্য গণরায়ের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির পথে নেমেছে। গভীর ষড়যন্ত্র করে কখনো সিবিআই দিয়ে, কখনো প্রশাসনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে বিভিন্নভাবে অসুবিধায় ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। বিজেপির বাংলা দখল খুবই পরিকল্পিত ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের ভোটে মেরুকরণ করানো, তার জন্য বাংলার সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করা, বাংলার ঐতিহ্যপূর্ন বিভিন্ন দিককে হেয় করা, বাংলার প্রতিষ্ঠিত কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি আক্রমণ করা আমরা লক্ষ্য করেছি। এর সাথে সাথে কিছু জিনিস আমাদের ভাবতে হবে। যেমন, বাংলার ভোটের কিছু দিক অস্বীকার করা যায় না। তপশিলী ভোটে বিভিন্ন জেলায় (যারা একটা সময়ে বামপন্থীদের ভোট ব্যাঙ্কে ছিল) বিজেপি বড় থাবা বসিয়েছে। উত্তরবাংলার রাজবংশী জনগণের ভোটও ভালো পরিমাণে বিজেপির দিকে গেছে। যদিও মতুয়াদের ভোট নাগরিকত্ব দেওয়ার ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে বিজেপিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা অনেকটা ভেস্তে গেছে। ইতিমধ্যে ঠাকুর বাড়ি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তূণমুল কংগ্রেসের মথুয়াদের মধ্যে ভালোই ভোট বৃদ্ধি হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর তূণমূলল কংগ্রেসের প্রভাব বরাবরই ছিলো, বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির হামলার প্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুরা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে। যদিও তাদের বিভাজিত করার চেষ্টা করে আমাদের বামপন্থী বন্ধুরা, কিন্তু করেও তাতে কিছু লাভ হয়নি। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে আদিবাসী জনগণের ভালো অংশকে বিজেপি টেনে নিতে সমর্থ হলেও এবারে তৃণমূলের কিছু সংস্কার কর্মসূচী ও সোশ্যাল কাজের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের দিকে আদিবাসী জনগণকে বেশ কয়েকটি জেলায় টেনে নিতে সমর্থ হয়। ঝাড়গ্রামের তৃণমূল কংগ্রেস সাফল্য তা দেখিয়ে দিচ্ছে। মালদা এবং মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের ভিত বা ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে চলে গেছে। এবারের ভোটে মহিলাদের অংশ গ্রহণ বেশ লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে। ভোটার সংখ্যা মহিলা ও পুরুষের প্রায় সমান। মোদী বিভিন্ন সময় মমতা ব্যানার্জিকে অসন্মান, ও ব্যঙ্গ করে “দিদিও দিদি” এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। এবারে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে মহিলাদের ভোট ভালো পরিমাণে বেড়েছে। আমরা যদি আসন সংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভোটের ফলাফলে ২০১৬, বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা ছিল ৩২, সেখান থেকে ৯টাতে জয়ী বিজেপি , আর তৃণমূল কংগ্রেসে চলে গিয়েছে ২৩টা। আর কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ছিলো ৪৪, তার মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১৫টা। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২৯টা। অন্যদিকে গতবারের তৃণমূল কংগ্রেসের ২০৯ এর মধ্যে থেকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে ১৬০টা আসন। বাকি যে সাফল্য পেয়েছে মূলত বাম জোটের থেকে ৫২ আসন পেয়ে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বামফ্রন্টের হারানো আসন থেকে বিজেপি ও তৃণমুল কংগ্রেস সমান সমান, মহিলা ভোটের ৫০% তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে, বিজেপি ৩৬%. এই ধরনের ছবি দেখা যাচ্ছে। বাংলার ভোটে এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকগুলো ছাড়াও বাঙালির ভাবাবেগ কাজ করেছে। তার যথেষ্ট কারণ আছে। বিজেপি যেভাবে বাংলার ঐতিহ্যকে লাগাতার আক্রমণ করেছে তাতে সেটাই স্বাভাবিক। সঙ্ঘ’র মুখপত্র, স্বীকার করে নিয়েছে “মোদী ও অমিত শাহ বাংলায় বাঙালির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি।” বাংলার জনগণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোধ এবং রাজনৈতিক চেতনা বিজেপির সাথে মিলবে না। তাই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে, যে সমস্ত ইতিবাচক দিক আমরা লক্ষ্য করেছি তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের পরিকল্পিত ভাবে কাজ করতে হবে। বিজেপি এখনো ষড়যন্ত্র করে চলেছে যাতে বাংলায় আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটেছে এটা দেখানো যায়। নতুন সরকার যাতে কাজ শুরু করতে না পারে।
তাই আগামী দিনের লক্ষ্যে আমাদের কি কি করণীয় কাজ করতে হবে, তা নির্ধারণ করা খুবই জরুরী। ইতিবাচক চর্চা শুরু হয়েছে, পথে নামাও শুরু হয়েছে। কেন্দ্র সরকার বাংলায় কোভিড পরিস্থিতিতে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বজায় রেখে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে, মানুষকে বিপদে ফেলে, গণরায়কে নস্যাৎ করতে তৎপর। আমরা এখনো দেখছি, আমাদের কিছু বন্ধুরা এই রায়কে ইতিবাচক হিসাবে নিতে পারেনি। কিছু কিছু মন্তব্য বিজেপির সাথে মিলে যায়, তবে হ্যাঁ, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রীদের সিবিআইএর গ্রেফতারি নিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিহিংসা মূলক রাজনীতির বিরুদ্ধে সিপিএম নেতৃত্ব বক্তব্য তুলে ধরেছে। ভালো, বোধদয় ঘটবে আশা রাখি। বিধানসভার বাইরে বিরোধী হিসাবে বড় ভূমিকা আমাদের মতো পার্টিকে, অন্যান্য ইতিবাচক দল ও শক্তিগুলিকে নিতে হবে। রায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো বিচার করে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি গরিবের মধ্যে কিছু জায়গা করেছে। ২০১৯-এর পর থেকে শুরু হয়েছে। বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষ রাজনীতি ও হিন্দুত্ববাদী প্রচার ও কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিরোধী জনগণের জীবন্ত দাবি দাওয়া যুক্ত করে কৃষক জনগণের আন্দোলনে ইতিবাচক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমরা দিল্লির কৃষক আন্দোলনে দেখলাম, ইউপির যারা একসময় দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, তারাই এই কৃষক আন্দোলনে সামনে এসে মোদী ও বিজেপি বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠে এসেছে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি, কৃষক তার ইস্যু নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে হিন্দু ও মুসলিম বিচার করে না। বাংলার কৃষক আন্দোলন ও শহর-গ্রামে, শ্রমিক মেহনতী জনগণকে শক্তভাবে সামিল করে এগিয়ে যেতে হবে। শ্রেণির মানুষের মধ্যে যে জায়গা আরএসএস ও বিজেপি করেছে, তাকে শ্রেণীগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করতে হবে। যা বাংলায় জরুরি। বাংলায় এই ঐতিহ্য আছে, তাকে জাগিয়ে তুলে সচেতন প্রচেষ্টার বিস্তার ঘটাতে হবে। আজকের পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের আন্দোলনকে এই দিশায় পরিচালিত করা ও সময়োপযোগী। প্রয়োজনবাদী দিক থেকে বা জনবিচ্ছিন্ন কোনো আন্দোলনে ইতিবাচকভাবে জনগণের সাড়া পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, জেলায় জেলায় বিভিন্ন ধরনের, প্রগতিশীল শক্তি, লিবারেল বাম ও বামমনস্ক ব্যক্তি ও সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও দল, যারা প্রগতিশীল কাজকর্ম করেন, এই ধরনের মানুষজনকে নিয়ে কেন্দ্র ও বিজেপি বিরোধী আলোচনা সভা ও আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। জনমত গড়ে তোলার জন্য আজই ও এখনই উদ্যোগ দরকার। একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় বাংলা দিয়েছে, এটাকে ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতন প্রচেষ্টা না থাকলে মানুষের মন অন্য খাতে বয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাকে এখনই একটা বাস্তবে রূপ দিতে হবে।
তৃতীয়ত, এবারের নির্বাচনে মহিলাদের ব্যাপক অংশ গ্রহণ হয়েছে। বিজেপি মহিলাদের যেভাবে সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিতে বিচার করে তাতে বিজেপিকে দেওয়া মহিলাদের ভোটের হার খুবই কম। স্বাভাবিক ভাবেই এই মহিলাদের সংগঠিত করা উচিৎ। শুধু মহিলা ইস্যু নয়, অন্যান্য বিষয়ে মহিলাদের সামিল করার মনোভাব নিতে হবে। সমাজে মহিলাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিজেপিকে বাংলায় রুখে দিতে মহিলাদের সক্রিয় ভূমিকা থেকেছে। মূখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে গ্রামে গ্রামে মহিলাদের অবমাননা করার যোগ্য জবাব বিজেপি পেয়েছে।
চতুর্থত, বাংলার কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক দল ও ব্যাক্তিদের বিজেপি বিরোধী বড় ভূমিকা দেখা গিয়েছে। বিজেপি নেতাদের কাছ থেকে এদের সরাসরি অপমানিত হতে হয়েছে। এই গণরায়ের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করতে পারি না। আমরা কবি শঙ্খ ঘোষ ও ডক্টর অমর্ত্য সেনকে বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলতে দেখেছি। নাট্যকার কৌশিক সেনের প্রতিবাদী ভূমিকাও নজর কাড়ে। বাংলার এই ঐতিহ্য আজও সচল-সজাগ। বাংলায় একুশের ডাকে সাড়া দিয়ে নাট্যকার, কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সহ অনেকেই সামিল হয়েছেন। তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেতন প্রচেষ্টা খুবই দরকার। এই সমস্ত উপাদানগুলি বাংলার ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বিজেপি বিরোধী ভূমিকাকে সামাজিক রূপ দিতে পারে। আমাদের বাংলার এই ধরনের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবেই। বিজেপির সংবিধান বিরোধী ও দেশের জনগণের শত্রুর মতো কাজ করে, তারাই আন্দোলনকারী নেতা ও কর্মীদের দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যাদের কোনো যোগসূত্র নেই, তারাই নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসাবে ঘোষণা করে। বাংলার জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে ঐতিহাসিক ভাবে যুক্ত। যেখানে বিজেপির কোনো স্থান নেই।
পঞ্চমত, বিজেপি-বিরোধী প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন ছাত্র ছাত্রী সহ যুব সমাজের বড়ো অংশ। এই ধরনের আন্দোলনে তাদের অগ্রনী ও সচেতন প্রচেষ্টায় এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। রায় থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা এখন কোভিড অতিমারীতে সেবায় নেমে পড়েছে। রাতদিন তারা কোভিড যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে সক্রিয়। ফ্যাসিবাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাথে সাথে মানুষের সেবায় এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় সংকল্পবদ্ধ হওয়া দরকার। পরিশেষে, আবারও বলতেই হয় বাংলার গণরায় ঐতিহাসিক এবং বাংলা বিজেপিকে রুখে দিয়েছে, কিন্তু ওরা ৩ থেকে ৭৭ হয়েছে। সেটা মাথায় নিয়েই আমাদের এগুতে হবে। বাংলার গণরায় আমাদের দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। বামপন্থী আন্দোলন নবরুপে উত্থান জরুরী। রাজ্যে গণরায়ে যে সরকার এসেছে, তার সাথে জনগণের দাবি দাওয়া নিয়ে লড়াইকে জারী রাখতে কোনো দ্বিধার জায়গা নেই। কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখে, আন্দোলনকারী বিরোধী পক্ষ হয়ে উঠতে হবে।
-- কার্তিক পাল
২৫ মে ১৯৬৭, পৃথিবী প্রথমবার শুনেছিল নকশালবাড়ির কথা। দার্জিলিঙের এক গ্রামে বিপ্লবী জাগরণের আগমনবার্তা ঘোষিত হয়েছিল যা ছিল কৃষক জনগণের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই, যাকে দমন করতে এগারোজন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যারমধ্যে ৯ জন নারী, একজন পুরুষ ও দুই শিশুও ছিল। ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় কাঁপন ধরিয়ে নকশালবাড়ির স্ফুলিঙ্গ আসমুদ্র হিমাচলের সর্বাধিক নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ছিল।
এই বিদ্রোহকে দমন করতে তৎকালীন সরকার নির্মম নির্যাতন নামিয়ে আনে। বিদ্রোহের আগুনের মধ্যে গড়ে ওঠা এক নতুন কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-কে মুছে ফেলতে তার নেতৃবৃন্দ, সংগঠক, সদস্য এমনকি সমর্থকদের হত্যা ও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সিপিআই(এমএল) নতুন প্রাণশক্তিকে সাথে নিয়ে ফিরে আসে। নকশালবাড়ি আজ ভিন্নমত প্রকাশের অদম্য সাহসের এক অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে, ফ্যাসিস্ট শাসনের ভারতে ভিন্নমত পোষণকারী যে কোনো সাহসী মানুষদের আজ ‘শহুরে নকশাল’ (urban naxal) বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
ভারতের নিপীড়িত জনগণের দৃঢ়তা প্রদর্শনের গৌরবগাথাকে স্মরণ করার মুহূর্তে বিপুলভাবে পরিবর্তিত ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং আজকের ভারতে নকশালবাড়ির চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ভারতের খন্ডিত স্বাধীনতালাভের দু’দশক পর ১৯৬৭ সালে সংগঠিত হয়েছিল নকশালবাড়ি, যখন ভারতের নতুন প্রজাতন্ত্র ও নয়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারা প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কারণে ভারতজুড়ে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সেই সময় কংগ্রেস নির্বাচনের ময়দানে মাটি হারাতে শুরু করেছিল, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
চুয়ান্ন বছর পরে, পশ্চিমবঙ্গে এমন একটি নির্বাচন হল যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে না পারলেও দার্জিলিং-এ নির্বাচনে বাকিদের মুছে দিয়েছে এবং বামবিহীন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা যদি ২৫ মে ১৯৬৭ সালের শহীদদের নাম স্মরণ করি তবে এগারো জন শহীদের মধ্যে চারজন ছিলেন (ধনেশ্বরী দেবী, সরুবালা বর্মণ, সোনামতী সিংহ ও ফুলমতী সিংহ) রাজবংশী সম্প্রদায়ের, অন্যরা তপশিলি মেচ ও ধিমাল সম্প্রদায়ের এবং এই সম্প্রদায়গুলি বর্তমানে সংঘ-বিজেপি নেটওয়ার্ক দ্বারা ভীষণই প্রভাবিত। নকশালবাড়ির বিপ্লবী উত্তরাধিকারকে আজকের বাংলার এই কঠিন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে, রূপান্তর ঘটাতে হবে এবং বাম শিবির পুনর্নির্মাণে নেতৃত্বে আসতে হবে।
নকশালবাড়ির আহ্বান ছিল বিপ্লবের আহ্বান, মানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার ও জনগণের সেবা করার আহ্বান। আজকের চ্যালেঞ্জ হল কোভিড ১৯ এবং মোদী২-এর বিপর্যয়কর আঘাত থেকে ভারতকে বাঁচানো। ভারতে সরকারী হিসেবে কোভিডের মৃত্যুসংখ্যা এখন ৩,০০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। গত দু’মাসে এই সংখ্যাটি দ্বিগুণ হয়েছে। ভারতে প্রতিদিনের মৃত্যুসংখ্যা সম্ভবত বাকি বিশ্বের মোট মৃত্যুর চেয়ে বেশি। এক বিপুল পরিসংখ্যান সরকারী গণনা এবং রিপোর্ট এর বাইরে থেকে যাচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে গঙ্গায় ভাসমান মরদেহ ও নদীতীরে গণকবরের ঘটনা এবং বিহারে মাত্র একটি গ্রাম থেকে শতাধিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে! যদি ধরে নেওয়া যায় আসল পরিসংখ্যান সরকারী গণনার চেয়ে পনেরগুণ তবে আমরা ইতিমধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোককে হারিয়েছি যা ভারতে সারা বছরে মৃতের সংখ্যার অর্ধেক।
২০২০ সালের শুরু থেকে বিশ্ব মারাত্মক কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় কার্যকর ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষায় ছিল। ২০২০’র শেষ দিকে ভ্যাকসিন এসে পৌঁছায় এবং শক্তিশালী দেশগুলি ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী কোভিড ভ্যাকসিনের উৎপাদন এবং সরবরাহের সিংহভাগ কুক্ষিগত করেছে। বিশ্ব ভ্যাকসিনের তীব্র বৈষম্য এবং অন্যায়ের অধীনে চলছে। মোদী সরকার, যা ভারতকে বিশ্বের ফার্মাসি হিসাবে বর্ণনা করে, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কিছুই করেনি। আত্মনির্ভর ভারত সম্পর্কে বড় বড় কথা বলা সত্ত্বেও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সার্বজনীন টিকাদান নিশ্চিতকরণ ও প্রয়োজনীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন তৈরি বা সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এরা কিছুই করেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩% ভারতীয়কে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের অধীনে একে ‘কোভিড গণহত্যা’ ছাড়া কি নামেই বা অভিহিত করা যায়! নকশালবাড়ির বিপ্লবী চেতনা অবশ্যই এই গণহত্যা প্রতিহত করার লড়াইয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা ও দিশা দেবে।
নকশালবাড়ি প্রাথমিকভাবে ছিল এক কৃষক বিদ্রোহ। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ থেকে কৃষিকে বাঁচাতে ভারতবর্ষ আজ এক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের মাঝে রয়েছে। দিল্লী সীমান্তে কৃষকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্ণা অবস্থান ২৬ মে ২০২১ সালে ছয় মাস পূর্ণ করেছে। কৃষকরা যখন মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক খামার আইন বাতিলের পক্ষে লড়াই করছে তখন শ্রমিকরা বেসরকারীকরণ এবং মোদী সরকারের নয়া শ্রমকোডের মাধ্যমে কর্পোরেট দাসত্ব ও অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়ার মোদী সরকারের প্রয়াসকে প্রতিহত করছে। আজকের ভারতবর্ষে যুবক এবং ভারতের প্রথম সারির কোভিড যোদ্ধা – চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ড্রাইভার, স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য রয়েছে কেবলমাত্র অন্যায় ও অনিশ্চয়তা। সারা দেশের অক্সিজেন ও তাজা বাতাসের অভাবে দমবন্ধকরা পরিস্থিতির মতোই এক শ্বাসরোধকারী হিন্দুরাষ্ট্রের প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে সংঘ-বিজেপি। জনগণের মোহভঙ্গ ঘটছে, এক জনপ্রিয় বিদ্রোহের জন্য শর্তগুলি পরিপক্ক হচ্ছে। জীবন ও মৃত্যুর এই লড়াইয়ে, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট কোম্পানিরাজ এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জনগণের মধ্যকার এই লড়াইয়ে নকশালবাড়ির চেতনা আমাদের উজ্জীবিত করতে থাকবে।
- কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন
হাওড়া
কোভিড পরিস্থিতির বিধিনিষেধ মেনে হালদার পাড়ায় নকশালবাড়ি দিবস পালিত হয়। রক্তপতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন রতন দত্ত ও অন্যান্য কমরেডরা। নকশালবাড়ি দিবসের তাৎপর্য এবং বালীতে শহীদবেদী ভাঙার প্রতিবাদে ধিক্কার জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত। দূর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। নকশালবাড়ি দিবসের শহীদ ও বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে সভার কাজ শেষ হয়।
হুগলি
