এক একটা সময় আসে যখন অন্ধকারের জলকল্লোল এক কুৎসিত আনন্দে মেতে ওঠে। সময় চমকিত হয়। বাতাস গতিহীন হয়। স্তব্ধবাক হয়ে পড়ে বিপন্ন বনস্থলী। এমনই এক একটা সময় আসে। যায়। আমরা দিশাহীন আর্তনাদে অন্ধকারে হাত-পা ছুঁড়ি আর এমন সব সাবেগ উচ্চারণ করতে থাকি যা অন্তঃসারশূন্য বাক্যপুঞ্জের মহাকাব্য হয়ে আমাদেরই একটা সময় ব্যঙ্গ করতে থাকে। আমরা বিস্মৃত হই কবি শঙ্খ ঘোষেরই সেই অবিস্মরণীয় পংক্তি : চুপ করো/শব্দহীন হও…’
একটা সময় আমাদের প্রতিবাদের শব্দ, উচ্চারণ যোগাতেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজে আন্দোলনের ডাক দিতেন, নিজে মিছিলে সামিল হতেন। তাঁকে ঘিরে থাকতো নকশালবাড়ির আলোকোদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণীরা। বিগত শতকের সত্তরের সেই কালবেলায় আমরা কবি বীরেন্দ্রকে পেয়েছিলাম। ১৯৮৫-তে তাঁর প্রয়াণোত্তরকালে আমরা পেয়েছিলাম কবি শঙ্খ ঘোষকে, ঠিক বীরেন্দ্রর মতো করে নয়, একটু অন্যভাবে, অন্য মাত্রাযুক্তভাবে, শব্দসচেতনতায় অথচ প্রতিবাদের নিবিড় উচ্চারণে। এক এক সময় তো তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে প্রতিবাদের সতপ্ত উচ্চারণ, পথে নামা, শাসকের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই। কবি কমলেশ সেন ছিলেন প্রতিবাদী মিছিলের সংগঠক। তাঁকেও ঘিরে থাকতো তরুণ এবং প্রবীণ বামপন্থী, নকশালপন্থী এবং অসংখ্য আনকোরা মুখ। প্রতিবাদের লিপিতে সই সংগ্রহ করতে তিনি নিজেই বেরিয়ে পড়তেন। কবি শঙ্খ ঘোষ এই কবিকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কবি কমলেশ যখন সল্টলেকের আনন্দলোক হাসপাতালে অপারেশনের জন্যে ভর্তি, সেসময় একদিন নিমাই ঘোষের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম কমলেশদাকে দেখতে। সেসময় শঙ্খবাবুও আসেন। আমি যখন কবিকে দেখতে যাচ্ছি তখনি তিনি আসেন। আমি নিজে না গিয়ে তাঁকেই যেতে বলি, একটু ইতস্তত করে তিনি গিয়েছিলেন কবি কমলেশ সেনকে দেখতে। কবির চিকিৎসার জন্যে শঙ্খবাবু কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি স্বশাসিত সংস্থার নিকট আর্থিক সাহায্যের আবেদন রেখেছিলেন। এই তথ্যই কবি শঙ্খের হৃদয়ের প্রসারতার প্রমাণ দেয়।
কবি বীরেন্দ্র প্রয়াত হওয়ার পর থেকে শঙ্খবাবুই কবি বীরেন্দ্রকে নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকেন তাঁর লেখাপত্রে, বক্তৃতায়। কবি বীরেন্দ্রর প্রতিবাদী কবিসত্তার প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। মনে হয় একারণেই বীরেন্দ্রর প্রয়াণের পর সেই দায়িত্ব তিনি নীরবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে প্রতিবাদপত্রের শব্দচয়নে তাঁর অতিসতর্কতা অনেকের কাছেই অনেকসময় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠতো। তিনি অবলীলায় প্রতিবাদপত্রের শব্দের পরিবর্তন করে দিতেন। সবাই অবশ্য তাঁর এই অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছিলেন। এমনও দেখেছি যথার্থ এবং সংগত কারণে অন্যের লেখা প্রতিবাদপত্রে তিনি সহমত পোষণ করেও স্বাক্ষর করতে রাজি হননি সেই শব্দচয়নের শুচিতা এবং বাহুল্য অবর্জনের কারণেই।
শঙ্খবাবু রাজনীতি সচেতন থেকেছেন তাঁর যৌবনের প্রত্যুষলগ্ন থেকেই। কিন্তু কোনোদিন কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি। একবার তাঁর বাড়িতে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম গত শতকের চল্লিশের দশকে আমাদের বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি-শিল্পীরা তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ কিম্বা ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘে নির্দ্বিধায় সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আবার