কোভিডের ১ম ঢেউ দেখেছিল আচমকা লকডাউনে অগণন পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষ যা আগে কখনো দেখেনি। শুধু ভারত নয়, কোভিড আক্রান্ত দুনিয়ার কোনো দেশেই ওই অমানবিক দৃশ্যপট ফুটে ওঠেনি।
কোভিডের ২য় ঢেউ দেখালো আরও একটি সংকট। যে সংকট গোটা ভারতে এতো নিদারুন নির্মমতায় আগে কখনও আছড়ে পড়েনি, আর তা হোলো অক্সিজেনের সংকট। অক্সিজেনের অভাবে একের পর এক নাগরিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো, ভারত এই মর্মান্তিক অধ্যায়ের সাক্ষী আগে কখনো হয়নি। সমস্ত নাগরিকদের জীবনের অধিকার সুরক্ষিত রাখার বহু ঢক্কানিনাদিত রাষ্ট্রীয় ঘোষণা যে কত বড় রসিকতা, এবারের কোভিড হানায় তা প্রকট ভাবে সামনে আছড়ে পড়ল। এমনকি মৃতের প্রতি শেষ সম্মানও দেখাতে পারলোনা আমাদের সরকার বাহাদুর। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, কুকুর টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে কোভিড আক্রান্ত মৃতদেহ, উত্তর প্রদেশের যমুনা নদীতে, বিহারেও ভাসতে দেখা গেছে সারি সারি শব, শ্মশানে স্থানাভাবে গাড়ির পার্কিং লট হয় উঠেছে শ্মশান ভূমি, মৃতের প্রতি বিন্দুমাত্র শেষ সম্মান না দেখিয়ে ডাই করে আবর্জনার মতো ফেলে রাখা হয়েছেশবের স্তুপ।
এই আমাদের ভারতবর্ষ। মোদী জমানার ভারতবর্ষ।
চরম অসংবেদনশীল, নির্লিপ্ত, অপরাধসম উদাসীনতা নিয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন আমাদের রাষ্ট্র নায়কেরা। আর অন্তহীন মৃতের এই হাহাকার ও কান্নার মাঝে রাজাধিরাজের ২০ হাজার কোটি টাকার সেন্ট্রাল ভিস্টার নির্মাণ কাজ চলছে উল্কার গতিতে। কুৎসিত বাহুল্য ও উৎকট প্রাচূর্যের গা ঘিন ঘিন করা এই প্রদর্শনী চলছে সর্বোচ্চ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে।
কোভিডের ২য় ঢেউ মোকাবিলা করার এক বিচিত্র পন্থা নিয়েছে মোদীরাজ। এবার কোভিড সামলানোর পুরো দায় চাপিয়ে দেওয়া হলো রাজ্যগুলোর উপরে। কেন্দ্রীয় স্তর থেকে লকডাউন ঘোষণা না হলেও বকলমে দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই লকডাউন, রাত্রিকালীন কার্ফু, ১৪৪ ধারা, লোকাল ট্রেন সহ গণপরিবহন বন্ধ। হাতে গোনা লোকজন নিয়ে চলছে অফিস আদালত, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। লকডাউন-১’র প্রকোপ কাটিয়ে ওঠার আগেই নেমে এলো লকডাউন-২, কোভিড ২য় ঢেউ’র হাত ধরে।
লকডাউন শ্রমজীবী মানুষের উপর যে মারাত্মক আঘাত নামিয়েছে, তার ভুরি ভুরি তথ্য সামনে এসেছে। কয়েকদিন আগে ‘সিএমআইই’ এক রিপোর্ট প্রকাশ করে জানালো, এই এপ্রিলে ৩৪ লক্ষ বেতনভুক কর্মী কর্মচ্যুত হয়েছেন। তাঁরা সকলেই যুক্ত ছিলেন ছোট ও মাঝারি শিল্পের সাথে। প্রথম লকডাউনেই তাদের নাভিশ্বাস ওঠে। আর, কোভিডের দ্বিতীয় সুনামিতে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এছাড়া, এই এপ্রিলেই ৭৩.৫ লক্ষ কাজ খোয়া গেছে, মার্চ মাসে বেকারত্বের যে হার ছিল ৬.৫ শতাংশ, তা এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়ালো ৭.