বালি গ্রামাঞ্চলে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে ২৫ মে ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয়। কর্মসূচীর শুরুতে রক্তরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন মাধব মুখার্জী, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন প্রবীণ কমরেড দেবাশিস চ্যাটার্জি ও পার্থ সারথি মিত্র। পুস্প দিয়ে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষে সুষমা মুখার্জি, আরওয়াইএ’র পক্ষে প্রদীপ মাখাল পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সাংস্কৃতিক কর্মী আশিস রায় চৌধুরী সহ পার্টির সদস্য ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। সভায় বক্তব্য রাখেন পার্থ সারথি মিত্র ও মাধব মুখার্জী। বক্তারা নকশালবাড়ির ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন এবং ভারত জুড়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির যে আক্রমণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান সাধারণ মানুষ ও কর্মীদের উদ্দেশে।
নকশালবাড়ির বীর শহীদের এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বীর সৈনিকদের উদ্দেশ্যে নীরবতা পালন করা হয়।
সভায় দাবি তোলা হয়,
বালি কৈলাশ ব্যানার্জী লেনে ২৪ মে যেখানে পার্টির শহীদ বেদী ভাঙা হয়েছিল, নকশালবাড়ি দিবসে সেখানেই পালিত হল কর্মসূচী। ধিক্কার জানানো হয় বেদী ভাঙার ঘটনাকে। পুনরায় সেখানেই শহীদ বেদী তৈরি করার ঘোষণা করা হয়। এলাকায় পোস্টারিং ও সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সভা চলে। উপস্থিত ছিলেন বালি-বেলুড় লোকাল সম্পাদক নিলাশিস বসু। প্রতিবাদে ধিক্কার জানিয়ে বক্তব্য রাখেন দিলীপ দে, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সংক্ষিপ্ত কর্মসুচী শেষ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন নবীন সামন্ত, তপন সেখ ও ভোলা গুচ্ছাইত সহ অন্যান্যরা।
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেও বাঙ্গালপুরে নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয়।
উত্তর ২৪ পরগণা
উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘরিয়া জেলা কার্যালয়ে ৫৪তম নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয়। প্রধান শ্লোগান ছিল বিনামূল্যে সবাইকে ভ্যাক্সিন দাও, সেন্ট্রাল ভিস্তা বন্ধ কর। এই সময় কোভিড ভলেন্টিয়ার্সদের কাছে ফোন আসে বেলঘরিয়া, বিটি রোড, গভঃ কোয়ার্টার থেকে একজন করোনা রগীকে সাগর দত্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে ৪ জন করোনা যোদ্ধা দু’চাকার যান নিয়ে রোগীর বাড়িতে চলে গেলেন। এই ছাত্র-যুবদের উৎসাহ ও এনার্জি এবং মানুষের পাশে থাকার যে প্রচেষ্টা, তা শিক্ষনীয়। এই সমস্ত ছাত্র-যুবদের রক্তিম অভিনন্দন।
বর্ধমান
পুর্ব বর্ধমান জেলায় ২৫মে নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয়। নকশালবাড়ির বীর শহীদদের স্মরণে এবং নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের ৫৫তম দিবস করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই জেলার বিভিন্ন ব্লকে উদযাপন করা হয়।
কালনা ২নং ব্লকের অকালপোষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় শহীদবেদীতে মাল্যদান ও এক মিনিট নিরবতা পালন ও লাল ঝাণ্ডা হাতে শ্লোগান ও বক্তব্য রাখার মাধ্যমে নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ও মোদীর পদত্যাগের দাবি তোলা হয়। সমস্ত কর্মসূচী পরিচালনা করেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কালনা লোকাল কমিটির সম্পাদক রফিকুল ইসলাম।
মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট অফিসে রাজ্য কমিটির সদস্য আনসারুল আমন মন্ডলের নেতৃত্বে নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয়।
পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে জেলা কমিটির সদস্য সমীর বসাকের নেতৃত্বে নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয়। পুর্বস্থলী ১নং ব্লকের ইসলামপুর গ্রামে জিয়াদুল সেখের উদ্যোগে নকশালবাড়ি দিবস পালন হয়। কাটোয়া ২নং ব্লকের সাহাপুর গ্রামে স্বপন মণ্ডলের নেতৃত্বে নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হয়। কমরেড ঠাকুরদার উদ্যোগে সদর ২নং ব্লকের শক্তিগড়ে নকশালবাড়ি দিবস পালন হয়। জামালপুর ব্লকের আজাপুর গ্রামে ইন্দ্র বাঙ্গালের উদ্যোগে নকশালবাড়ি দিবস পালন হয়। বর্ধমান শহরে শ্রীকান্ত রানার উদ্যোগে নকশালবাড়ি দিবস উদযাপন করা হয়।
হারবার্ট এর পর নকশালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতি, রাষ্ট্র ও বিপ্লবের আঙ্গিনায় নবারুণ আবার ফিরলেন ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’তে। মাঝে লিখেছেন ‘ভোগী’। হারবার্ট এ নকশালবাড়ির যোদ্ধা বিনু ছিল এক পার্শ্ব চরিত্র আর নায়ক হারবার্ট তাতে নেহাতই ক্ষীণভাবে ক্ষণিক সময়ের জন্য যুক্ত। ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’র নায়ক রণজয় কিন্তু সরাসরি নকশালবাড়ি রাজনীতির মানুষ, তার স্মৃতি আর সত্তা বিপ্লবী ভাবনায় জারিত। একদা গেরিলা যোদ্ধা ও বর্তমানে মানসিক ভারসাম্য হারানো প্রৌঢ় যে রণজয়কে আমরা এই আখ্যানে দেখি সে সত্তরের আগুনঝরা সময়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে রণে নেমেছিল এবং ধাক্কার মুখে পড়েছিল। রণজয় ও তার বিপ্লব প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের তীব্র দমননীতি এবং আরো কিছু কারণে আপাত পরাজিত কিন্তু লড়াইয়ের অঙ্গীকারে তারপরেও আত্মজাগ্রত। সময়টা সত্তরের পর কেটে গেছে আরো পঁচিশ বছর। কিন্তু ১৯৯৪-তে, যে বছর সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারও আপোষ করে নিল কেন্দ্রের নয়া উদারনীতির সঙ্গে, যখন রাষ্ট্রের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য লুকিয়ে রাখা রাইফেলের স্তুপের ওপর উঠে গেল ফ্ল্যাটবাড়ি, সে বছরও রণজয় গেরিলা যুদ্ধ আর বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাতেই নিবিষ্ট। ‘বাস্তবতা’ মেনেই সমাজ সংসার আর পারিবারিক শুভ্যানুধায়ীদের তৎপরতায় তার স্থান হয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু সেখানে থাকলেও বিপ্লবের নির্মম শত্রু, রাষ্ট্রের সতর্ক পাহারাদার সারমেয়গণ, যেমন দেবী রায়ের ডানহাত বসাক, তার ভয় থেকে মুক্ত হতে পারে না, কারণ ‘শ্রেণিশত্রু লিক্যুইডেট’ করার কাজ শেষ হয়নি।
যুদ্ধ পরিস্থিতি উপন্যাসের নায়ক রণজয় বস্তুত বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার এক এমবডিমেন্ট। তার চেতনায় ভীড় করে ছিল, আছে, চিরকাল থাকবে রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, মার্কিন আগ্রাসন ও ন্যাপাম বোমার মুখে ভিয়েতনামের প্রতিবাদী প্রতিরোধ, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম, নকশালবাড়ির বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, কমরেড লেনিন, কমরেড স্ট্যালিন, কমরেড মাও সে তুং, কমরেড ও শ্রদ্ধেয় নেতা চারু মজুমদার। ভীড় করে আছে অসংখ্য সহযোদ্ধা কমরেড যারা স্বপ্ন দেখেছে, লড়াই করেছে, অত্যাচারিত হয়েছে, শহীদ হয়েছে – বারাসাতে, বেলেঘাটায়, বরানগরে, কাশীপুরে, সন্তোষপুরে, মেদিনীপুরে, মুর্শিদাবাদে, পুলিশ লক আপে, ময়দানে, দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে। বস্তুতপক্ষে ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসটি একই সঙ্গে সত্তরের উত্তুঙ্গ দিনকালের বিশ্বস্ত দিনলিপি আবার আবহমান বিপ্লবী স্বপ্নের চিরায়ত নির্যাস হিসেবে আমাদের সামনে হাজির থাকে।
‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসে একটানা কোনও কাহিনী নেই। আছে রণজয় ও তার কাছাকাছি থাকা কিছু মানুষের জীবনের টুকরো টুকরো কিছু কথা। রণজয় এর মধ্য দিয়ে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতিকেই আসলে নবারুণ এখানে সামনে এনেছেন। প্রত্যক্ষত নকশালবাড়ি আন্দোলন এই যুদ্ধ পরিস্থিতির কেন্দ্রে, কিন্তু তাকে ঘিরে আছে আরো আরো যুদ্ধ পরিস্থিতি, যার কোনোটা রাশিয়ার পেট্রোগ্রাডে, কোনোটা চীনে লং মার্চে, কোনোটা ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, আবার কোনোটা স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে, কোনোটা নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চলমান। আখ্যানকার নবারুণ ব্যক্তিগতভাবেও যে নকশালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতি দ্বারা কতটা প্রানিত হয়েছিলেন সেটা বিভিন্ন সময়ে নানা সাক্ষাৎকারে খোলাখুলি জানিয়েছেন। ১৯৯৮-এ ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন “সত্তরের আন্দোলন দ্বারা যে আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম একথা তো সবাই জানে। আমার রেসপন্সটা কিন্তু ছিল লেখক হিসেবেই। আমার যেটা দায় সেটা আমি লেখা দিয়েই পূরণ করে দিয়েছি। সত্তরের ত্যাগটা যদি আমাদের এখানে কেউ অস্বীকার করে বা ভুলে যায় তাহলে সে খুব অন্যায় কাজ করবে”। [নবারুণ ভট্টাচার্যর উপন্যাস সমগ্রর গ্রন্থ পরিচিতি থেকে গৃহীত]
উপন্যাসের মেরুদণ্ড যুদ্ধ পরিস্থিতি হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবেই সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও গেরিলা রণনীতি নিয়ে বিস্তৃত বয়ান আছে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর্বে বিশেষত প্রথম দিকে চারু মজুমদারের নির্দেশ ছিল ঘরোয়া অস্ত্র ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষকদের মধ্যে থেকেই বানিয়ে নিতে হবে আর্মড ইউনিট। চেয়ারম্যান মাও শিখিয়েছিলেন অস্ত্র যেন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ না করে, রাজনীতি যেন অস্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মধ্যবিত্ত স্তর থেকে আসা বুদ্ধিজীবী কমরেডদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দিকে একটা ঝোঁক ছিলই। রণজয় চারু মজুমদারকে বোঝার চেষ্টা করেছে। “রাত করে কোনও সভা? সেখানে গেরিলা অ্যাকশন সম্বন্ধে কমরেড মজুমদারের কথাগুলো বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করা? বুদ্ধিজীবী সংগ্রামী হিসেবে সঙ্গে একটা ছোট পিস্তল ছিল? কিন্তু কমরেড, লড়াই এর এই স্তরে কোনোরকম আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা উচিত নয়। রণজয় কুপির আলোটার দিকে এগোয়। গেরিলা ইউনিটকে সম্পূর্ণভাবে দা, বল্লম, সরকি, কাস্তের ওপর আস্থা রাখতে হবে। না কমরেড, এটা দেশী বন্দুক কেনা বা তৈরি করা বা বন্দুক দখলের পক্ষে উপযুক্ত সময় নয়। হাতে বন্দুক পেলেই কি আমরা দখলে রাখতে পারব? না। পুলিশ ঠিক ওগুলো দখল করে নেবে”। আন্দোলনের পরবর্তী পর্বে রাষ্ট্রের দমননীতির বিরুদ্ধে রণকৌশল বদলাতে হয়। বন্দুক দখল ও ব্যবহারের ওপর জোর পড়ে। “ওখানে একটা লোকাল অপারেশন চলছে। তাকে প্রতিহত করতে, কোণঠাসা করতে চূর্ণ করতে দরকার অস্ত্রের। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে চীনা গণমুক্তি ফৌজ ৩২০টি রাইফেল নিয়ে বিপ্লবী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা না হয় ৬০টি রাইফেল আর ২০০টি পাইপগান নিয়ে আমাদের প্রথম গণমুক্তি ফৌজ তৈরি করব”।
মাও সে তুং এর গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত নির্দেশিকাকে রণজয়ের ভাবনাসূত্রে সরাসরি তুলে এনেছেন নবারুণ। “ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলতে হলে প্রথমে চাই একটি স্থায়ী সৈন্যবাহিনী এবং চাই রাজনীতি সচেতন জনতা। এই দুটি শর্ত পালিত হলেই টেরেনের প্রশ্ন আসে। টেরেনের প্রশ্নের দুটি দিক আছে। একটা প্রাকৃতিক এবং অন্যটা নিজেদের হাতে তৈরি করা। সমতলভূমিতে ঘাঁটি এলাকা হতে পারে। তার প্রমাণ জাপ-বিরোধী যুদ্ধের সময় পিকিং শহরের উপকন্ঠে সাতটি এরকম ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল”।
গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলনের ওপর ভর করেই এগোতে চেয়েছিল নকশালবাড়ির মুক্তিসংগ্রাম, আর তাই ছাত্র যুবদের ডাক দেওয়া হয়েছিল ‘গ্রামে চলো’। তরুণ শিক্ষক, ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র রণজয় এই ডাকে সারা দিয়েই গিয়েছিল উত্তরবঙ্গে। গিয়েছিল শ্রদ্ধেয় নেতার নির্দেশ মেনে ‘ভূমিহীন কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হতে’। এরকমই আরো অজস্র নবীন প্রাণ সাথী হয়েছিল রণজয়ের। বাস্তবের এক চরিত্র যাদবপুরের স্নাতকোত্তরের বাংলা বিভাগের ছাত্র, সম্ভবনাময় সাহিত্যিক তিমির বরণ সিংহর কর্মকাণ্ড ও শহীদ হবার প্রসঙ্গ এখানে এনেছেন নবারুণ। এসেছে বাস্তব ও বাস্তবকল্প এরকম আরো অনেক চরিত্র।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে ‘শোধনবাদী চিন্তা’র মোকাবিলা করেই এগোতে হয়, নকশালবাড়ি আন্দোলন ও তার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই দিশা ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে শুধু নয়, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনেই সতর্কবার্তা হিসেবে বারবার এসেছে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে নবারুণ এখানে সেগুলি ছুঁয়ে গিয়েছেন। কমিউনিস্ট শিবিরের মধ্যেকার ‘টু লাইন স্ট্রাগল’ বস্তুতপক্ষে এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই লড়াইকে রণজয়ের আত্মস্থ করার সূত্রে। রণজয় স্মরণ করে মাও-এর সেই অমোঘ উক্তি। “বিপ্লব কোনও ভোজসভা নয়। সূচিশিল্প বা প্রবন্ধ রচনা নয়”। রণজয় তার পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে জানে “বিপ্লবের পথে শ্রেণি শত্রুরা ছাড়াও, মেকি বিপ্লবী ও দালাল গুপ্তচরদের বাধা থাকবেই – সেই কাউটস্কি, বার্নস্টাইন থেকে শুরু করে মেনশেভিক, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিন, ট্রটস্কি, লি শাও চি-দের কথা ভুললে চলবে না। ভুললে চলবে না ডাঙ্গেচক্র, নয়া সংশোধনবাদী ও খোকনচক্রের কথা”।
তবে রণজয় যাদের শোধনবাদী পণ্ডিত বলেছে, তাদের বই থেকেও প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে কোনও ছুৎমার্গ দেখায়নি। ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকারের কথা এখানে এসেছে। বস্তুতপক্ষে যুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলার এক বিরাট পাঠ প্রস্তুতির তালিকা হাজির করেন নবারুণ। ছেলে কোবা পড়বে এসব বই, প্রস্তুত হবে আগামী এক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য এমনই ভাবে রণজয়। “কোবা বড় হয়ে ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ পড়বে। চাপায়েভের গল্প পড়বে। ‘ধীরে বহে ডন’ ও ‘সাগরে মিলায়ে ডন’ পড়বে। পড়বে ডাইসন কার্তার এর সোভিয়েত বিজ্ঞান, লিও কিয়াচেলি-র ‘নতুন দিনের আলো’, ডিয়ানা লেভিন এর সোভিয়েত রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা, দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ছোটদের সোভিয়েত’, তিন খণ্ডে অমল দাশগুপ্ত, রবীন্দ্র মজুমদার ও অনিল কুমার সিংহের অনুবাদে ১৯৪২ সালের স্ট্যালিন পুরস্কার পাওয়া ‘পারীর পতন’, লু সুন, লাও চাও, তিৎ লিঙ ও অন্যান্য পাঁচজনের লেখা এগারোটি গল্প, নীহার দাশগুপ্তের অনুবাদে গোর্কির নবজাতক ...”। ছাত্র কৌশিক কে ইতিহাসের তরুণ শিক্ষক রণজয় পাঠক্রমের বাইরে গিয়েই এক ব্যাপ্ত জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, পড়তে দিয়েছিল অনেক বই। “রণজয় কৌশিককে একটার পর একটা বই পড়তে দিত। ঘন্টার পর ঘন্টা ওকে যুদ্ধের গল্প, স্তালিনগ্রাদ, লং মার্চ, ভিয়েতনাম, কিউবার মুক্তিযুদ্ধ বর্ণনা করে যেত”। রণজয়ের স্মৃতি আর সত্তার মধ্যে সংযোগের উপায় হিসেবে রাস্তা থেকে খুঁজে পাওয়া মানুষটিকে অনেক দিন আগে তারই দেওয়া বইগুলি দেখানোর কথা ভাবে কৌশিক। “ কৌশিকের মনে হল রণজয়দার সই করা একটা বই নিয়ে গিয়ে বলবে যে বইটা চিনতে পারছে কিনা। যেমন, ভিলহেলম লিবনেখত এর ‘অন দা পলিটিকাল পোজিশন অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’ বা কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে ক্লারা সেৎকিন এর ‘আমার স্মৃতিতে লেনিন’ অথবা ‘রিডার্স গাইড টু দা মার্কসিস্ট ক্লাসিকস’ – মরিস কনফোর্থের – লরেন্স অ্যান্ড উইশার্ট লিমিটেড, ১৯৫৩ বা গিওর্গি দিমিত্রভের’ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব দা ওয়ার্কিং ক্লাস এগেন্সট ফ্যাসিজম”।
একটি বিপ্লব প্রচেষ্টা শত্রুর আক্রমণ ও অন্যান্য কারণে কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এজন্যই যারা নকশালবাড়ি আন্দোলন তথা ভারতে বিপ্লব প্রচেষ্টার পোস্টমর্টেম শুরু করে দিয়েছিলেন, নবারুণ বা তার উপন্যাসের নায়ক রণজয় তাদের বিপ্রতীপ মেরুতে অবস্থান করেন। বাস্তবের মাটিতেও আমরা দেখেছি সত্তরের ব্যর্থতা ও ভুলগুলি থেকে নিজস্ব নিজস্ব বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিক্ষা নিয়ে, ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু দৃপ্ত বলিষ্ঠতায় বিপ্লবী গণ আন্দোলনগুলি গড়ে উঠছে, বিহারের আরা ভোজপুরের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত হিন্দি বলয়ে, অন্ধ্রের বারুদ বিস্ফোরিত হচ্ছে আদিবাদী বাসভূমিগুলিতে। গণ আন্দোলনের ঢেউয়ে ঢেউয়ে রাষ্ট্রের দমন পীড়নকে উপেক্ষা করে নকশালবাড়ির শপথকে, তেভাগা তেলেঙ্গানার উত্তরাধিকারকে মনে রাখা হচ্ছে। এজন্য দরকার ছিল সত্তরের ধাক্কার পর সংহত হবার, তৈরি হবার জেদটা। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকেও এরকম ধাক্কা ও পুনর্গঠনের পর্বের মুখোমুখি হতে হয়েছে। চীনে সাংহাই বিপর্যয়ের পর বা রাশিয়ায় ১৯০৫-এর বিপ্লবী আন্দোলনের সাময়িক স্থিতাবস্থার পর এরকম পরিস্থিতি এসেছিল। পিছু হঠার জন্য নয়, নতুন শুরুর প্রস্তুতির জন্যই বিপ্লবী আন্দোলনে কখনো কখনো ‘োয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক’ জাতীয় কৌশলের দরকার হয়। এই উপন্যাসে লেনিনের শিক্ষাকে সরাসরি সামনে আনা হয়েছে আগামী দিনে রাষ্ট্র ও বিপ্লবের আরেকটি নতুন অধ্যায় লেখার জন্যই। “পৃথিবীব্যাপী বিপ্লবের প্রথম জলোচ্ছ্বাস সরে গেছে, দ্বিতীয়টি এখনো ওঠেনি। এ বিষয়ে কোনোরকম বিভ্রম পোষণ করা আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক হবে। আমরা সম্রাট জারেক্স নই যিনি সমুদ্রকে শেকল দিয়ে আঘাত করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনা পরম্পরাকে এইভাবে বোঝার অর্থ কি চুপ করে বসে থাকা, অর্থাৎ লড়াই পরিত্যাগ করা? ... আমাদের তৈরি হতে হবে, খুব ভালো করে তৈরি হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে বিপ্লবের ঢেউ এলে তাকে সজ্ঞানে ও সবলে সম্যকভাবে কাজে লাগাতে পারি”।
-- সৌভিক ঘোষাল
স্বাস্থ্য গণদ্রব্য হিসেবে পরিগণিত হওয়া উচিৎ হলেও, কালানুক্রমিকভাবে স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকিকরণ করা হয়েছে। পরিষেবার বাণজ্যিকিকরণ করা হলে তা নিয়ে ফাটকা হবে, ‘কালোবাজারি’ হবে। অবশ্য কালোবাজারি, মুনাফাবাজি, ফাটকা এই সমস্ত বিষয়গুলিতো মুক্তবাজারের অর্থনীতিতে অপরাধ থাকে না। ফলে অবাধ অর্থনীতিকে সার্বিক মেনে নিলে গণদ্রব্য ব্যতীত অন্য সকল দ্রব্যই অবাধ অর্থনীতির নিয়মে চলবে, অর্থাৎ সেগুলির দাম বাজার নির্ধারিতই হবে। যেহেতু স্বাস্থ্যের বাণিজ্যকিকরণ হয়েছে তাই হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসা, অক্সিজেন, ওষুধ, আইসিইউ প্রভৃতির প্রাপ্যতা ও মূল্য বাজারের নিয়ম মেনে হবে তাতে কেউ চিকিৎসা পাক বা না পাক। তেমনটাই ভারতীয় জনতা পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি। এই অবস্থান থেকেই কোভিড-১৯ প্রতিষেধক টিকাকে দেখছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। তা যদি না হয় তাহলে কোন ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড১৯’র প্রতিষেধক সকলের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছে দেবার পরিবর্তে অধিকাংশকেই অর্থের বিনিময়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করল?
বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলি পর্যন্ত কোভিড১৯’র প্রতিষেধক তাদের দেশের সমস্ত অধিবাসীদের বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। পশ্চিমী দুনিয়ার দেশগুলি মায় মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত প্রতিষেধককে গণদ্রব্য হিসেবে ধরেছে কারণ যদি বিনামূল্যে সকলকে টিকা দেওয়াই সংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যু কমানোর সর্বোত্তম উপায়। এমনটা নয় যে ওইসব দেশগুলি সমাজতান্ত্রিক বা তাদের মাথাপিছু আয় এতটাই কম যে দেশের অধিবাসীরা টিকা কিনতে পারবে না, তবুও সার্বজনীন টিকাকরণের জন্য ওই সমস্ত দেশ বিনামূল্যেই টিকা দেওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছে। অপরদিকে আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে সরকারী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বের অধিবাসীদের জন্য, এবং স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক সমেত বিভিন্ন কিছু গোষ্ঠির জন্য করলেও, পাশাপাশি বেসরকারী হাসাপাতালগুলিতে অর্থের বিনিময়ে টিকা গ্রহণের উপায়ও চালু রেখেছিল। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে কোভিশিল্ড ও ভারত বায়োটেক থেকে কোভ্যাক্সিন কিনে তা রাজ্য সরকারগুলিকে বিনামূল্যে ও বেসরকারী হাসপাতালগুলিকে প্রতি ডোজ ১৫০ টাকা মূল্যে দিচ্ছিল। পরবর্তীতে ১৮ থেকে ৪৫ বছরের জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে টিকা চালু করার সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে বিনামূল্যে টিকা দিতে অস্বীকার করে ও তাদের সিরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেক থেকে তা সংগ্রহ করতে বলে।
ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে টিকা দেওয়ার দায়িত্ব থাকল কেবল ৪৫ ঊর্ধ্ব অধিবাসীদের, যার সংখ্যা সামগ্রিকে প্রায় ৩২ কোটি। কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী সরকার সিরাম ইনস্টিটিউট বা ভারত বায়োটেকের কাছ থেকে টিকা প্রতি ডোজ ১৫০ টাকা মূল্যে কিনবে। ফলে টাকার অঙ্কে একটি ডোজের দায়ের পরিমাণ ৪,৮০০ কোটি টাকার মতো, দুটি ডোজের দায় দাঁড়াবে ৯,৬০০ কোটি টাকা। যদিও সিরাম ইনস্টিটিউটের বক্তব্য অনুসারে তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে কেবল প্রথম ১০ কোটি ডোজ ১৫০ টাকায় দেবে বলেছে ও বাকি ডোজ অধিক দামে সরকারকে নিতে হবে। সিরাম ইনস্টিটিউট প্রতি ডোজের দাম ধার্য করেছে রাজ্য সরকারের জন্য ৩০০ টাকা ও বেসরকারী হাসপাতালের জন্য ৬০০ টাকা; ভারত বায়োটেকের দাম রাজ্য সরকারের জন্য ৬০০ টাকা ও বেসরকারী হাসপাতালের জন্য ১২০০ টাকা প্রতি ডোজ। ওদিকে ১৮ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে থাকা অধিবাসীদের জনসংখ্যা প্রায় ৬০ কোটি। যদি রাজ্য সরকারগুলি বিনামূল্যে টিকা দিতে চায় তাহলে তাদের খরচা পড়তে পারে ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার টিকাকরণের সিংহভাগের দায় রাজ্য সরকারগুলির ঘাড়ে ফেলে দিচ্ছে।
যেহেতু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২৪ এপ্রিল বলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত টিকাই ১৫০ টাকা প্রতি ডোজ হিসেবে পাবে কারণ তারা অগ্রিম অর্ডার দিয়েছেন ও তার মাধ্যমে টিকা সংক্রান্ত ঝুকিও বহন করেছেন, তাহলে যদি সরকার সমস্ত টিকাকরণের দায় নিত, তাহলে ১৮ ঊর্ধ্ব জনসাধরাণের জন্য লাগত ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। টিকাকরণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১-২২’র বাজেটে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রেখেছে। ফলে বাজেটের টাকাতেই টিকাকরণ হয়ে যেত। এমনকি সার্বজনীন টিকাকরণের জন্য লাগত ৪২ হাজার কোটি টাকার কম। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার কেন সকলকে বিনামূল্যে টিকা দেবে না তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের হঠাৎ টিকাকরণের ক্ষেত্রে পিছু হটা রাজ্যগুলিকে দুদিক দিয়ে ফ্যাসাদে ফেলেছে। ভ্যাকসিন সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। কোন কোম্পানি ভ্যাকসিন বানাবে, কীভাবে তার কাছে অর্ডার দেওয়া হবে, কত ভ্যাকসিন কোন কোন দেশে রফতানি করা হবে এসমস্ত সিদ্ধান্তই কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। সাধারণত ভ্যাকসিন প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বহু দেশে আগেই অর্ডার দেয় ও অগ্রিম দিয়ে থাকে। যদি ভ্যাকসিনটি সাফল্য না পায় তাহলে ঝুকি থাকে। অন্য দিকে তেমন ঝুকি নেওয়া হয় বলে প্রস্তুতকারক সংস্থা কম মূল্যে দেওয়ার চুক্তি করে। এই সমস্ত চুক্তিই এতাবৎ কাল কেন্দ্রীয় সরকার করেছে, যারফলে প্রতি ডোজ ১৫০ টাকা দরে সরবরাহ করছে প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি। রাজ্য সরকারের তেমন চুক্তি করার কোন অধিকারই ছিল না। ফলে এখন তাদের দ্বিগুণ বা চারগুণ মূল্যে টিকা কিনতে হবে। যদি কেন্দ্রীয় সরকার আগেই রাজ্য সরকারগুলিকে এব্যাপারে জানাত তাহলে সরকারগুলি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি করতে পারত।
প্রতিষেধকের বিষয়ে সব থেকে খারাপ দিক হল প্রতিষেধকের যোগান না থাকা। রাজ্য সরকারগুলিকে যেকোনো দেশ বা সংস্থা থেকে ভ্যাকসিন যোগাড় করার অনুমতির কথা বলা হলেও, তা অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের অন্য ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন বা মধ্যস্থতা ছাড়া ভ্যাকসিন যোগান দিতে চাইছে না। অপরদিকে আমেরিকার সংস্থাগুলি এই মুহূর্তে ভ্যাকসিনে যোগান দিতে অপারগ কারণ তাদের অর্ডারবই পরিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সিরাম বা ভারত বায়োটেকের উৎপাদন ক্ষমতাও প্রয়োজনমত যোগান দিতে পারছে না। এপর্যন্ত মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০% প্রথম ডোজ নিতে পেরেছে ও ৩% দুটো ডোজই নিতে পেরেছে। যদি সমস্ত অধিবাসীদের ভ্যাকসিন দিতে হয় তাহলে প্রায় ২৮০ কোটি ডোজ লাগবে। যদি এক বছরের মধ্যে তা দিতে হয় তাহলে হিসেব অনুযায়ী প্রতি মাসে ২৩ কোটি ভ্যাকসিন ডোজের যোগান চাই। এমনকি এক বছরের মধ্যে কেবল ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সকলকে দিতে গেলেও মাসে সাড়ে পনেরো কোটি ডোজের প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সিরাম ও ভারত বায়োটেকের যৌথ উৎপাদন ক্ষমতা মাসে সাড়ে আট কোটি ডোজ।
ভ্যাকসিন নিয়ে এই সংকট তৈরি করেছে মোদী সরকারের অদূরদর্শিতা ও আত্মতুষ্টি। মোদীজি ভেবেছিলেন কোভিড চলে গিয়েছে তাই ভ্যাকসিন না হলেও চলবে। ঢিমেতালে টিকাকরণ চালিয়ে গিয়ে কোভিডকে পরাস্ত করার ক্রেডিটও নেবেন, বাজটের বরাদ্দ অর্থও বাঁচবে। তাই এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত রাজ্যগুলিকে সরাসরি প্রতিষেধক কিনতে বা চুক্তি করতে দেননি। দ্বিতীয় ঢেউএ দেশজোড়া চিতার আগুন দেখে নিজেদের এলেম বুঝতে পেরেছে সরকার। ফলে সমস্ত দায় চাপাতে রাজ্য সরকারগুলিকে শিখন্ডি খাড়া করাচ্ছে। মোদী সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে ভ্যাকসিনের বন্দোবস্ত করতে ও কোভিড থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে তারা অক্ষম।
-- অমিত দাশগুপ্ত
আগামী দিনগুলোতে এরাজ্যে বিজেপি’র এগিয়ে চলার গতিপথ কি হবে? এই নির্বাচন থেকে বিজেপি কি শিক্ষা নিয়ে সামনের দিনে নিজের তূণ থেকে বার করবে কোন বিষাক্ত আয়ুধ? তৈরি করবে কি ধরনের নতুন নীল নকশা?
মাত্র ৩টি আসন থেকে ৭৭টি আসনে জয় এবং বিধানসভার অভ্যন্তরে প্রধান বিরোধী হিসাবে আত্মপ্রকাশকে শীর্ষ নেতৃত্ব বিরাট সাফল্য হিসাবে তুলে ধরলেও আরএসএস ও দলের তাত্ত্বিক নেতারা এই ফলাফলে উজ্জীবিত নয়। আবেগ ও উচ্ছ্বাসে না ভেসে তারা বরং চিন্তা করছেন কোথায় নিহিত ছিল এই নেতিবাচক ফলাফলের উৎস? কোন মতাদর্শ-রাজনৈতিক ঘাটতির জন্য ২০১৯’র সাফল্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে রাজ্যপাট দখল করা গেল না?একটা জোরালো মত (যেমন মোহিত রায়) হল, ২০১৯’র সাপেক্ষে এবারের ফলাফল নিশ্চিত ভাবেই পরাজয়। তাঁর মতে, “ভোটের শতাংশ বা সংখ্যা দিয়ে আসনের হিসাব সব সময় মেলে না। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯’র তুলনায় বিজেপি’র ভোট কমেছে প্রায় দু’শতাংশ, কিন্তু ২০১৯এ এগিয়ে থাকা আসনের তুলনায় প্রাপ্ত আসন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ!”
তিনি মনে করেন, ২০১৯’র অভিযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে “বিজেপি’র প্রয়োজন ছিল একটি ভোট বিস্ফোরণ। তা হয়নি।”
আরএসএস’র অঘোষিত মুখপত্র অর্গানাইজার এই ফলাফলকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ‘বিপর্যয়’ বলেই চিহ্নিত করেছে। অর্গানাইজার জানিয়েছে, ২০১৯’র এগিয়ে থাকা ১২২টি আসনের থেকে এবার তা নেমে এসেছে ৭৭-এ। আর, তার পেছনে তিনটি কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। (১) মমতা সরকার যে কর্মসূচীগুলো নামায় তার প্রভাব জাতপাত ও ধর্মের উর্দ্ধে উঠে প্রায় সমস্ত স্তরকেই প্রভাবিত করেছে, (২) বাছবিচার না করে, ক্ষমতা ও প্রভাব না দেখে তৃণমূল থেকে অনেককে দলে নিয়ে নেওয়াটা ‘খারাপ পরীক্ষা নিরীক্ষা’ (ব্যাড এক্সপেরিমেন্ট) বলা হয়েছে, (৩) শেষের দু’টি পর্যায়ে কোভিড পরিস্থিতি মমতার পক্ষেই গেছে, বিজেপি এই পর্যায়ে খুব খারাপ ফল করেছে। (সূত্রঃ ব্যাড এক্সপেরিমেন্ট ইন বেঙ্গল, নবীন কুমার, অর্গানাইজার, ১৩ মে, ২০২১)
খুব উদ্বেগের সাথে অর্গানাইজার লিখেছে যে, চারটে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় বিজেপি খালি হাতে ফিরে এসেছে। জেলাগুলো হল - ঝাড়গ্রাম (৪টি আসন), দঃ ২৪ পরগণা (৩১ আসন), পূর্ব বর্দ্ধমান (১৬টি আসন), কলকাতা (১১টি আসন)। তফশিলি জাতি উপজাতির মধ্যেও বিজেপি যে ভাল ফল করতে পারেনি তা স্বীকার করে ওই পত্রিকা দেখিয়েছে যে জঙ্গলমহলে মোট ৫১টি আসনের মধ্যে সে পেয়েছে মাত্র ১৭টি আসন। এমনকি মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও তারা আশানুরূপ সাড়া পায়নি।
কিছুটা আপশোষ করে প্রবন্ধের লেখক লিখেছেন, কংগ্রেস ও বামেরা মিলিতভাবে যদি ২০১৯’র ভোট ধরে রাখতে পারতো, তবে বিজেপি পেত ৯৩ আর তৃণমূলকে ১৮১-তেই আটকে রেখে দেওয়া যেত। জলপাইগুড়ি জেলায় ২৭টি আসনের মধ্যে ২১টি বিজেপি পাওয়ায় অর্গানাইজার সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বিজেপি’র প্রাক্তন রাজ্য সভার সাংসদ ও এবার বিধানসভায় বিজেপির পরাজিত প্রার্থী স্বপন দাশগুপ্ত একটি লেখায় বিজেপির ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘লেসেন্স লার্ন্ট’। এই লেখায় তিনি দেখিয়েছেন “... মমতা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, রাজ্যের সংখ্যাগুরু সম্প্রাদায়ের নির্ণায়ক সমর্থন ছাড়াই নির্বাচনে বিরাট জয় ছিনিয়ে আনা যায়”। তিনি তার ব্যাখ্যার সপক্ষে সিএসডিএস-লোকনীতির পরিসংখ্যান হাজির করে বলেছেন, ২০১৬ সালে তৃণমূল মুসলমানদের ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। আর, ২০২১এ ৭৫ শতাংশে। হিন্দুদের তুলনায় এবার মুসলমানেদের ভোট দেওয়ার হার ছিল অন্তত তিন শতাংশ বেশি। স্বপন দাশগুপ্তের মতে, এরাজ্যে নিদেনপক্ষে মোট হিন্দুভোটের ৬০ শতাংশ ভোট পেলে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারতো। তবে, সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য ভোট পেতে হলে, স্বপনবাবুর মতে, বিজেপির দরকার ছিল অন্তত ৬০ শতাংশ হিন্দু ভোট। আর তা পেতে হলে ঠিক যেভাবে মুসলিম ভোট পুরোপুরি সংহত হয়ে তৃণমূলের দিকে গেল, একই ভাবে হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভোটেরও সংহত হওয়া দরকার ছিল। এটাই মোহিতবাবুর পরিভাষায় ‘বিস্ফোরণ’।
হিন্দু ভোটারদের, বিশেষত, গরিব অংশের ভোট মমতা নিজের পক্ষে টেনে বিজেপির সাথে নিজের প্রাপ্য ভোটের ব্যবধান বেশ কমিয়ে এনেছেন – এই বিষয়টা উল্লেখ করে তিনি সিএসডিএস-লোকনীতির পরিসংখ্যান উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, শেষ বেলায় মমতা তাঁর সরকারী প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা গরিবদের মধ্যে দ্রুততার সাথে পৌঁছে দিয়ে এমনকি সেই সমস্ত অঞ্চলেও ভোট বাড়িয়েছেন, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় বেশ কম। মমতা তাঁর বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের মাধ্যমে বিজেপির গণভিত্তির মধ্যেও যে ভাঙন ধরিয়েছে, তা অর্গানাইজারও স্বীকার করেছে। আর, এবারের নির্বাচনে কোন প্রশ্ন ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে - লোকনীতি-সিএসডিএস’র সমীক্ষা অনুযায়ী তা ছিল ‘উন্নয়ন’। মোট ৩৩ শতাংশ মানুষ এর ভিত্তিতেই ভোট দিয়েছেন, আর বলাই বাহুল্য, জাত পাত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে এ রাজ্যের, বিশেষ করে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের একটা ভালো অংশ ভোট দেন মমতার পক্ষে। সবচেয়ে হিন্দু প্রধান জেলাগুলোতেও বিজেপির ভোট ৫০ শতাংশর চৌকাঠ টপকাতে না পারার পেছনে রয়েছে এই সরকারী প্রকল্পের প্রভাব, যা আগামীদিনে কোন রাজনৈতিক দলই উপেক্ষা করতে পারবেনা। স্বপন দাশগুপ্ত তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন, হিন্দুদের সমস্ত অধোবর্গ বা সাব অল্টার্ন সম্প্রদায়, বিশেষ করে আদিবাসিদের মধ্যে তৃণমূল বিজেপির সাপেক্ষে তার আগেকার ভোটের ব্যবধান বেশ কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, এমনকি, তাঁর মতে, “অন্যান্য রাজ্যে যে উচ্চবর্ণের ভোটার বিজেপির শক্ত ভিত্তি, সেখানেও বিজেপি ও তৃণমূলের ভোট প্রাপ্তির ব্যবধান যথাক্রমে ৪৬ শতাংশ ও ৪২ শতাংশ, অর্থাৎ মাত্র চার শতাংশ বেশি। এর অর্থ হল, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের বেশ বড় একটা অংশ এবারের নির্বাচনে বিজেপির আগেকার প্রভাব থেকে সরে এসেছে তৃণমূলের দিকে।”
কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় মারণ ঢেউকে সামাল দিতে নাজেহাল ও নির্লিপ্ত মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসী যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন, তা এবারের রাজ্য নির্বাচনেও প্রতিফলিত হল। কোভিডের মারাত্মক আবহের মধ্যেও নির্বাচন কমিশন অবশিষ্ট চারটি পর্যায়কে সংক্ষিপ্ত করে দু’টোতে কমিয়ে আনার প্রস্তাবকে আমলই দিল না। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ’ও এই সংবেদনশীল প্রশ্নে বিজেপির পক্ষেই দাঁড়াল। দেখা যাচ্ছে, মার্চের মাঝামাঝি রাজ্যে নথিভুক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল দিনে ১০০, আর মে মাসের গোড়ায় তা দাঁড়ায় দিনে ১৫,০০০! আসল সংক্রমণের হার নিঃসন্দেহে এরথেকে অনেক অনেক বেশি। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির হার যে বিজেপির বিরুদ্ধে গেছে তা স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম পর্যায়ের পর থেকে তৃণমূলের ভোটের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে যেমন বেড়েছে, বিজেপির ভোট কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে (সূত্রঃ কার ভোট কোথায় গেল, মৈত্রীশ ঘটক, পুষ্কর মৈত্র, আনন্দ বাজার পত্রিকা, ১৭ মে)। দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের জেদ ধরে বসে থাকাটা তৃণমূলের পক্ষে শাপে বর হয়েছে।
‘সোনার বাংলা’ স্লোগান যা মোদী-অমিত শাহ বারবার সামনে নিয়ে আসে, তা নিয়েও আরএসএস’র মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিম বাংলার মতো এক সীমান্তবর্তী রাজ্যে, যেখানে ‘রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু প্রীতি’ হিন্দুদের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলেছে, সেখানে ভাবাদর্শগত অবস্থান থেকে সরে এসে নির্বাচনী রাজনীতি সর্বস্ব কিছু উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর উপর ভর করে বৈতরণী পার হতে গিয়ে, তারা মনে করেন, পার্টির বড় বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে। এ প্রশ্নে সবচেয়ে খোলাখুলি সওয়াল করেছেন মোহিত রায়। কি বলেছেন তিনি?
“বিজেপির ভোট বিস্ফোরণ কারা ঘটাতে পারে? হিন্দুরা। বিজেপির জয়যাত্রাকে কারা রুখে দিতে পারে? অবিভাজিত মুসলিম ভোট। মুসলিম ভোট প্রায় পুরোটাই গিয়েছে তৃণমূলে”। কিন্তু “রাজ্যের হিন্দুরা মনে করেননি, তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিজেপির প্রয়োজন আছে”।
তাঁর স্পষ্ট অভিমত, বিজেপি তার নির্বাচনী সংকল্পপত্রে যে ১৩ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেখানে সুশাসন থেকে শুরু করে ‘সবার জন্য প্রাপ্তিযোগের’ কথা থাকলেও যা থাকেনি তা হল ভাবাদর্শ। “বিজেপি কি (এই ভোট যুদ্ধে) বলেছিল যে, তারা ক্ষমতায় না এলে হিন্দুদের বিপর্যয় ঘটবে? পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে? না, বিজেপি এ সব ভাবাদর্শের কথায় মাথা ঘামায়নি।.... সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা কেন ভাবতে যাবেন, তাঁদের ধর্মীয় অস্তিত্বের সমস্যা সমাধানে বিজেপিকেই ভোট দিতে হবে?”
অসম থেকে শিক্ষা নিয়ে এরাজ্যের জন্য মোহিত বাবুর প্রস্তাব, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির সাথে ভাবাদর্শের জোরালো মিশেল ঘটিয়ে হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতির লড়াই এখানে চালাতে হবে। আর, তারজন্য প্রচারের যে বিষয়বস্তু তিনি সুত্রবদ্ধ করেছেন তা হল, ইসলামি মৌলবাদীদের জোরালো উপস্থিতি ও ধর্মীয় সন্ত্রাস, পরিবর্তিত ধর্মীয় জনসংখ্যার বিপদ, অনুপ্রবেশের সমস্যা ইত্যাদি।
স্বপন দাশগুপ্ত নির্বাচনী ফলাফলের ‘কাটাছেঁড়া’ করে পার্টির জন্য যে টোটকা হাজির করেছেন তা হল, বিজেপির স্থানীয় শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত করতে হবে, আরও নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে সামাজিকভাবে, পাশাপাশি “যে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলো একটা ভাষ্য তৈরি করেছে, তাকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার লক্ষ্যে মনোযোগী হতে হবে”।
আক্রমণাত্মক হিন্দুত্ববাদের সাথে উন্নয়নমুখী স্লোগানের মিশেল, হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানের যে ঘ্রাণ তার সর্বাঙ্গে রয়েছে, তাকে মুছে ক্রমে ক্রমে বাংলা ও বাঙালীর স্বাদ-গন্ধের প্রলেপ লাগিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন আঙ্গিকে অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ ওদের তাত্ত্বিক নেতারা দিচ্ছেন। আঞ্চলিক ভাষ্যকে আত্মস্থ করার প্রক্রিয়ায় বিজেপি নতুনভাবে এই রাজ্যে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করার জন্য দলকে পুননির্মাণ করার নীল নকশা নিয়ে সম্ভবত এবার আবির্ভূত হবে।
এই বিজেপিকে সর্বাত্মকভাবে, সমস্ত ফ্রন্টে প্রতিহত করতে এরাজ্যে বাম-আন্দোলনেরও পুননির্মাণ দরকার। গতানুগতিকতার জীর্ণ, বহু ব্যবহৃত পথে না হেঁটে উদ্ভাবন করতে হবে নতুন প্রাণচঞ্চল কর্মকান্ড ও রাস্তা। আর, এই চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিকেই। বিজেপির বিরুদ্ধে নিশানাকে নিবদ্ধ রেখেই রাজ্যবাসীর অপূর্ণ দাবি ও গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
-- অতনু চক্রবর্তী
(এপিডিআর কৃষ্ণনগর শাখার তথ্যানুসন্ধানকারী দলের রিপোর্ট)
গত ১৫ মে অর্থাৎ ঈদের ঠিক পরেরদিন শান্তিপুর থানার অর্ন্তগত বেলতলার বাবলাবন গ্রামে স্থানীয় শনি মন্দিরের গ্রিলে গোমাংস ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। রাস্তা অবরোধ, পুলিশের লাঠিচার্জ, গ্রেফতার ও মারপিটের ঘটনাও ঘটে। উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস শেলও ফাটায়। এলাকায় এখনও উত্তেজনা রয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এপিডিআর কৃষ্ণনগর শাখা ও শান্তিপুর জনউদ্যোগের পক্ষ থেকে ১৯ মে এক তথ্যানুসন্ধান করা হয়।
তথ্যানুসন্ধান দলটি প্রথমে ঘটনাস্থল তথা বাবলাবন গ্রামে যায়। শান্তিপুর মোতিগঞ্জ মোড় থেকে বাবলাবন গ্রামের দূরত্ব আনুমানিক সাড়ে তিন কিলোমিটার। রাস্তার ওপরেই সেই শনি মন্দিরটি আমরা দেখতে পাই। স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান, গ্রিল আটকানো শনি মন্দিরটি প্রায় দশ বছর আগে তৈরি হয়। বাবলাবন গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত। জনসংখ্যা পাঁচশোর কিছু বেশি। মূলত কর্মকার, কুন্ডু ও বিশ্বাস’দেরই বসবাস। বাংলাদেশের যশোর জেলার অধিবাসীদেরই প্রধানত বসবাস এই এলাকায়। অনুসন্ধানকারী দল প্রথমে কথা বলে স্থানীয় কর্মকার মহাদেব কর্মকারের সাথে। নিজের কামারশালা, লকডাউনের ফলে যা আপাতত বন্ধ, সত্তরোর্ধ এই বৃদ্ধ জানান সেদিনের ঘটনার কথা। তিনি জানান, ১৯৭১ সাল থেকে তার এই এলাকায় বাস। ইন্দিরা গান্ধীর দিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত এই ঘটনা এই এলাকায় প্রথমবার ঘটল। পেশাগত কারণে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তার কাছে কাজ করাতে আসেন। সেক্ষেত্রে কখনও ধর্মীয় পরিচয় প্রকট হয়নি। বরং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো বলেই জানান তিনি। যদিও সেদিনের ঘটনা এই সম্পর্কের ভিতকে কোথাও যেন নড়িয়ে দিয়েছে। ঐদিন ঘুম থেকে উঠে মন্দিরে গোমাংস দেখে এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই নানারকম প্রশ্ন উঠতে থাকে। একে একে লোক জড়ো হতে থাকে মন্দিরের সামনে। মানুষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। ঠিক এমন সময়ে নৃসিংহপুরবাসী জনৈক পার্থ বিশ্বাস টোটো নিয়ে সমস্ত ‘হিন্দু ভাইদের’ এই ঘটনার বিরোধিতা করার আবেদন জানিয়ে মাইকে প্রচার শুরু করেন। এই প্রচারে সাড়া দিয়ে প্রচুর মানুষ এলাকায় জড়ো হয়। কিছু বাইরের লোকজনও আসেন বলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান। প্রায় পাঁচশোজন মানুষ সকাল সাড়ে নটা/দশটা নাগাদ উত্তেজিত অবস্থায় এই ঘটনার বিরোধিতা এবং অপরাধীকে গ্রেফতারের দাবিতে রাস্তা অবরোধ শুরু করেন। ঘটনাস্থলে শান্তিপুর থানার পুলিশ ও এসডিও আসেন। প্রশাসন থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু ক্ষুব্ধ জনতা সেকথায় সাড়া না দিয়ে অবরোধ চালিয়ে যান। এরপর জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে বিক্ষিপ্ত লাঠিচার্জ হয়। টিয়ারগ্যাসের শেল ফাটানো হয়। পুলিশ, পার্থ বিশ্বাস সহ আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে, যদিও একজনকে পরের দিন ছেড়ে দেয়। প্রশাসনের উদ্যোগে ঐদিনই মন্দির পরিষ্কার করা হয় এবং গোমাংসের টুকরোটি সরানো হয়। উল্লেখ্য, সেদিন ঘটনাস্থলে সদ্য বিজয়ী বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকারও উপস্থিত ছিলেন। অনুসন্ধানকারী দল মহাদেব কর্মকারের কাছে জানতে চায়, কেন হঠাৎ করে এরকম ঘটনা ঘটলো? ঈদের দিন মুসলমান সম্প্রদায়গত মানুষের গরুর মাংস খাওয়া তো নতুন কিছু নয়, তাহলে হঠাৎ এখন কেন এরকম ঘটনা ঘটল? গ্রাম্য সারল্যের সাথে তিনি জানালেন, এই প্রশ্নের উত্তর সত্যি বলতে তাঁরও জানা নেই। কারা যে করল সেই বিষয়েও তাঁর কোনো ধারণা নেই। তবে কোনো হিন্দুর ছেলে এই পাপকাজ করবে বলে তাঁর মনে হয়না। আমাদের প্রশ্ন থাকে, তাহলে কি মুসলমানরাই কেউ করেছে? তিনি অসহায় বোধ করেন এই প্রশ্নের সামনে। কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, “কি করে বলি! এতদিন তো ওরা এমন কিছু করেনি। এখন করেছে কিনা সেটাও ঠিক বুঝতে পারছিনা! তবে মানুষের মনে সন্দেহ তো তৈরি হয়েছে। প্রশাসন খুঁজে বের করুক সেই অপরাধীকে। তাহলেই সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে”। তিনি আরও জানান, একেই লকডাউনের পরে তাঁর কামারশালা প্রায় বন্ধ ছিল। তাও যা অল্পবিস্তর কাজ সকালের দিকে হচ্ছিল, এই ঘটনার পর তাও বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ পিকেট বসেছে সামনেই। কেউই কাজ করাতে আসছেন না। তাই খেয়ে পরে শান্তিতে থাকতে চাওয়া প্রবীণ মহাদেব বাবু দোষী ব্যক্তির অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানান নাহলে বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নের মুখে পড়বে, এমনটাই দাবি তার। আমরা কথা বলি স্থানীয় বাবলু কুন্ডু, শম্পা কুন্ডু ও হরেন বিশ্বাসের সাথে এবং স্থানীয় কোয়াক ডাক্তার পীযুষ মন্ডলের সাথেও। পীযুষ বাবুর বাড়ি নৃসিংহপুর গ্রামের মধ্যপাড়ায়। তিনি জোরের সাথে জানান কোনো হিন্দু এইকাজ করবে না। তাহলে এতদিন পরে মুসলমানরাই বা কেন করবে? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে নেই বলে তিনি জানান, প্রশাসনের উচিত দ্রুত অপরাধীকে গ্রেফতার করা। তাঁর ডাক্তারখানায় থাকা স্থানীয় শ্রী ঘোষ অভিযোগ করেন সাহেবডাঙ্গায় মুসলমানরা তাদের গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছে না। তারা ঐ গ্রামের একটা মাঠে দুধ দোয়ানোর কাজ করেন। সেই দুধ শান্তিপুর এলাকা ও তার বাইরেও সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এখন ‘ওরা’ ঢুকতে না দেওয়ায় তাঁর মতো অনেক ঘোষেরই এখন রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পীযুষবাবু জানান, আমরাও যদি ‘আমাদের’ গ্রামে ‘ওদের’ ঢুকতে না দিই তাহলে বেশি সমস্যায় পড়বে ‘ওরাই’। কিন্তু এই ‘আমরা’-‘ওরা’র বাইরে এতদিনের যে সুসম্পর্ক ছিল তা কি নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় মিটিয়ে নেওয়া যায় না? যায় না কি সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে গ্রামগুলিতে জনমত গড়ে তুলতে? আমাদের এই প্রশ্নের উত্তরে তারা প্রশাসনকেই উদ্যোগ নিতে বলেন।