৯৭ শতাংশ! লকডাউনের পাশাপাশি চলতে থাকা আর্থিক মন্থরতার জন্য গ্রামীণ ক্ষেত্রের ছোট শিল্প ছারখার হয়ে গেছে। কিন্তু মোট যে পরিমাণ কাজ লোপাট হয়েছে, তারমধ্যে বেতনভুক কর্মীদের কাজ হারানোর অংশটা খুবই উচ্চহারে, আর, জেএনইউ’র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সন্তোষ মেহরোত্রার মতে এটা গভীর এক সংকটকেই প্রতিফলিত করে।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া, ২০২১ রিপোর্ট’ জানিয়েছে যে গতবছর লকডাউনের জন্য ২৩ কোটি ভারতীয় নতুন করে যুক্ত হয়েছে দারিদ্র সীমার নীচে। গতবছর আচমকা লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর কর্মচ্যুত শ্রমিকরা এখন এমন সমস্ত কাজের সাথে যুক্ত হয়েছেন যেগুলো আগের কাজের তুলনায় অনেক বেশী ঝুঁকিপূর্ণ, অনেক বেশি ইনফর্মাল।
সিএমআইই’র সিইও মহেশ ভ্যাস বলেছেন, সবচেয়ে আগে সরকারকে স্বীকার করতে হবে যে বিপুল সংখ্যক কাজ লোপাট হয়েছে। আর তারজন্য সরকারকে বিপুল পরিমানে ঋণ নিয়ে পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে, তার মাধ্যমে সৃষ্টি করতে হবে নতুন কর্মসংস্থান, শহুরে কর্মসংস্থানের প্রকল্প তৈরি করতে হবে, আর বিপন্ন জনসাধারণের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠাতে হবে। ভারতের প্রায় সমকক্ষ ব্রাজিল কোভিড ত্রাণ খাতে ঢেলেছে তাদের জিডিপির ১২ শতাংশ, এদিকে ভারত বিনিয়োগ করেছে জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ। যে কোভিড অতিমারি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করার নির্মম শিক্ষা দিল অনেক প্রাণের বিনিময়ে, মোদী সেখান থেকেও কোন শিক্ষা নিতে প্রস্তুত নয়। ২০২১-২২’র স্বাস্থ্যখাতে এবারের বাজেট বরাদ্দ থেকে কোভিড ম্যানেজমেন্টের জন্য বরাদ্দ বাদ দিলে দেখা যাবে মোট বরাদ্দ গতবারের থেকেও কম!
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নির্দয় ও কঠোর লকডাউন হয়েছিল ভারতে। তখন সরকার যুক্তি দিয়েছিল যে জীবিকা রক্ষা করার চেয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচানোটাই ছিল সবচেয়ে বেশি জরুরী। কিন্তু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করলো, সরকারের এই সমস্ত কথাবার্তা নেহাতই অসার। ‘বিটেন অর ব্রকেন’ শিরোনামে বিশ্ব ব্যাঙ্ক এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের তুলনায় ভারত কোভিড মোকাবিলায় অনেক প্রশ্নে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। কঠোর লকডাউন সত্ত্বেও সেপ্টেম্বর শেষে রিপোর্ট বলছে, ভারতে কোভিড সংক্রমণের হার বাংলাদেশের তুলনায় ১৭ গুণ বেশি। দশ লক্ষ সংক্রমিতের মধ্যে ভারতের এই হার ছিল ৪,৫৭৪ – যা বাংলাদেশ ছিল ২,২০৭, নেপালে ২,৬৭০, আর পাকিস্থানে ১,৪১৬।
এবারের নতুন কোভিড ঢেউয়ে চাকুরিরত তরুণ কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু এই সম্ভাবনাময় তরুণ মানব সম্পদকে টিকার আওতায় এনে সুরক্ষিত রাখার অগ্রাধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। এরাজ্যে বা দেশের কোথাও শ্রমিকদের, তাদের পরিবারের সদস্যদের টিকাকরণের দায়িত্ব এখনও নেয়নি ইএসআই। হাতে গোনা মুষ্ঠিমেয় কিছু স্থায়ী চরিত্র সম্পন্ন কর্মীর চাকুরি ও বেতন