এরপর তথ্যানুসন্ধান দলটি যায় পাশের গ্রাম সাহেবডাঙ্গায়। হরিপুর পঞ্চায়েতের অর্ন্তগত সাহেবডাঙ্গা গ্রাম মুসলিমপ্রধান হলেও কিছু ঘোষেদের বসবাসও আছে। এই গ্রামের মানুষ সেদিনের পর থেকে অত্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য আব্বাস আলি। স্থানীয় আমির উদ্দিন শেখ জানান, ভয়ে আতঙ্কে তারা গ্রাম ছেড়ে বেরোতে পারছেন না। ঘোষ পাড়ার সাধন ঘোষ বলেন, তাঁরাও নিজের পাড়া থেকে বেরোতে পারছেন না। রুটি-রুজির কারণে তাকে নৃসিংহপুর ও নতুনবাজার যেতে হয়, যার পথ সাহেবডাঙ্গার মধ্যে দিয়েই গেছে। কিন্তু সাহেবডাঙ্গার লোকেরাই এখন কয়েকদিন গ্রামে যাতায়াত বন্ধ রাখতে বলেছেন। অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণ যে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মনে জায়গা করেছে তা তাদের কথায় উঠে আসা উদ্বেগ থেকেই স্পষ্ট বলে মনে হয়েছে। এরপর কথা হয় সাহেবডাঙ্গা গ্রামেরই বস্ত্র ব্যবসায়ী আসরাফ আলি শেখের সাথে। তিনি জানান, গরুর মাংস মন্দিরে রেখে যদি অশান্তি করার ইচ্ছে তাঁদের থাকত তাহলে তারা তাঁদের পাড়ার মন্দিরেই এই কাজ করতে পারতেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁরা তা করেননি। করার কথা ভাবেনও নি। কারণ দুই ধর্মের লোকজনই অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে একে অন্যের উপরে নির্ভরশীল। তাঁর অভিযোগ, আজ এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। শুধুমাত্র মুসলমানদের ওপর অভিযোগ আনতে ও হিন্দুদের অবিশ্বাস আর ঘৃণা জাগাতে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা ঘটালো এমন ঘটনা? যখন এই প্রশ্ন করা হয় তিনি উত্তর দেন, “সেটা প্রশাসন দেখুক। আমরা কাকে সন্দেহ করবো? কেনই বা করব? অপরাধীকে খুঁজে বের করা প্রশাসনের কাজ। আমরা চাই দ্রুত অপরাধীকে গ্রেফতার করা হোক”। তাঁর দোকানে বসেই কথা হচ্ছিল। ঐ দোকানেই কথা বলতে এগিয়ে এলেন অন্যরা। তারা জানালেন, “কয়েক বছর আগেও তোপখানা গ্রামে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। তখনও এইরকম ভয়, অবিশ্বাস আর সন্দেহ ছিল মানুষে মানুষে”। তাঁরা জানান, “হিন্দুরা আমাদের অপরাধী ঠাওড়েই নিয়েছিল। ‘অপরাধী তার অপরাধ জানলোনা অথচ ফাঁসি হয়ে গেল’ এইরকম পরিস্থিতি তখন। তারপর পুলিশ গ্রেফতার করল কয়েকজনকে। বিচারও শুরু হল। জানা গেল যে, এই জঘন্য কাজ করেছিল একজন হিন্দুরই ছেলে। আজও সে জেল খাটছে”। অনুসন্ধানকারী দল জানতে চায় ঘোষেদের তাঁরা কেন দুধ দেওয়াতে তাদের গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছেন না? এতে বিদ্বেষ আর দূরত্ব আরও বাড়বে না কি? আসরাফ আলির সাথে অন্যরাও পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “যদি আবারও কোনো অশান্তি হয়, তার দায়িত্ব কে নেবে? আপনারা তো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আসবেন। প্রশাসনও তাই”। তাঁরা স্পষ্ট জানান, “মনে সন্দেহ নিয়ে সম্প্রীতি রাখা যায় না। তাই প্রশাসন দোষী ব্যক্তিকে আগে গ্রেফতার করুক তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে”। অনুসন্ধানকারী দল ওখানেই জানতে পারে, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চারজন মুসলিম যুবক আক্রান্ত হয়। আক্রান্তদের সাথে কথা বলতে হরিপুর পঞ্চায়েতের অধীনে হরিনদী দরগাতলায় যাওয়া হয়। এই গ্রামটি বেশ বড়, মুসলিমপ্রধান গ্রাম। গ্রামের অনেককেই বাজার ও ব্যবসাপাতির কারণে শান্তিপুর নতুন হাটের দিকে যেতে হয়। সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সাথে কথাবার্তায় জানা যায়, এলাকার যুবক জসিমুদ্দিন সেখ (বয়স ২৯), বাবার নাম দিলবাহার সেখ, ঈদের পরেরদিন কয়েকজন হিন্দু যুবকের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জসিমুদ্দিনের বাড়ি কাছেই ছিল তাই তার বাড়িতে সরাসরি যাওয়া হয়। সে ঐদিন কালনায় সিটি স্ক্যান করাতে গিয়েছিল বলে তার সাথে দেখা হয়নি, কিন্তু তার বাবা ও মায়ের সাথে কথা বলে জানা গেল, তাদের বাঁশের ব্যবসা আছে। গ্রামের অধিকাংশ লোকই বাঁশের ব্যবসা করেন।
ঈদের পরের দিন জসিমুদ্দিন বাঁশ দিয়ে নতুন হাটের দিক থেকে ফিরছিল। ফেরার পথে মুখে গামছা বাঁধা কয়েকজন যুবক তার ওপর আকষ্মিক চড়াও হয়। তারা জসিমুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করে গতদিন অর্থাৎ ঈদের দিন সে জোরে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিল কেন? জসিমুদ্দিন জানান তিনি ঈদের দিন গ্রাম থেকে বেরোয়নি, এইদিকে আসেনও নি। এরপর মিথ্যে কথা বলার অভিযোগে তারা জসিমুদ্দিনকে মারতে থাকে। রড দিয়ে মারার ফলে তাঁর মুখ প্রচন্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথাতেও আঘাত লাগে। মোটরবাইক ভাঙচুর করে। পথচলতি কয়েকজন যুবক এই ঘটনা দেখে জসিমুদ্দিনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। আক্রমণকারীদের তারা ভর্ৎসনা করে এবং তাঁকে বাড়ি ফিরে আসতে সাহায্য করে। জসিমুদ্দিন বাড়িতে জানান, যারা তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তারা ধর্ম পরিচয়ে ছিলেন হিন্দু। এই ঘটনা জানিয়ে শান্তিপুর থানায় জসিমুদ্দিন লিখিত অভিযোগ জানান। যদিও কোনো জিডি/এফআইআর’র নম্বর/কপি থানা থেকে তাঁকে দেওয়া হয়নি। আক্রান্ত হন নৃসিংহপুর মধ্যপাড়ার আরেকজন যুবক যিনি শান্তিপুর পুরসভার চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী, কটা সেখ। বিজেপির নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য সূপর্ণা বর্মনের সাথেও কথা বলার জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু কোনো যোগাযোগ সূত্র না পাওয়ায় তা হয়ে ওঠেনি। তথ্যানুসন্ধান শেষে শান্তিপুর থানার ওসি সুমন দাসের সাথে দেখা করে তাঁকে তথ্যানুসন্ধানের সবকিছু জানানো হয়। গ্রামগুলিতে যে চাপা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হচ্ছে যা এতদিনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সহাবস্থানের সম্পর্ককে নষ্ট করছে সেই বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে ওনাকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করা হয়। দাবি রাখা হয়,
(১) অবিলম্বে দোষী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে হবে।
২) গ্রামে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পরিবর্তে সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় হতে হবে। প্রয়োজনে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে বসে আলোচনা ও প্রশাসনিক উদ্যোগে সম্প্রীতির বার্তা দিতে হবে।
৩) জসিমুদ্দিন সেখের অভিযোগপত্রের কপি তাঁকে বা তাঁর পরিবারকে দিতে হবে।
অনুসন্ধানকারী দলের পর্যবেক্ষণ
মন্দিরে গোমাংস রাখার ঘটনার মাধ্যমে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে সহজে আঘাত করার ঘটনা এর আগেও এখানে ঘটেছে। এই ঘটনায় সহজেই মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি হিন্দুদের বিক্ষুদ্ধ করে তোলা যায়, যা একটা দুটো বিক্ষিপ্ত ঘটনায় সার্বিক প্রভাব না ফেললেও ধারাবাহিক ঘটতে থাকলে আবশ্যিকভাবেই সম্প্রীতির সম্পর্কে ফাটল ধরায়। এই তথ্যানুসন্ধানে যেমন একদিকে ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্তঃসম্পর্কই যথেষ্ট মাত্রায় দেখা গেছে, অন্যদিকে এই ঘটনার পর হিন্দুদের মনে সন্দেহ আর মুসলমানদের মনে ভয় আর আতঙ্কও প্রত্যক্ষ করা গেল। যদিও এই অঞ্চলের মানুষ এখনও পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় জড়িত হননি, কিন্তু অনুরূপ সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ঘটনা যেরকম ধারাবাহিক আকার নিচ্ছে তা যথেষ্ট উদ্বেগের বলেই মনে হয়েছে। এই ঘটনা ধর্মীয় বিভাজন তৈরির উদ্দেশ্যেই ঘটানো হয়েছে বলেও মনে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সামাজিক প্রেক্ষাপট অথবা দাঙ্গা পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হতে পারে তার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি এলাকার মানুষের সামাজিক উদ্যোগকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে নাগরিক সমাজকেও।
তথ্যানুসন্ধান দলে ছিলেন এপিডিআর কৃষ্ণনগর শাখার পক্ষে তাপস চক্রবর্তী, মৌতুলি নাগ সরকার, কিশোর সিংহ এবং শান্তিপুর জন উদ্যোগের পক্ষে শমিত আচার্য, জয়ন্ত ব্যানার্জি, বাবর আলী মন্ডল।
(রিপোর্ট পাঠিয়ে সহায়তা করেছেন শংকর রায়)
“অ্যালোপ্যাথি একটা নির্বোধ বিজ্ঞান।... অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে লক্ষ-লক্ষ মানুষ মারা গেছে।... হাসপাতালে শয্যার অভাবে বা অক্সিজেন না পেয়ে যত লোক মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে।” কথাগুলো স্বাস্থ্য সম্পর্কে হাতুড়ে পরামর্শদাতা বাবা রামদেবের। সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে থাকা একটা ভিডিওতে অ্যালোপ্যাথির বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার রামদেব করছেন বলে দেখা গেছে। এই মন্তব্য নিয়ে সমালোচনা উঠলে ও বিতর্ক তৈরি হলে রামদেব বলেন, এটা তাঁর নিজের মন্তব্য নয়। তাঁর মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড হয়ে আসা একটা ভিডিও বার্তাকেই তিনি পড়ছিলেন। কিন্তু যাঁরা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আধুনিককালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নিজেদের নিংড়ে দিচ্ছেন, সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি সত্বেও করোনা রোগীদের সেবা থেকে সরে আসছেন না, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সেই ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে এরচেয়ে অসম্মানজনক ও গ্লানিকর আর কি হতে পারে? তাঁরা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাতে লাগলেন, রামদেবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করলেন সরকারের কাছে। রামদেবের কাছে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নোটিস পাঠালো আইএমএ। আইএমএ’র সেক্রেটারি জেনারেল জয়েস লেলে বললেন, “সরকারের নীরবতায় আমরা মর্মাহত”। প্রসঙ্গত, রামদেব সরকার ঘনিষ্ঠ যোগগুরু বলেই সমধিক পরিচিত। তাঁর এই মন্তব্যে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির সম্ভাবনার আঁচ করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন রামদেদেবকে চিঠি লিখে বললেন, “আপনার মন্তব্যের মাধ্যমে আপনি শুধু করোনা যোদ্ধাদেরই অসম্মান করেননি, দেশের জনগণের ভাবাবেগেও আঘাত দিয়েছেন। অ্যালোপ্যাথি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য স্বাস্থ্য পরিষেবাক্ষেত্রের কর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে এবং কোভিড১৯’র বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে দুর্বল করে তুলতে পারে।” চিঠির শেষে তাঁর আবেদন, “আমি আশা করব, আপনি বিষয়টায় গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন এবং সারা বিশ্বের করোনা যোদ্ধাদের ভাবাবেগের কথা বিবেচনা করে আপনার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেবেন”। এরপর রামদেবের টুইট গেল হর্ষবর্ধনের কাছে, “আপনার চিঠি পেয়েছি। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ও বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা শেষ করতে আমি আমার মন্তব্য প্রত্যাহার করছি”। মন্তব্য প্রত্যাহারের এই টুইট বার্তা দেখিয়ে দিল যে, মন্তব্যটি তাঁর নয় এবং ফরোয়ার্ড হয়ে আসা একটি ভিডিও বার্তাই তিনি পড়ছিলেন বলে যে দাবি রামদেব করেছিলেন, তা ছিল সর্বৈব মিথ্যা।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটা ওঠে তা হল, এই মন্তব্য করার ধৃষ্টতা রামদেব পেলেন কোথা থেকে? এটা কি নিছকই মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগ? না কি এর পিছনে গূঢ় কোনো অভিপ্রায় রয়েছে? এর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে রামদেবের যথেষ্ঠ ওঠাবসা এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও ভাবধারাকে পুষ্ট করতেও রামদেবের অবদান কম নয়। কাজেই, শাসক দল ও সরকারের প্রশ্রয়ই যে অ্যালোপ্যাথির মতো চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন ও সংস্কারগ্ৰস্ত মন্তব্যে রামদেবকে স্পর্ধিত করেছে তা নিয়ে প্রশ্নের বোধহয় খুব একটা অবকাশ থাকতে পারে না। এছাড়া, অ্যলোপ্যাথ বিরোধী মন্তব্যের মধ্যে নিজের কোম্পানির তৈরি ওষুধের বিক্রি বাড়িয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য রয়েছে বলেও অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি গাছগাছড়ার মিশেলে করোনিল নামে একটা ওষুধ বার করে করোনা চিকিৎসার অব্যর্থ ওষুধ বলে দাবি করে। এই ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণসিদ্ধ নয় এবং স্বীকৃত কোনো সংস্থার অনুমোদীতও নয়। অ্যালোপ্যাথির বিরুদ্ধে বিরূপ হয়ে, জনগণ মরিয়া হয়ে করোনিলের ওপর ভরসা করলে পতঞ্জলির প্রভূত লাভ। পতঞ্জলি রামদেবের তৈরি, ফলত হিন্দুত্বের সংযোগ সম্পন্ন একটা কর্পোরেট সংস্থা। করোনা সঙ্কটের মধ্যে একটা মওকা খুঁজে পেয়ে আর্থিক লাভে তাকে কাজে লাগাতে পতঞ্জলি তথা রামদেব ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন সরকারের মদতকে। করোনিল ট্যাবলেটকে বাজারে আনার সময় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং হর্ষবর্ধন রামদেবের পাশে দাঁড়িয়ে করোনিলের নির্ভরযোগ্যতার বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠেন। এবছরেরই ১৯ ফেব্রুয়ারি দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হর্ষবর্ধন ও নীতীন গডকড়িকে দুপাশে নিয়ে রামদেব ঘোষণা করেন, আয়ুষ মন্ত্রক কোভিড-১৯ চিকিৎসায় করোনিল ব্যবহারে অনুমতি দিয়েছে। সরকারের এই সক্রিয় মদত পেয়ে করোনিলের বিক্রি কয়েকশো কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমের খবর। তবে, কোভিড১৯ চিকিৎসায় ফলদায়ীরূপে সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকা শুধু করোনিল ট্যাবলেটকেই নয়, গোময়, গোমূত্র এবং অন্যান্য নানান অকার্যকর ও এমনকি ক্ষতিকারক বস্তুকেও করোনা মোকাবিলার উপায় বলে বিধান দিচ্ছেন বিজেপি নেতা-নেত্রীরা।
করোনা সংক্রমণের মোকাবিলায় বিজেপি নেত্রী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিধান হল - প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে গোমূত্র পান করতে হবে। গোমূত্র অবশ্য দেশী গরুর হতে হবে। এরফলে করোনা আক্রান্তের ফুসফুস সংক্রমণ মুক্ত হবে। প্রজ্ঞার দাবি, তিনি নিজে প্রতিদিন গোমূত্র সেবন করে থাকেন। এদিকে আবার সংবাদ বেরিয়েছে যে, কোভিড সংক্রমণ নিয়ে প্রজ্ঞাকে দিল্লীর এমস হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। গুজরাটের বংশকন্ঠ জেলার দিশা তালুকের তেতোড়া গ্ৰামের রাজারাম গৌশালা আশ্রমে রয়েছে কোভিড চিকিৎসার একটা কেন্দ্র, যাতে অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে আয়ুর্বেদ পদ্ধতিতেও কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হয়। ঐ কেন্দ্রের ট্রাস্টি রাম রতন দাস জানিয়েছেন, “আমাদের কাছে আয়ুর্বেদ ওষুধ রয়েছে যা কোভিড-১৯ চিকিৎসার মোক্ষম ওষুধ। আয়ুর্বেদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা ভেদলক্ষণো পঞ্চগোভ্য আয়ুর্বেদ চিকিৎসা দিই যা গরুর পাঁচটা উপাদান দিয়ে তৈরি – মূত্র, গোবর, দুধ, ঘি এবং দই।” প্রায় একই ধরনের বিধান দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মিরাটের বিজেপি নেতা গোপাল শর্মা। প্রচার করা হচ্ছে যে, দেশি ঘি দিয়ে ঘুঁটে পোড়ালে নাকি অক্সিজেন তৈরি হয়। এই প্রশ্নে বোম্বে আইআইটি’র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’এর অধ্যাপক অভিজিৎ মজুমদার কি বলছেন শোনা যাক – “প্রথমত, দহন এমন একটা প্রক্রিয়া যা অক্সিজেন শুষে নেয়। আপনি যদি কিছু পোড়ান তবে তাতে অক্সিজেন তৈরি হবে না, বরং তা অক্সিজেন শুষে নেবে। ... আপনি যদি ঘরে ধোঁয়া তৈরি করেন তবে যে রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে সে সঙ্কটাপন্ন হবে।”
সরকার স্বয়ং যে পরামর্শ দিচ্ছে তা শোনাটাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটানো সম্পর্কে আয়ুষ মন্ত্রকের পরামর্শ হল – তিল তেল, নারকেল তেল, বা গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘি কয়েক ফোঁটা নাকে ঢালতে হবে – সকাল ও সন্ধ্যায়। কেউ নাকে নিতে না পারলে এক চামচ তিল বা নারকেল তেল মুখে নিয়ে কুলকুচি করে ফেলে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে হৃষিকেশের এআইএমএস’কে কয়েক লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। আর সেই উদ্দেশ্যটা হল, রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ এবং প্রাণায়াম কোনো ভূমিকা পালন করে কি না তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো।
দেহে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো সম্পর্কে কর্নাটকের বিজেপি নেতা বিজ শঙ্কেশ্বরের পরামর্শ সম্পর্কে দ্য হিন্দু পত্রিকার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে – “শ্রী শঙ্কেশ্বর সাম্প্রতিক এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে, নাসারন্ধ্র দিয়ে লাইম জুইস নিলে তা অক্সিজেনের মাত্রাকে ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে তোলে। তিনি বলেন, ২০০ জনের মধ্যে এই ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতিকে ফলপ্রসূ হতে তিনি দেখেছেন, যারমধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং সহকর্মীরাও রয়েছে।” দ্য হিন্দুর ঐ রিপোর্টে এই কথাও জানানো হয়েছে যে, ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করার পর কয়েকজন মারাও গেছেন।
করোনা মোকাবিলার এই সমস্ত অবৈজ্ঞানিক, অপ্রমাণসিদ্ধ বিধান বিজেপি নেতা-নেত্রীরা দিচ্ছেন কেন? তাঁরা নিজেরা, নিজেদের দলের লোকজন ঐ সমস্ত পরামর্শে আস্থা রাখেন? নিজেরা বা তাঁদের বাড়ির লোকজন করোনা আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা নেওয়ার পরিবর্তে এই সমস্ত ‘দেশীয়’ চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেছেন বা করতে পারবেন? বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের নেতারাও যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা নিতেই পছন্দ করেছেন, সে তো সবারই জানা। গোমূত্র, গোবর, ঘুঁটে, ইত্যাদির উপকারিতা নিয়ে প্রচার সংঘ-বিজেপির গো-রাজনীতিরই সম্প্রসারণ। গরুকে কেন্দ্র করে বিদ্বেষ ও বিভেদের যে রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীরা চালায়, করোনা কালেও তাকে অব্যাহতভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা তাদের পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গোমূত্র, গোময়-এর নিরাময় ক্ষমতা নিয়ে প্রচার যতই আষাঢ়ে ও ভিত্তিহীন হোক, বারবার বলে জনমনে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এইভাবে গরুকে পূজ্য তথা মাতা করে তোলার কৌশলকে একনিষ্ঠ ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই বিজেপির অভিপ্রায়। এছাড়া, যুক্তিবাদী হবে না, যা বলা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন করবে না, নেতা-নেত্রীদের মুখ নিঃসৃত বচনকে অভ্রান্ত বলে মেনে নেবে, এমন জনসাধারণই বিজেপির মতো শাসকদের কাঙ্খিত। জনগণকে যুক্তি নির্ভর হওয়ার চেয়ে বিশ্বাস-নির্ভর করে তুলতে পারলে তারা টোটকা নিরাময়ের ওপর ভরসা করবে, রোগমুক্তিতে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। তবে, কিছু মানুষ বিশ্বাসের অন্ধত্বে ডুবে থাকলেও ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণ কিন্তু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাকে ধরেই বাঁচতে চাইছেন। তাঁরা শয্যার অভাব, অক্সিজেনের অনটন, ওষুধের আকাল নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, টিকার অমিল নিয়ে প্রতিবাদে নামছেন। হিন্দুত্ব ব্র্যাণ্ডের হলেও বুজরুকির প্রতারণা ক্ষমতা যে অতি সীমিত তা প্রতিদিনই প্রতিপন্ন হচ্ছে বাস্তবের মাটিতে।
এআইকেএম’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক জয়তু দেশমুখ এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম এক জাতীয় স্তরের কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সারা দেশ। মোদী সরকারকে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে যত দিন যাচ্ছে দিল্লীর কৃষক আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে চলেছে। নতুন নতুন রাজ্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের সংগ্রামী শক্তি এতে যোগদান করছে। এই আন্দোলন জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার আশাবাদ ও উদ্দীপনা তুলে ধরেছে। মোদী সরকার নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। ২৬ মে দিল্লীর কিষাণ আন্দোলনের ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার দিনে আসমুদ্র হিমাচল কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুব-মহিলা, সমাজকর্মী, নাগরিক সমাজ পথে নেমে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কালা দিবস পালন করলেন। আন্দোলনের মঞ্চ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এই আহ্বান জানিয়েছিল। কোভিড বিধি মেনে, দূরত্ব বজায় রেখে হাতে শ্লোগান প্ল্যাকার্ড নিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী থেকে শুরু করে জেলায় জেলায়, গ্রামে গঞ্জে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। পুড়লো মোদীর কুশপুতুল, কালা কৃষি আইনের প্রতিলিপি। প্রমাণিত হল এ লড়াই কেবল দুই একটি রাজ্যের নয়, এটা সমগ্র দেশের মানুষের লড়াই, দেশ বাঁচানোর লড়াই।
অন্নদাতাদের অস্তিত্ব রক্ষার এই জীবনপণ লড়াইয়ের প্রধান বিষয় হল কৃষিক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়া কোম্পানিরাজ তথা বেসরকারীকরণ নীতি। দেখা গেল কৃষি-শিল্প-স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রভৃতি দেশের সমস্ত ক্ষেত্রে কর্পোরেট দখলদারির বিরুদ্ধে আজ গড়ে উঠেছে সর্বস্তরের মেহনতী জনগণের সংহতি। যেমন বর্তমানে জ্বলন্ত সংকট রূপে হাজির হয়েছে করোনা প্রতিরোধে সরকারের চরম ব্যর্থতা, যা গণহত্যা বলে অভিহিত হচ্ছে। এটা সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংসকারী বেসরকারীকরণ নীতিকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিচ্ছে। তাই ৭ বছর পূর্ণ করা মোদী রাজ আর নয় - দিকে দিকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে এই আওয়াজ।
দিল্লীর কিষাণ আন্দোলন দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত কৃষকের দাবিগুলিকে অনেকটাই দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে এনে হাজির করেছে। সেগুলি মেহনতী জনগণের দাবিগুলির সাথে একীকৃত হয়ে উঠেছে। যথা, কৃষিপণ্যের সরকারী ক্রয় বন্ধ করে দেওয়া, রেশন ব্যবস্থা, মিড-ডে-মিলের শিশুখাদ্য ব্যবস্থাকে বিলোপ করে দেবে৷ নয়া পণ্য আইন কালোবাজারী, মজুতদারি, মূল্যবৃদ্ধি তীব্র করে করবে। চুক্তিচাষ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ধ্বংস করবে। এই সমস্ত দিকগুলি ব্যপক মানুষকে কৃষকদের পাশে ঐক্যবদ্ধ করেছে। ফ্যাসিষ্ট দমননীতি চালিয়ে কৃষকের আন্দোলনকে আর সহজে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ধর্মীয় মেরুকরণ সৃষ্টির অপচেষ্টাকে গরিব শ্রেণীগুলির একতা বহুলাংশেই অকার্যকর করে দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী গণরায় এই দিকগুলিকে সামনে নিয়ে এসেছে। ২৬ মে’র কালা দিবসে এই রাজনৈতিক প্রচার তুলে ধরা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের বুকে ২৬ মে দিনটিতে ছিল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের দাপট। বেশ কয়েকটি জেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন, ঘরবাড়ি-জমি-গবাদি পশুর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। করোনা লকডাউন জনজীবনকে অস্বাভাবিক করে দিয়েছে। প্রবল বৃষ্টিপাত, ঝোড়ো হাওয়া সহ প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও বিভিন্ন জেলায় ব্লক শহর, গঞ্জ এবং বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে প্রতিবাদ কর্মসূচী সংগঠিত হয়েছে। সারা ভারত কিষাণ মহাসভার পক্ষ থেকে এবং বিভিন্ন গণসংগঠনের যৌথ উদ্যোগে রাজ্যের বহু স্থানে কালা দিবস পালিত হয়েছে।
নদীয়া জেলার রিপোর্ট
নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া ব্লকের পাটপুকুর গ্রামে সকাল সাড়ে ৮টার সময় গ্রামের কৃষক কর্মীরা সমবেত হন। তখন হাল্কা বৃষ্টি চলছে, বৃষ্টির খানিক বিরতি হলেই স্থানীয় স্কুলের পার্শ্ববর্তী স্থানে কালা দিবসের কর্মসূচী শুরু করা হয়। মোদী সরকারের নয়া কৃষিনীতির বিরুদ্ধে স্লোগান তোলা হয়। কর্মীদের হাতে হাতে ছিলো কালো পতাকা, বিভিন্ন দাবি সম্বলিত পোস্টার। যাতে লেখা ছিলো কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম গ্যারান্টি আইন চালু করা, সকলের জন্য করোনা টিকার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। এছাড়া সার ডিজেল ভর্তুকি দিয়ে সূলভে সরবরাহ, সরকারী দরে ‘দুয়ারে দুয়ারে’ ধান কেনার জ্বলন্ত দাবিও তুলে ধরা হয়। উল্লেখ্য ১,৮৬৫ টাকা কুইঃ সরকারী দর থাকা স্বত্বেও ব্লক কৃষি দপ্তর ধান কেনার কোন ব্যাবস্থাপনা গড়ে তোলেনি। ফলে ১,২৫০-১,৩০০ টাকায় চাষীরা লোকসানে মহাজনদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কর্মসূচীতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জয়তু দেশমুখ। উপস্থিত ছিলেন সেলিম মন্ডল, হবিবুর রহমান সেখ, রাজীবুদ্দিন সেখ প্রমূখ। খারাপ আবহাওয়া স্বত্বেও এই কর্মসূচী এলাকার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
-- জয়তু দেশমুখ
করোনা অতিমারীর সংকটের মুহূর্তে যখন দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন, দৈনিক কোভিড সংক্রমণের হার বাড়ছে তীব্র গতিতে, অক্সিজেন-ওষুধ-হাসপাতালে বেডের অভাবে জায়গায় জায়গায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ, তখন এই সময়ের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে, নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজ্যজুড়ে মানুষের সাহায্যে ছুটে বেড়াচ্ছে এক ঝাঁক ছাত্রছাত্রী, ওদের পরিচয় - ওরা কোভিড ভলান্টিয়ার্স। এই উদ্যোগের পেছনে উদ্যোগী আইসা (এআইএসএ)। এই স্বেচ্ছাসেবক টিম কাজ করেছে মূলত সাতটি জেলায় - কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলী, মুর্শিদাবাদ এবং বাঁকুড়ায়।
কলকাতা
কলকাতায় মূলত চারটি অঞ্চল জুড়ে সক্রিয় আছে কোভিড ভলান্টিয়ার্স টিম।
উত্তর কলকাতার (শুভাশীষ - ৮২৪০৭৯২২৩৪) শ্যামবাজার থেকে মৌলালী পর্যন্ত এলাকায় এই কাজে যুক্ত রয়েছেন ২০ জন ভলান্টিয়ার। ২৪ ঘন্টা হেল্পলাইন পরিষেবায় দেওয়া হচ্ছে অক্সিজেন, এ্যাম্বুলেন্স, টেস্টিংয়ের সন্ধান, পাশাপাশি বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাইকেল করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী।
দক্ষিণ কলকাতার (রুদ্র-৮০১৭৪৬২৬৪২) পার্ক সার্কাস থেকে গড়িয়া পর্যন্ত সমানতালে চলছে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ, যুক্ত রয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক পড়ুয়া। আবেদন যখনই আসুক, জোর কদমে চলছে হেল্পলাইন ও ডেলিভারি পরিষেবা।
মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচ-খিদিরপুর (আফশা - ৭২৭৮১১১০৩৮) এলাকায় হেল্পলাইনের পাশাপাশি ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য এলাকায় সচেতনতা মূলক প্রয়াস।
বেহালায় (অভিজিৎ- ৮৭৭৭৭৩৪৩৫৫) আরওয়াইএ’র সাথে যৌথ উদ্যোগে কাজ হচ্ছে দুটি অঞ্চল ভাগ করে - পূর্ব ও পশ্চিম বেহালায়, যুক্ত আছেন ১৫ জন ভলান্টিয়ার। বাড়ি বাড়ি প্রয়োজনীয় সামগ্রী, ওষুধ, হেল্পলাইন পরিষেবার পাশাপাশি চলছে এলাকায় দৈনন্দিন স্যানিটাইজেশনের কাজ – উদ্যোগ পৌঁছে যাচ্ছে তৃণমূল, সিপিএমের পার্টি অফিসেও।
এছাড়াও যাদবপুর-ঢাকুরিয়া অঞ্চলে কাজ করছে এলাকার ছাত্রছাত্রীরা, তাদের পরিচয় ‘বোকাবুড়ো’ (আকাশ- ৯৮৩০৪৫১৭৬৭), এই কোভিডকালে এলাকায় ভরসার আর এক নাম।
হাওড়া
বালি-বেলুড় গ্রামাঞ্চল-পৌরাঞ্চল জুড়ে (অঙ্কিত- ৭০০৩৮০৬৯৫৬) এখন সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘সংহতি হেঁসেল’। স্বল্পমূল্যে এবং প্রয়োজনে বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাবার, দেওয়া হচ্ছে ওষুধপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী। হেল্পলাইন পরিষেবাও চলছে সমানতালে। আমাদের এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্ত হচ্ছেন এলাকার আরও অনেক ছাত্রছাত্রী এবং নাগরিক সমাজের অন্যান্যরাও।
হুগলী
উত্তরপাড়া, হিন্দমোটর, কোন্নগর, রিষড়া জুড়ে (সৌরভ- ৮৭৭৭০৮৮২৯০) চলছে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ। হেল্পলাইনের পাশাপাশি, অক্সিজেনের সন্ধান, বাড়িতে রান্না করে খাবার পৌঁছে দেওয়া – সবই চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। এই কর্মকান্ডে যুক্ত আছেন আরওয়াইএ’র যুব কর্মীরাও।
বাঁকুড়া
বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর মিউনিসিপালিটি (ফারহান-৮৩৪৮৯১২৭৯৮) জুড়ে কাজ করছেন ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক। এই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুক্ত হচ্ছেন এলাকার সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা, থাকছেন বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজের অধ্যাপকরাও। এই উদ্যোগে পাশে থাকছে সমাজসেবী সংস্থা ‘উত্তরণ’, পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাবার, ওষুধ সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী।
মুর্শিদাবাদ
লালগোলা-ভগবানগোলা অঞ্চলে (নূর-৬২৮৯৮৬১৬৪৪) কাজ চলছে জোরকদমে। আইসা’র সাথে সদ্য সম্পর্ক হওয়া এলাকার ১০-১২ জন ছাত্রছাত্রী সময়ের দাবিকে মান্যতা দিয়ে এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রিফিল করে পৌঁছে দিচ্ছেন অক্সিজেন, সাথে ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন হাসপাতালে ভর্তির। এলাকার মানুষের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে কাজের গতি বাড়ছে দৈনন্দিন।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
দক্ষিণ ২৪ পরগণায় মূলত কাজ হচ্ছে দুটি অঞ্চল জুড়ে।
ক্যানিং, বারুইপুর, সোনারপুর অঞ্চলে (সৌমী- ৮২৪০৪৬১৭৪৯) চলছে হেল্পলাইন পরিষেবা, বিভিন্ন সময়ে অর্থাভাবে থাকা রুগীদের জন্য দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা খরচও।
বজবজ, বিষ্ণুপুর, সাতগাছিয়া অঞ্চলে (দীপ- ৭৪৩৯৪৬১৩৭৪) হাসপাতালে বেডের হদিস থেকে শুরু করে অন্যান্য জরুরি কাজেও থাকছেন স্বেচ্ছাসেবকরা - পৌঁছে দিচ্ছেন অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদি। এই উদ্যোগে সামিল হচ্ছেন এলাকার সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও।
উত্তর ২৪ পরগণা
দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে জেলায় কোভিড ভলান্টিয়ার্সদের কাজ। জেলার নয়টি অঞ্চলে বিস্তৃত এই কাজে অংশগ্রহণ করেছে বহু ছাত্রছাত্রী, যাদের অধিকাংশই এই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে।
দক্ষিণ দমদম অঞ্চলে (ত্রিজিত- ৭২৭৮৪২৬৭০৯) ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবকের উদ্যোগে দমদম-পাতিপুকুর-লেকটাউন- ক্যান্টনমেন্ট-এয়ারপোর্ট অঞ্চল জুড়ে চলছে পরিষেবা। হেল্পলাইনের পাশাপাশি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ওষুধপত্র, অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী।
বেলঘরিয়া, বরানগর, আড়িয়াদহ (বিশ্ব- ৯৩৩০৪৭৪০৬০) জুড়ে চলছে পরিষেবা, যুক্ত রয়েছেন ২০ জন ভলান্টিয়ার। ওষুধ, দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, এলাকা ও কোভিড পেশেন্টদের বাড়ি স্যানিটাইজ করা, রুগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া, নিয়মিত অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া, ঝড়-জল-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমস্ত কাজই চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। এলাকার মানুষের কাছে এই দুর্দিনে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রয়াস হয়ে উঠছে প্রশংসাযোগ্য, পাশে পাওয়া যাচ্ছে সাধারণ ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের অন্যান্যদের। আগামীদিনে পরিকল্পনা আছে একটি ‘সংহতি হেঁসেল’ চালু করার।
ব্যারাকপুর থেকে কাঁচড়াপাড়া (শুভ্র- ৮৬১৭৭৪৭৫০৩) বিস্তৃত শিল্পাঞ্চলের পাশাপাশি নৈহাটি-জগদ্দল গ্রামাঞ্চল জুড়ে পরিষেবা দিয়ে চলেছে কোভিড ভলান্টিয়াররা। অক্সিজেন সিলিন্ডার, ওষুধ নিয়ে ব্যাপক প্রতিকূলতাকে জয় করে শহর ও গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে স্বেচ্ছাকর্মীরা, সাথে থাকছে স্যানিটাইজেশনের পরিষেবাও। এই কাজে দিনরাত যুক্ত থাকছেন ২৫ জনের বেশি ভলান্টিয়ার্স।
রাজারহাট (শুভদীপ- ৮৯১০২৯৯৭৬১) অঞ্চলে চিনার পার্ক থেকে সল্টলেক পর্যন্ত কোভিড ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে অক্সিজেন, দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের হদিস। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বলা যেতে পারে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রথম পর্বের ছাত্রনেতা অসীম চ্যাটার্জি গুরুতর অসুস্থ হলে কর্মীরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে অক্সিজেন পরিষেবার বন্দোবস্ত করে দেয়, এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান প্রবীণ অসীম চ্যাটার্জি।
নিউ ব্যারাকপুর-বিশরপাড়া-মধ্যমগ্রাম (আমন- ৮০১৩৫৬২০৯৩) অঞ্চল জুড়ে ছাত্রছাত্রীদের যোগদানে চলছে পরিষেবা দেওয়ার কাজ। হেল্পলাইন পরিষেবার পাশাপাশি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ওষুধপত্র-অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী। এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্ত হয়েছেন এলাকার সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা।
বারাসাত (আবির- ৯৭৪৮৯২৫২২৪) স্টেশন চত্বর থেকে শুরু করে নেতাজী পল্লী, ঠাকুরনগর পল্লী পর্যন্ত এলাকায় কাজ করছেন কর্মীরা। হেল্পলাইনের পাশাপাশি খাবার পৌঁছে দেওয়া, এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা, ওষুধ-অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া - সময় যখনই হোক, রাত ১টা বা ভোরবেলা, স্বেচ্ছাসেবীরা পৌঁছে যাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে।
বনগাঁয় (পৌষালী- ৭০০৩৫০৭৬৬৫) বেশ কিছু অঞ্চলে জারি আছে হেল্পলাইন পরিষেবা। এই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুক্ত হয়েছেন ছাত্রীদের একটা অংশ। ছাত্রীদের নেতৃত্বেই চলছে এই কর্মকান্ড।
গোবরডাঙ্গা (সায়ন- ৯৮৮৩৬৬৪৬০৫) থেকে শুঁটিয়া এবং অন্যদিকে মসলন্দপুর পর্যন্ত চলছে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ, সেখানে যুক্ত আছেন ৩৫ জন ছাত্রছাত্রী। অক্সিজেন, এ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি অর্থাভাবে থাকা কোভিড রুগীর পরিবারকে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত রেশনও। সামাজিক সংহতির এক অনন্য নজির এই ঘটনা এবং এআইএসএ’র উদ্যোগে চলা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এলাকায়।