প্রশ্নে নিরাপত্তা থাকলেও বিপুল সংখ্যক কর্মী স্বাস্থ্য ও আর্থিক ক্ষেত্রে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। না কেন্দ্র না কোন রাজ্য সরকার কাজ হারানো শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য বিন্দুমাত্র কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা, তাদের মজুরির নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত দিতে পারলো না। এদিকে, অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ জানিয়েছেন, জীবিকার গভীর সংকটের দিকে এগোচ্ছে ভারত। আর, শ্রমিক শ্রেণির কাছে এবারের সংকট হবে আরও মারাত্মক। সেই প্রথম লকডাউনের পর থেকেই দেশ বিদেশের প্রথিতযশা অর্থশাস্ত্রীরা অর্থনীতিকে অতিমারীর কবল থেকে বার করে আনতে সাধারণ মানুষের হাতে সরাসরি নগদ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও মোদী সরকার তার স্বভাবজাত ঔদ্ধত্যে সেই সমস্ত কিছু প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমাদের রাজ্যেও নতুন সরকার নির্বাচিত হওয়ার পরই কোভিড মোকাবিলায় একপ্রস্থ পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। লোকাল ট্রেন বন্ধ করার আশু প্রভাব পড়েছে অগনিত ইনফর্মাল শ্রমিকদের উপর। রাতারাতি কর্মহীন হয়ে পড়লেন লক্ষ লক্ষ পরিচারিকা, হকার, নির্মাণ থেকে শুরু করে সেই সমস্ত খেটে খাওয়া শ্রমজীবী জনতা যাদের উপার্জন স্থানিক নয়, রুটি রুজির জন্য বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়াতে হয়। ইতিমধ্যে, কাঁচা পাটের অভাবের কারণে রাজ্যে প্রায় ন’টা চটকল বন্ধ হয়ে গেল। কর্মহীন হলেন প্রায় চল্লিশ হাজার শ্রমিক। যেগুলো চালু রয়েছে, সেগুলো আবার চলছে মাত্র দুই শিফটে, কম শ্রমিক নিয়ে। এবার নতুন কোভিড বিধি অনুযায়ী, চা এবং চট, এই দু’টি শ্রম নিবিড় শিল্পে ৩০ শতাংশ কর্মী নিয়ে কাজ চালানোর নির্দেশ জারি হয়েছে, যা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। এই সমস্যা নিয়ে রাজ্যের ট্রেড ইউনিয়নগুলো মুখ্যমন্ত্রী সহ কেন্দ্রীয়স্তরে বস্ত্রমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় শ্রম কমিশনারের কাছে ডেপুটেশন দিলেও আজ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ কোনো পক্ষ থেকেই গ্রহণ করা হলো না।
ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনবলে কর্মীদের কর্মস্থলে ঢুকতে দেওয়া না হলে কেন তাঁদের কাজ যাবে? কেনই বা কেন্দ্র বা রাজ্য এই মর্মে তাঁদের কাজ ও মজুরি নিশ্চিত করবে না? শিল্পক্ষেত্রকে দু’হাত উপুড় করে হরেক ছাড় ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার সময় কেনই বা কর্মীদের চাকুরি ও মজুরি নিশ্চিত করানোর শর্ত থাকবে না? সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে না কেন শ্রমিকদের কাজ ও মজুরি নিশ্চয়তার পদক্ষেপটি?
গভীর সংকটের জালে আজ গোটা দেশের শ্রমজীবী, সম্পদ সৃষ্টিকারী জনতা। তাঁদের স্বাস্থ্য, মজুরি, কাজ বাঁচিয়ে রাখার দাবি আজ সর্বসাধারণের দাবি হয়ে উঠেছে। এই দাবিতেই আগামীতে সংগঠিত করতে হবে আন্দোলন।
- অতনু চক্রবর্তী