অশোকনগর-হাবড়া (প্রীতম- ৯০৯১১৭২৭১৬) পৌর এলাকা জুড়ে ৩০ জন ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণে চলছে কোভিড ভলান্টিয়ার্স টিম। নেতৃত্বে আছে নাগরিক উদ্যোগের মঞ্চ ‘সুচেতনা’। অক্সিজেন, খাবার, ওষুধ, এ্যাম্বুলেন্স, সমস্ত কিছুই পৌঁছে যাচ্ছে কোভিড আক্রান্তদের কাছে। সাথে চলছে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির কর্মীরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যুক্ত হয়েছেন এই উদ্যোগে।
এছাড়াও হাবড়া ব্লক-২ রাজীবপুর, বরাহনগর, খড়দহ অঞ্চলেও বেশ কিছু যুবদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, দ্রুত কোভিড ভলান্টিয়ার কাজ শুরু করা হবে।
এছাড়াও রাজ্যের আরও বেশ কিছু অঞ্চলে ভলেন্টিয়ার্স টিম তৈরির প্রস্তুতি চলছে।
ইতিমধ্যেই যে সমস্ত অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ চলছে, সেখানে তাদের কাজ যাতে নির্বিঘ্নে এবং সুরক্ষিত ভাবে এগিয়ে যেতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে আইসা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে পিপিই, ফেসশিল্ড, মাস্ক সহ সেফটি কিট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ভলান্টিয়ার্স টিমগুলির কাছে।
এই কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে যে বহু মানুষজন আর্থিকভাবে সহায়তা করছেন, তাদের প্রতি এই ছাত্র-যুব বাহিনী কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। আগামীদিনে আরোও কিছু বহুমুখী উদ্যোগ পরিকল্পনার নেওয়ার আছে। সেই কাজে সংবেদনশীল নাগরিক সমাজের সকলের উদ্দেশ্যে আবেদন থাকছে -- সাধ্যমত সহযোগিতার জন্য অর্থ সাহায্য করতে পারেন এই একাউন্টে :
SOURAV ROY
Account No. 31072403165
State Bank of India, Konnagar Branch
IFS Code - SBIN0002078
Google pay Number – 9038900672
বেলঘরিয়ার রিপোর্ট
টেলিভিশনের আলো ঝলমল প্রচার বা খবরের কাগজের অতি প্রচার নেই, নেই ক্যামেরার ফ্লাশের ঝলকানি। বেলঘরিয়া এআইএসএ ‘কোভিড ভলেন্টিয়ার্স’ টিম নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে, বৃষ্টিতে ভিজে সায়ন্তন, অয়ন এবং বিশ্ব তিন ‘করোনা যোদ্ধা’ পৌঁছে গেল ৯নং, বিটি রোড, গভঃ কোয়ার্টার। সেখান থেকে করোনা রোগী নিয়ে গিয়ে সাগর দত্ত হাসপাতালে পৌঁছে দিল এবং রোগীর অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা ভর্তি করে নিলেন। ভলেন্টিয়াররাও খুশি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পেরে। এই ছাত্র যুবরা শুধুমাত্র দলের নয়, সমাজের সম্পদ। এদের লাল সেলাম। সাথে সাথে তাদের মা ও বাবা এইসব ছেলেদের যে ভাবে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাওয়ার জন্যে উৎসাহিত করছেন, তাদেরও শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
-- নবেন্দু দাশগুপ্ত
বিষ্ণুপুরের রিপোর্ট
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন চলাকালীন ১৬ই মে থেকেই বিষ্ণুপুর মিউনিসিপ্যালিটি অঞ্চলের মধ্যেই করোনা আক্রান্ত পরিবার গলির নিকট রান্নাকরা খাবার, ঔষুধ ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিষ্ণুপুরেরই কিছু তরুণ প্রজন্মের ছাত্রদল। আইসা কোভিড ভলেন্টিয়ার এই উদ্যোগ শুরু করেছে লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই। একইসাথে তারা খ্রিস্টান কলেজের অধ্যাপক এবং ‘উত্তরণ’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় বাঁকুড়া মিউনিসিপ্যালিটির ভিতরেও রান্নাকরা খাবার সহ ঔষুধপত্র বা প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী প্রদানের কাজ শুরু করেছে ১৮ মে থেকে। সন্ধ্যাকালীন ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেও এই কাজ অনবরত চলছে শুধুমাত্র সংকট ও দুরবস্থায় থাকা সহনাগরিকদের সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্যই। একটি ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে ভলেন্টিয়ার টিমের হেল্প ডেস্কে। কোভিড ও নন-কোভিড পেশেন্টদের অক্সিজেন, হাসপাতালে বেড, অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ, ডাক্তার মারফত ফোনে যোগাযোগ করে দেওয়া, টেস্টিং সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের কাজ বিগত ৫ই মে থেকেই সারা বাঁকুড়া জেলা জুড়ে শুরু করেছে ‘কোভিড ভলেন্টিয়ার্স AISA (বাঁকুড়া wing)’। ইতিমধ্যে (১৮ মে পর্যন্ত) ৪০’র অধিক রোগীর সহযোগিতা করা গেছে ফোন মারফত। একইসাথে নতুন উদ্যোগে কোভিড আক্রান্ত পরিবারের কাছে খাবার ও আনুসাঙ্গিক দ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করে আরো মানুষকে সাহায্য পৌঁছানোর চেষ্টা আমরা করছি।
-- তিতাস গুপ্ত
বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে শ্রমিক ও হিন্দিভাষী ভোটাররা কোন দিকে ভোট দেবেন রীতিমতো আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দুতে ছিল। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনে শিল্পাঞ্চলে হিন্দিভাষী শ্রমিকের বেশিরভাগ ভোট বিজেপি পেয়েছিল। চারিদিকে গুঞ্জন হিন্দিভাষী মানেই বিজেপি। ফল বেরোনোর পর বোঝা গেল কলকাতা সহ শিল্পাঞ্চলে হিন্দিভাষী ভোটের সিংহভাগই বিজেপি বিরোধী শিবিরে গেছে। অর্থাৎ তৃণমূল পেয়েছে। শহরের মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ও জিএসটি’র কারণে বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষ কেন্দ্রের জনবিরোধী শিল্পনীতি ও শ্রমনীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। গোটা রাজ্যের মতো শিল্পাঞ্চলেও ভোটের শতাংশ হারে টিএমসি ৪৮ শতাংশ, বিজেপি ৩৭ শতাংশ এবং সংযুক্ত মোর্চা ৮ শতাংশ পেয়েছে।
তুলনামূলকভাবে বিহার, ঝাড়খন্ড সীমানা লাগোয়া এলাকায় হিন্দিভাষীদের উপর বিজেপি সামান্য প্রভাব ফেলতে পেরেছে। যেমন, আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে মোট আসন সংখ্যা ৯; তারমধ্যে তৃণমূল ৬টি এবং বিজেপি ৩টি আসন পেয়েছে। টিএমসি’র জেতা আসনগুলোর মধ্যে সরচেয়ে বেশি মার্জিন রয়েছে বারাবনি ও আসানসোল (উঃ) আসন দুটিতে। টিএমসি এখানে বিজেপি’র থেকে ১৪ শতাংশ ও ১১ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। টিএমসি’র সবচেয়ে কম মার্জিনে (২ শতাংশ) জেতা আসন পাণ্ডবেশ্বর ও রানিগঞ্জ। বাকি আসনগুলোতে টিএমসি’র জয়ের মার্জিন ৫ থকে ১০ শতাংশ।
কুলটি বিধানসভায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বিজেপি জিতেছে ৬৭৯ ভোটে। শতাংশের বিচারে উভয় প্রার্থীই ৪৬ শতাংশ করে ভোট পেয়েছেন।
আসানসোল (দঃ) আসনটি বিজেপি তৃণমূলের থেকে ২ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে জিতে নেয়। দুর্গাপুর (পশ্চিম) আসনটিতে বিজেপি ৭ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে টিএমসি’কে হারিয়েছে। আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে সংযুক্ত মোর্চা জামুরিয়া ও দুর্গাপুর (পূঃ) উভয় কেন্দ্রে ১৫ শতাংশ করে ভোট সিপিএম পেয়েছে যা তাদের সর্ব্বোচ্চ। সর্বনিম্ন ২ ও ৩ শতাংশ যা আইএসএফ ও কংগ্রেস পেয়েছে।
দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলে ইস্পাত কারখানা, কয়লা, রেলওয়ে শেড, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ প্রভৃতি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু এখানকার শিল্প পরিস্থিতি বর্তমানে ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ। হিন্দুস্তান কেবলস, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, এমএএমসি, হিন্দুস্তান ফার্টিলাইজার বন্ধ। ধুঁকছে বার্নপুর ইস্কো সহ রাস্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্প। চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা বেসরকারীকরণের দিকে এগোচ্ছে। এই কারখানা থেকে সিএলডব্লিউ বরাত কেটে বারাণসী ডিএলডব্লিউ’তে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে ১৬টা কয়লাখনি বন্ধের নোটিশ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা রায় দিয়েছেন। এখানে প্রায় ৪০ শতাংশ হিন্দিভাষী মানুষ, তাদের বেশিরভাগই জীবন জীবিকার স্বার্থে বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন।
হাওড়া শিল্পাঞ্চল মিশ্র এলাকা। এখানেও বহু হিন্দিভাষী মানুষের বাস। বিজেপি হাওড়া দখলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ‘যোগদান মেলা’ করে প্রতিদিন টিএমসি’র মন্ত্রী বিধায়কদের বিজেপি’তে যোগদান করাতে থাকে। প্রচার এতো জোরালো ছিল যে মনে হতে থাকে এখানে বিজেপি ছাড়া আর কোন দলের অস্তিত্বই নেই। এদিকে হাওড়ার ঢালাই কারখানা, ইঞ্জিনিয়ারিং, চটকল, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প বিগত কয়েক বছর ধরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। গতবছরের লকডাউনে শ্রমিকদের আর্থিক পরিস্থিতি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। রামনবমী থেকে শুরু করে হিন্দুত্বের জোরালো বিভাজনের প্রচারে বিভিন্ন সময় হাওড়াকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু শ্রমিকরা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমনীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। বালি, হাওড়া (উঃ), হাওড়া (দঃ), হাওড়া (মধ্য), সাঁকরাইল সবকটি আসনেই বিজেপি হেরেছে। রায় টিএমসি’র পক্ষে গেছে।
হুগলি জেলায় শিল্প মানচিত্রে চটকল, বস্ত্রশিল্প, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা, চর্মশিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি সহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। পাশাপাশি ডানলপ টায়ার ও হিন্দমোটরের মতো অজস্র কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হুগলি জেলায় সিঙ্গুরে কৃষি জমিতে টাটার ন্যানো গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, যারফলে ২০১১ সালে নির্বাচনে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। হুগলিতে বিধানসভা আসন ১৮টি। তারমধ্যে আরামবাগ মহকুমার ৪টি আসন দখল করেছে বিজেপি। বাকি ১৪টি আসনে তৃণমূল জিতেছে। অর্থাৎ, এই জেলার বাকি তিন মহকুমা শ্রীরামপুর, সদর এবং চন্দননগর তৃণমূলের পক্ষে গেছে। এই প্রথম হুগলি শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিল বামেদের। ঝুলি শূন্য কংগ্রেসেরও। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে চাঁপদানিতে কংগ্রেস এবং পান্ডুয়ায় সিপিএম জিতেছিল।
শ্রমিক অধ্যুষিত চাঁপদানি, পান্ডুয়া, ভদ্রেশ্বর, কোন্নগর ডানকুনি, ত্রিবেণী, বাঁশবেড়িয়া সব জায়গায় টিএমসি জিতেছে। হুগলির শিল্পাঞ্চলে হিন্দি ও উর্দুভাষীরা বিজেপি’র বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা হল সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় জেলা। কৃষি, মাছ, বনাঞ্চল থেকে মধু সংগ্রহ, ভ্রমণ এবং শিল্প নিয়ে এখানকার অর্থনীতি গড়ে উঠছে। এখানে চটকল, ইন্ডিয়ান অয়েলের তেল সরবারহ কেন্দ্র, ইঞ্জিনিয়ারিং সহ ছোট মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। ফলতা শিল্প শহর বলে পরিচিত। ফলতায় ২৮০ একর জমির ওপর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) সূত্রপাত হয়। ২৮০ একরের মধ্যে ১৯৩ একর অর্থাৎ বেশিরভাগটাই ছিল কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের জমি। বাকি ৮৭ একর জমি কৃষকদের বাস্তু ও কৃষিজমি, যা অধিগ্রহণ করা হয়। এই শিল্পাঞ্চল প্রধাণত কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গড়ে উঠলেও রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তারাই কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করে, বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করে দুটো গ্রামের অধিবাসীদের অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করে। অতঃপর শিল্পাঞ্চল নিরুপদ্রবে চালনা করার যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলতার এই শিল্পাঞ্চলটি ২০০৩ সালের গোড়ায় ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ‘এসইজেড’এ রূপান্তরিত হয়। (সূত্র: ফলতা উইকিপিডিয়া) এখানকার শিল্পাঞ্চলে বাংলাভাষী ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষের বাস বেশি। এখানে সর্বত্র টিএমসি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। সিপিএমের সর্বোচ্চ ভোট ১৭ শতাংশ ও কংগ্রেসের ৭ শতাংশ। একমাত্র বিষ্ণুপুর তফসিলি আসনটি বিজেপি ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছে। সেই অর্থে তফসিলি জাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে থাকা জাতিগুলির মধ্যে বিজেপি’র অনুপ্রবেশ ভালো পরিমাণে ঘটেছে। এরকম ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগণার শ্রমজীবী মানুষ বিজেপি’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
উত্তর ২৪ পরগণা বিধানসভা আসন সংখ্যা ৩৩টি। এরমধ্যে ১৪টি আসন হল শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলে। বিভিন্ন পেশা, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা মিলে এক মিনি ভারতবর্ষ চোখে পড়ে। এখানে ভারী, বৃহৎ, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং সরকারী উদ্যোগগুলো আছে। একমাত্র ব্যারকপুর শিল্পাঞ্চলে ভাটপাড়া আসনটি বিজেপি জিতেছে। এখানে বিজেপি তৃণমূলের ভোটের পার্থক্য ১২% (বিজেপি ৫৩%, টিএমসি ৪১% এবং কংগ্রেস ২%)। এই কেন্দ্রে হিন্দিভাষী ৩৫% এবং উর্দুভাষী মুসলমান জনসংখ্যা ১৪.৪৬%। জেলায় গড়ে ভোট পেয়েছে টিএমসি ৪৭%, বিজপি ৩৭% সংযুক্ত মোর্চা ১০% পেয়েছে।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় চটকল, বস্ত্র, ভারী ইঞ্জনিয়ারিং, চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি, সিরামিক, হ্যাল, রাইফেল ফ্যাক্টরি, কাঁচরাপাড়া রেল ওয়ার্কশপ, এছাড়াও হোসিয়ারি, ব্যাগ সহ অসংখ্য ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প আছে। এদিকে বন্ধ হয়ে গেছে বড়, মাঝারি, ছোট নিয়ে কয়েকশত শিল্প প্রতিষ্ঠান। কর্মচ্যুত হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
দুর্গাপুর আসানসোল, হাওড়া, হুগলি, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা শিল্পাঞ্চলে ধর্ম বা ভাষার কোন মেরুকরণ হয়নি। এখানে মোদী সরকারের শ্রমিক বিরোধী শিল্পনীতি ও শ্রমনীতির বিরুদ্ধে শ্রমিকরা এককাট্টা হয়েছেন। বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে লকডাউন, প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা, মূলবৃদ্ধি, কারখানা বন্ধ, বেসরকারীকরণ, ৪টি শ্রম কোডের বিরুদ্ধে শ্রমিকের স্পষ্ট মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ধর্মঘটের প্রভাবও শ্রমিকদের এই রায়ের মধ্যে আছে। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ শ্রমিকদের মধ্যে কিছুটা প্রভাব ফেলেতে পেরেছে। ফলে ‘হিন্দিভাষী মানেই বিজেপি’ এই আষাঢ়ে গল্পেরও ইতি হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয় আলোচনায় সামনে এসেছে। উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে মোদী বিরোধী যে হাওয়া উঠছে এই রায়ে তার ইঙ্গিত আছে। এছাড়াও বিহারের আরজেডি, ঝাড়খন্ডের জেএমএম এবং উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টি মমতাকে সমর্থন দেওয়ায় বাংলার ভোটে তার প্রভাব পড়েছে।
উত্তর বাংলায় সত্তাপরিচিতির আন্দোলন এখনো মূল ধারা হিসেবে আছে
উত্তর বাংলায় চা শিল্প একমাত্র সংগঠিত শিল্প। এই ক্ষেত্রে প্রায় ৪.৫ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত। এদের উপর নির্ভরশীল ১২ লক্ষ মানুষ। বিগত ৬-৭ বছর ধরে চা বাগানে ন্যূনতম মজুরি এবং স্থায়ী শ্রমিকদের বস্তির জমির পাট্টার দাবিতে আন্দোলন চলছিল, ট্রেড ইউনিয়নগুলির যুক্তমঞ্চের তরফ থেকে। এই আন্দোলনে বামপন্থীরা নেতৃত্বে ছিলেন। রাজ্য সরকারের উপর আন্দোলনের চাপ বাড়িয়ে কিন্তু ইউনিয়নগুলি দাবি আদায় করে নিতে পারেনি। বিজেপি সুচতুরভাবে নির্বাচনী প্রচারে এই ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ঘোষণা করে ক্ষমতায় এলে ৩৫০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ও জমির পাট্টা দেওয়া হবে। চা শ্রমিকেরা এই প্রচারে প্রভাবিত হয়ে বিজেপি’কে ঢেলে ভোট দিয়েছে। এখানে আর একটা বিষয় লক্ষনীয়, ‘সংযুক্ত মোর্চা’র সংঘবদ্ধ প্রচার খুব কম ছিল। ২০১৬ সালে কংগ্রেস যেমন বামেদের ভোট দেয়নি, বামেরা এবার কংগ্রেসকে বঞ্চিত করেছে। কংগ্রেসের গড় ভোট সেই ইঙ্গিতই দেয়। তাহলে বামেদের ভোট কোথায় গেল? বিচারের ভার পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম! পাহাড়ের তিনটি কেন্দ্রে গোর্খা জনমোর্চার ভাঙনকে বিজেপি পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়েছে। প্রচুর টাকা ছড়িয়ে, বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতিকে সম্বল করে চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলে বিজেপি সাফল্য পেয়েছে। রাজবংশী, আদিবাসী ও গোর্খা জনজাতির ‘সত্তাপরিচিতি’ আন্দোলনে ধর্ম, জাতপাত ও ভাষার বিভাজনের বিষাক্ত রাজনীতি প্রচার করেছে। এমনকি এনআরসি’র পক্ষেও প্রচার চালায়। এখানে ‘নো ভোট টু বিজেপি’র প্রচার তুলনামূলকভাবে কম ছিল যা মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি। একমাত্র ব্যাতিক্রম মালবাজার বিধানসভা আসনটি যা তৃণমূল পেয়েছে।
বিধানসভা কেন্দ্রগুলো দেখে নেওয়া যাক।
দার্জিলিং জেলায় ৫টি আসন। পাহাড়ে কার্সিয়াং, দার্জিলিং আসন বিজেপি পায় এবং কালিম্পং আসনটি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (বিনয় তামাং গোষ্ঠী) জিত হাসিল করেছে। গোর্খা জনমোর্চার দুটো গোষ্ঠীর ভোট ভাগাভাগিতে বিজেপি’র প্রভুত সুবিধা হয়। এছাড়াও জিএনএলএফ বিজেপি’কে সমর্থন দেওয়ায় সহজেই জয় পায়।
মাটিগাড়া-নকশালবাড়ী ও ফাঁসিদেওয়া দুটি বিধানসভা আসন। এখানে চা বাগান ও কৃষি নিয়ে মিশ্র অর্থনীতি চালু আছে। বাগানে শ্রমিকরা আদিবাসী এবং কৃষিক্ষেত্রে বেশিরভাগ রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের মধ্যে আরএসএস’এর পরিকল্পিত নিবিড় কাজ আছে, বিজেপি নিজের শক্তি বাড়িয়ে দুটো আসনই জিতে নেয়। ২০১১ ও ২০১৬ সালে এই আসন দুটিতে কংগ্রেস জিতেছিল, এবার তৃতীয় স্থানে চলে যায়।
আলিপুরদুয়ার জেলায় ৫টি আসনে বিজেপি জয়লাভ করেছে। চা বাগানে আদিবাসী ও গোর্খা সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। এখানকার ৩টি আসন কুমারগ্রাম, মাদারিহাট, কালচিনি বিজেপি জিতেছে। জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার ও নাগরাকাটা বিধানসভা চা বাগান এলাকা। মালবাজার আসনটি তৃণমূল এবং নাগরাকাটা বিজেপি পেয়েছে।
বিজেপি কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিঙে অধিকাংশ আসন জেতে। রাজবংশী, নেপালী, আদিবাসীরা বিজেপি’কে ভোট দিয়েছে। বামপন্থী আন্দোলন যত দুর্বল হয়েছে, দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তি ততো বেড়েছে। পাশের রাজ্য আসামে এবারও বিজেপি জিতেছে, এর প্রভাবও পড়তে পারে। আরও বিস্তারিত মূল্যায়ণের দাবি করে।
ভোটের যে হার তাতে বাম আন্দোলন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য খুবই চিন্তাজনক। বিজেপি ৫টা কেন্দ্রে ৫০ শতাংশের বেশি, ৪টি কেন্দ্রে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। একটা আসন টিএমসি ৪৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জিতেছে। বামেদের অবস্থা শোচনীয়। পাহাড়ে তিনটি কেন্দ্রে বামেদের সর্বোচ্চ ভোট ১.৫ শতাংশ। তরাইয়ে সর্বোচ্চ ভোট ৯.৩ শতাংশ। আলিপুরদুয়ার জেলায় সর্বোচ্চ ভোট ৪.৯ শতাংশ। জলপাইগুড়ি জেলায় ৯.৩ শতাংশ।
গোর্খা জনজাতিসত্তা, আদিবাসী ও পিছিয়ে থাকা রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের দাবি ও মর্যাদা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যুক্ত করার সময় এসে গেছে বলেই মনে হয়।
কথা শেষে এটা বলতেই হয় বাংলার শ্রমিকশ্রেণি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন। আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের তারতম্য আছে, সবকিছুই একইভাবে হবে না। শ্রমিকশ্রেণির বেশির ভাগ অংশ বিজেপি’র ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’কে প্রত্যাখ্যান করেছে। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের কাছে চ্যালেঞ্জ, সমগ্র শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার।
-- নবেন্দু দাশগুপ্ত
কমরেড শৈলেন্দ্র নাথ মিত্র গত ২০ মে হাওড়ার এক বেসরকারী হাসপাতালে মারা যান। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন। প্রয়াত কমরেড প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্মরত অবস্থায় সিপিআই (এম-এল)’র সদস্য ছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়দায়িত্ব পালন করতেন। অবসর নেওয়ার পর পার্টির জেলার সঙ্গে যুক্ত হন, আমৃত্যু পার্টি সদস্য ছিলেন। পার্টির মধ্য হাওড়া লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়।
দীর্ঘদিনকার প্রবীণ কমরেড শৈলেন্দ্র মিত্র বহু পার্টি কর্মীর কাছে প্রদীপদা নামে পরিচিত ছিলেন। ৭০ দশকে পার্টির কাজ করার সময় জেল খেটেছেন, পরে পার্টি পুনর্গঠনের পর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। শিল্পগত পার্টি কাঠামোর সদস্য ছিলেন। পার্টির বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন বিশেষত ৫ম পার্টি কংগ্রেসের সময়, শ্রমিক সংগঠন ডব্লিউএসও গঠন হোক বা এআইসিসিটিইউ গঠনপর্বে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯০’র ৮ অক্টোবর “দাম বাঁধো, কাজ দাও, নইলে গদী ছেড়ে দাও” দিল্লি অভিযানেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া পার্টির পথনির্দেশে প্রতিরক্ষা শিল্পে টিইউ স্তরে ফ্রাকশনাল কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি হয়েছিলেন এবং কার্যকরি সমিতির সদস্য ছিলেন। কমরেড প্রদীপদা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে তিনি যেমন জঙ্গি টিইউ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তেমনি শ্রমিকদের শ্রেণি সম্পর্কে সচেতন করতে পার্টির গোপন অবস্থায় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাই তিনি শুধুমাত্র টিইউ নেতা হিসেবে নয়, একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। শ্রমিকশ্রেণিকে নিছক ট্রেড ইউনিয়নের গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ না রেখে রাজনীতিকরণের কাজকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ফলে পার্টি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় শ্রমিকশ্রেণিকে পার্টি সংগঠনের সাথে সচেতনভাবে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। যেটা আজকের পরিস্থিতিতেও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের কাছে শিক্ষণীয়। পার্টি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার পলিসি নেওয়ার পর ছুটি নিয়ে নির্বাচনের কাজে শুধুমাত্র দায়িত্বশীল হিসেবে নিজের অংশগ্রহণ নয়, অন্য শ্রমিকদেরও অংশগ্রহণ করান। মূল বিষয় হল, শুধুমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন কাজে অংশগ্রহণ করানো নয়, সাথে সাথে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার কাজকে গুরুত্ব দিলেই পার্টি শক্তিশালী হবে মনে করতেন। কমরেড তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও সামিল করে ছিলেন। তাঁর স্ত্রী, ভাই-বোনরাও পার্টির প্রতি আন্তরিক ছিলেন। গোপন অবস্থায় বহু মিটিং হয়েছে তাঁর বাড়িতে। ২০০৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর হাওড়ায় পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। শেষ দিকে বয়স এবং শারীরিক কারণে সক্রিয় থাকতে পারেননি, কিন্তু পার্টির উপর, পার্টি লাইনের প্রতি গভীর আস্থা ছিল। এরকম একজন পার্টিজান কমরেড শ্রমিক শ্রেণিকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, সেই শিক্ষা অবশ্যই তাঁর উত্তরসূরীরা পালন করে যাবে। এটাই আজকের দিনে পার্টিকে শক্তিশালী করার একটা কর্তব্য। কমরেড প্রদীপদা (শৈলেন্দ্র মিত্র) অমর রহে।
কমরেড শৈলেন্দ্র নাথ মিত্র লাল সেলাম।
কমরেড গৌতম সেন, আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু, ২৫ মে যাদবপুরে কেপিসি হাসপাতালে সকাল ১১.২০ নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কমরেড সেন গত ৩ মে কোভিড পজিটিভ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসারত অবস্থায় ২৫ মে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান।
কমরেড গৌতম সেনের বাড়ি কলকাতায় কেয়াতলায়। স্ত্রী কমরেড কল্পনা সেন ও মেয়ে মিতালী সেন। পরিবারটি বিপ্লবী ও প্রগতিশীল কাজকর্মেই ব্যস্ত থাকেন। কমরেড গৌতম সেনের মৃত্যু আমাদের পার্টির কাছে বেদনাদায়ক। আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারালাম।
কমরেড সেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বর্ধমান জেলার দূর্গাপুরের রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। একই কলেজে পড়তেন কমরেড বিনোদ মিশ্র, ধূর্জটি বক্সী, গৌতম সেন এবং ব্রজবিহারী পান্ডে। কমরেড পান্ডে এখন পাটনায় আমাদের পার্টির হিন্দী পএিকা লোকযুদ্ধর সম্পাদনা করেন। এই কয়েকজনের মধ্যে গৌতম ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পূর্ণ করেন। তিনি কলেজের ছা্ত্রদের সমস্যা ও বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতেন। আন্দোলনের নেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে খুব পরিচিত ছিলেন। কলেজে গৌতম সেনের ্ররনাম হয়েছিল ‘ঝাম সেন’। মানে সব সময় ঝামেলার মধ্যে থাকতো বলে। খুবই ভালো ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন। জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। নকশালবাড়ির আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পরেন। কলেজে যখন গোপন সেল গঠন হয়, তার নেতা হন বিনোদ মিশ্র। কাশিপুরে শ্রমিকদের আন্দোলনের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর বিরুদ্ধে নিজেদের সমর্থন দিয়ে, তার পাশে ছাএদের সংগঠিত করার প্রশ্নে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তখনই কলেজ কতৃপক্ষ সবকিছু বুঝতে পারে। সিপিএমের সাথে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন প্রশ্নে বিরোধ হলে গৌতম এগিয়ে যেতেন। লড়াকু কমরেড ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে গৌতম অংশ নিতেন, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারদর্শী ছিলেন। গৌতম সেন প্রথম দিকে বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়াও দুর্গাপুর লোকাল কমিটির সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় সংগঠনের কাজ করেছেন। কয়েক বছর আগে অশক্ত শরীরেও কমরেড ধূর্জটি বক্সীর স্মরণসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন।
গৌতম সেন নিজে একটা সময় ‘মজদুর মুক্তি সংগঠন’ তৈরি করেন এবং সেই নামেই পএিকা প্রকাশ করতেন। ‘সার্চ প্রকাশনা’তে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতেন। আমাদের বিভিন্ন সেমিনার ও কনভেনশনে উপস্থিত হয়েছেন। গৌতম সেন ছিলেন সুবক্তা, সুলেখক। নিজের যুক্তি ও মতকে চমৎকারভাবে উপস্থাপণ করতে পারতেন। বিরোধী মতগুলি ধৈর্য ধরে শুনতেন, খোলামেলা বিতর্কে অংশ নিতেন।
কমরেড গৌতম সেন লাল সেলাম। কমরেড গৌতমের পরিবার, পরিজনদের শোকের সাথে আমরা সহমর্মি। কমরেড গৌতম সেন অমর রহে।
-- কার্তিক পাল
সিপিআই(এমএল)’র চিরকালীন শুভানুধ্যায়ী, অল ইন্ডিয়া পিপলস ফোরামের জাতীয় কাউন্সিল সদস্য অধ্যাপক সলিল বিশ্বাস প্রয়াত হয়েছেন গত ২১ মে গভীর রাতে। জন্ম ১৯৪৫ সালে, ফলে মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৬ বৎসর। মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে ইংরাজী সাম্মানিক নিয়ে স্নাতক হওয়ার পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। ষাটের দশকের শেষদিকে নকশালপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে যান তিনি। পরে অল্প কিছুদিন দার্জিলিং গভার্নমেন্ট কলেজে পড়ানোর পরে তিনি আমাদের কলেজে অর্থাৎ হেরম্বচন্দ্র কলেজে যোগদান করেন এবং সেখান থেকেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক (অধ্যক্ষ) হিসেবে অবসর নেন ২০০৭ সালে। সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিলেও নকশালপন্থী সংগঠনগুলি বিশেষত লিবারেশনের সঙ্গে তার যারপরনাই ঘনিষ্টতা ছিল। নাগরিক, গণতান্ত্রিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, কর্মসূচী, বিক্ষোভ এসবেই তাঁর উপস্থিতি ছিল ধারাবাহিক। প্রথাগত শিক্ষার বিপ্রতীপে বিকল্প শিক্ষার জন্য, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের শিক্ষার পিছনে তিনি শ্রমদান করেছেন বিপুল উৎসাহে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের ভাষায় তাদের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করে গেছেন। অসুস্থ শরীরে কোভিড-১৯ অতিমারীর মধ্যে পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে লিখেছেন ‘ফ্রেইরি চর্চা - পাঁচ কাহন’, গত জানুয়ারির গোড়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে। গত শতাব্দীর আটের দশকে সমমনস্ক শিক্ষকদের নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘ফোরাম ফর এডুকেশন’, যা একদিকে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মধ্যে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কলেজশিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেছে, অপরদিকে বিভিন্ন নিম্নবিত্ত বস্তির শিশুদের পড়াশোনা করিয়েছে। অবসরের পরে তিনি বেলুড়ে শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে পড়াতেন নিয়মিত, যতদিন পর্যন্ত সেই বিদ্যালয় চলেছে।
সলিলদার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৪ সালে, হেরম্বচন্দ্র কলেজে যখন আমি বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। নবাগত আমি চুপচাপ নজর করতাম সকলকে। ঋজু, সৌম দর্শন সলিলদা যেন একটু গম্ভীর প্রকৃতির কিন্তু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ছোঁওয়া। কিছুদিনের মধ্যেই আলাপচারিতার শুরু। জানিনা কী এক অমোঘ রসায়নে অচিরেই পাশের চেয়ারে আমার স্থান হয়ে গেল। শিক্ষকতা করতে এসে আমার শিক্ষার শুরু। একদিন একটা বই হাতে দিলেন, বললেন পড়ে দেখ; ‘আপনাকে বলছি স্যর’। বারবিয়ানা স্কুল থেকে, অনুবাদক সলিল বিশ্বাস। নিলাম, পড়লাম, বিস্মিত হলাম, ভাবতে শুরু করলাম। ক্রমে ক্রমে আবিষ্কার করতে লাগলাম ওঁর নানান ধরনের লেখা। তাঁর ডাইনোসরের দ্বীপ, ডলফিনের রাজ্যে, সাইল্যাস টিম্বারম্যান ইত্যাদি গ্রন্থ হাতে আসতে লাগল। কী অসাধারণ লেখার ভঙ্গি। অনুবাদ হলেও এক একটি স্বতন্ত্র সৃষ্টি। ইতিমধ্যে কাজ চলছে ইউটোপিয়ার। আমার সৌভাগ্য হল ওনার খসড়া পড়ার। লিখে বলতেন পড়ে দেখ পাঠক হিসেবে কোনো অসুবিধে লাগছে কিনা। টুকটাক মন্তব্য করতাম। উনি সেগুলি উপযুক্ত মনে হলে গ্রহণ করতেন।
সহজ মানুষ ছিলেন। তাঁর পান্ডিত্যের গভীরতা বোঝা কিন্তু সহজ ছিলনা। চমক লাগত এক একদিক যখন উন্মোচিত হত। কালো আমেরিকান কবিদের কবিতার অনুবাদ করলেন, ছায়া হারলেম, মিথেন ফোয়ারার প্রেম। এগুলি শুধু কবিতার অনুবাদ নয়, কবিদের পরিচিতি, রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটের ইতিহাস সব তথ্যই বিদ্যমান। সেই একই যত্নে পেলাম বোরহেসের ছোটোগল্পের দুটি সংকলন। কত অজানা তথ্য জলের মত সহজ করে হাতে তুলে দিতেন। দেশ বিদেশের কত ভান্ডারের আগল খুলে যেত তাঁর রচনার জাদুদন্ডে। বলে রাখি তাঁর প্রতিটি লেখায় ব্যক্ত হত সমাজ রাজনীতির কঠোর বাস্তব সত্য। মাটি থেকে পা কখনও ওঠেনি কিন্তু মস্তক ছিল উন্নত, দৃষ্টি ছিল সুদূর প্রসারী। প্রসঙ্গত একটা মজার কথা মনে পড়ছে, তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সমবয়সী সহকর্মী একবার প্রশ্ন করেছিলেন, তুই খালি অনুবাদই করবি, নিজে লিখবি না? তার, বেচারার জানার কথাও নয়, তিনি কী করে জানবেন কত স্বরচিত কবিতা, গল্পের মনি মুক্তা ছডিয়ে আছে বাংলার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। মননঋদ্ধ, যুক্তিবাদী প্রবন্ধের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাঁর আগ্রহ ছিল সমস্ত সমসাময়িক বিষয়ে। তাঁর শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ফ্রেইরি চর্চা - পাঁচ কাহন’। তার বছর দেড়েক আগে থেকে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত, তারও আগে স্ট্রোকের ধাক্কা সামলেছেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা কখনই তাঁর জ্ঞানপিপাসু মনকে ক্ষান্ত করতে পারেনি।
কম্প্যুটার তখন সবে নড়ে চড়ে বিশাল শরীরে নানা জটিল প্রক্রিয়া নিয়ে আবির্ভূত। সলিলদা শিখে ফেললেন। সেই মানুষটি আবার যখন নেট দুনিয়া এল সেখানেও উৎসুক হলেন। পড়ে নেড়ে শিখে ফেললেন। সেই সলিলদা এরপর লিখে ফেললেন ইন্টারনেট নামে একটি অসাধারণ গ্রন্থ, বাংলা ভাষায় সেই সময়ে এই বিষয়ে লেখা প্রথম গ্রন্থ। একাধিক সংস্করণও হয়েছিল সেই বইটির।
সলিলদা ছিলেন ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক। ছিলেন পরিশ্রমী ও ছাত্রদরদী শিক্ষক। পড়ানোর বিষয়ে কখনো কোনো ত্রুটি রাখতেন না। ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানগর্ভ প্রচুর প্রবন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন পত্রিকার পাতায়। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ‘পেগাস্যাস’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা। হেরম্বচন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের পত্রিকা হিসেবে তা আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপকদের থেকে লেখা সংগ্রহ করে তা নিখুঁত সম্পাদনায় প্রকাশ করতেন। সেই পেগাস্যাসকে কেন্দ্র করে একটি সোসাইটিও গড়ে ওঠে। ইংরেজি চর্চা করেন যাঁরা তাঁদের কাছে এই পেগাস্যাস এক অনন্য সম্পদ। এসবের সঙ্গে তাঁর আরও একটি শখ ছিল, ছবি তোলা। ফটোগ্রাফি তাঁর আদত নেশার জায়গা। ১৯৯৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ির ৪০ বছরে শহিদ মিনারে সিপিআই(এমএল)-এর যে সভা হয়েছিল সেখানে ছবি তুলতে হাজির ছিলেন তিনি।
২০০৭ সালে কলকাতা পার্টি কংগ্রসেও তিনি এসেছিলেন ওপেন কনভেনশনে, মেট্রো চ্যানেলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের বিভিন্ন সম্মেলনে, সৃজন উৎসবেও যোগ দিয়েছেন তিনি।
এই আপাদমস্তক প্রচার বিমুখ সমাজ সচেতন রাজনীতিমনস্ক পন্ডিত মানুষটি আমাদের খুব কাছাকাছি ছিলেন। ওঁর মতো দৃঢ়চেতা মানবদরদী, শিক্ষক, সংগঠক, বন্ধুবৎসল, মানুষের সংশ্রবে থাকতে পারাও এক অসীম পাওনা। কোনো বিশেষণটিই আলঙ্কারিক নয়, আক্ষরিক। একবিংশ শতাব্দীর একবিংশতম বর্ষের মে মাসের একবিংশতম দিনে তিনি একক গমনে অন্তর্হিত হলেন।
-- নবনীতা চক্রবর্তী
-- সমাপ্ত --