এইসব সংগঠন থেকে উত্তরকালে বেরিয়ে গিয়েছিলেন — এর জন্যে এই লেখক-কবি-শিল্পীরাই দায়ী না পার্টি দায়ী? এপ্রশ্ন অনেককেই করে লিখতে বলেছি, কিন্তু কেউই রাজি হননি। ‘অনীক’-সম্পাদক দীপংকর চক্রবর্তী লিখতে রাজি হয়েও শেষপর্যন্ত আর লেখেননি। তিনি আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন পঞ্চাশের দশকে তখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূতের বেগার’ বইটি নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিমহলে খুবই সমালোচনা হচ্ছে, বইটি পার্টি থেকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নিবিষ্ট কর্মী সুভাষ এসময় এঘটনায় খুবই মানসিক আঘাত পান। এমনই সময় সাংস্কৃতিক কর্মিদের এক সভায় গিয়েছিলেন তিনি (শঙ্খ ঘোষ)। সেসময় কবি সুভাষ তাঁকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন : ‘শুনলাম তুমি নাকি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ নিচ্ছ?’ শঙ্খবাবু বলেছিলেন কবি সুভাষকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন কী হয়েছে? তখন উত্তেজিত সুভাষ বলেছিলেন তিনি তাঁর প্রশ্নের সরাসরি উত্তর চান। শঙ্খ ঘোষ তখন তাঁকে জানিয়েছিলেন : ‘না, তেমন কোনও ইচ্ছেই তাঁর নেই।’ সেইকথা শুনে সুভাষ তাঁকে বলেছিলাম : ‘নিশ্চিন্ত হলাম।’ — একথাগুলো বলার মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি আমার কথার জবাব দিয়েছিলেন।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তিনি ‘সুভাষদা’ বলেই সম্বোধন করতেন এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। সুভাষের আন্দোলন-সম্পৃক্ততা তাঁকে প্রাণিত করেছিল কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্সান্নিধ্যে আসতে উৎসাহী করেনি। চিরকালই তিনি ‘বাম’মনস্ক রাজনীতির সম্পৃক্ততায় থেকে উত্তাপ সংগ্রহ করেছেন এবং প্রতিবাদ্য বিষয়ে কখনও কবিতা লিখে কখনও সরাসরি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে কুচবিহারে ‘স্বাধীন’ ভারতের পুলিশের গুলিচালনায় খাদ্যের দাবিতে মিছিলে সামিল হওয়া এক কিশোরীর মৃত্যু তাঁকে উত্তেজিত করেছিল, আর এর প্রতিক্রিয়ায় আমরা পেয়েছিলাম তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘যমুনাবতী’। এই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন : ‘... যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে/ যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে ...।’ কবির এই প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া সাময়িক প্রক্ষোভের প্রকাশ ছিল না, আর তা ছিলনা বলেই উত্তরকালেও তিনি প্রতিবাদ্য ঘটনার প্রতিবাদে তাঁর প্রতিক্রিয়াকে কবিতার আয়ুধে সজ্জিত করেছিলেন। সত্তরের দশকে ইন্দিরা জমানায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বাবরের প্রার্থনা’। এই কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় তিনি লিখেছিলেন : ‘ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’ চুয়াত্তরে কলকাতার কার্জন পার্কে নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তের পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ তিনি করেছিলেন। প্রতিবাদ করেছিলেন নকশালপন্থী কবি তিমিরবরণ সিংহের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার মতো দানবীয় ঘটনারও। তিনি এইসময় তাঁর যন্ত্রণার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছিলেন : ‘শৃঙ্খলার অজুহাতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের নামে যখন একটা প্রজন্মকে বিকৃত বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয় পুলিশের অন্ধকার গুহায়, তখন তার বিরুদ্ধে যদি আমরা সরব হতে নাও পারি, তার সপক্ষে যেন আমরা কখনো না দাঁড়াই।’ এখানে তাঁর কিছুটা দ্বিধাচিত্ততা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেছেন এভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যদি ‘সরব’ না-তে পারি, তবু যেন এর পক্ষে অবস্থান না নেই! আসলে সেই সময় তাঁকে অন্য অনেকের মতো আক্রান্ত করেছিল, পীড়িত করেছিল, উচ্চারণকে অনুক্ত করার প্রয়াস অব্যাহত ছিল। তবু অন্ধকারে ফুলের প্রস্ফূটনের মতোই তাঁর প্রতিবাদের আকুতি কিন্তু অবদমিত থাকেনি। তিনি অন্ততপক্ষে খুনীকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ ছিলেন। বন্দিমুক্তি আন্দোলনে তিনি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করে তাঁর অবস্থানকে সুচিহ্নিত করেছিলেন।
সাতাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় বামফ্রন্ট আসীন হওয়ার পর শঙ্খবাবু আপ্লুতচিত্তে তাঁর প্রতিবাদীসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে বসেননি। এই বামজমানার শেষপর্যায়ে এই সরকারের তীব্র জনবিরোধী ভূমিকায় তিনি বিচলিত হন। তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাইয়ে বাম সরকারের নিন্দনীয় ভূমিকার প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করেননি। এসময় পরিবর্তনের ডাক দিয়ে যে জনকল্লোল নিনাদিত হয়েছিল, তিনি সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। সেইসময় ‘বাম’ সরকারের দম্ভোক্তি, ক্ষমতার আস্ফালন তাঁকে ক্রমশই প্রতিবাদমুখর হতে উৎসাহী করেছিল। তিনি এসময় তাঁর সক্রোধ মননের প্রকাশ ঘটাতে লেখেন : পুলিশ কখনো অন্যায় করেনা যতক্ষণ তারা আমার পুলিশ — শাসকশ্রেণীর এই পুলিশনির্ভরতা এবং পুলিশের অত্যাচারের সাফাই গাওয়া তাঁর কাছে অসহ্য বিবেচিত হয়েছিল। এক সিপিএম নেতার উদ্ধত কথাবার্তার প্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন : ‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি/অক্ষরে অক্ষরে/যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/ দিয়েছি নরক করে!’
২০১১ খ্রিস্টাব্দে বামফ্রন্টের দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের শাসনক্ষমতার অবসানের পরে ক্ষমতাসীন নতুন সরকারের প্রতিও তিনি এতটুকু মোহযুক্ত হননি। আর একারণেই এই তৃণমূল জমানায় কামদুনি-ঘটনার প্রতিবাদে স্বয়ং প্রতিবাদী মিছিলে সামিল হতে দ্বিধান্বিত হননি। এছাড়া কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশদের হত্যার প্রতিবাদেও তিনি সরব হয়েছিলেন। এনআরসি-সিএএর নামে বিজেপির ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তিনি নীরব থাকেননি। একদিকে তিনি যেমন মাওবাদী-আখ্যায়িত কারাবন্দি কবি ভারভারা রাওয়ের মুক্তির দাবিতে সহমত পোষণ করেছেন, তেমনই তিনি চেরাবান্ডা রাজু এবং ভারভারা রাওয়ের অনেক কবিতার বাংলা অনুবাদ করে বাংলার পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। এসব কারণে তিনি সবসময় শাসকশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিদের কাছে সমালোচনার পাত্র হয়েছেন, তবু তিনি কখনও তাঁর প্রতিবাদীসত্তার সঙ্গে আপস করেননি।
আজ আমাদের সামনে বিজেপির ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন মূর্তিমান দানবের মতো এসে হাজির হয়েছে। মিথ্যে, গুজব, সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং বিভেদের অপরাজনীতির সংমিশ্রণে এই ফ্যাসিস্ত শক্তি তার ভয়ংকর রূপটিকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছে। সর্বাত্মক আক্রমণের লক্ষ্যে তারা ক্রমশ আমাদের জাতীয় জীবনে বিপর্যয় সূচিত করে চলেছে। এমত অশুভ সময়ে আমরা হারালাম কবি শঙ্খ ঘোষের মতো কবিকে যিনি অনেকের কাছেই আশ্চর্য নির্ভরতার নিশ্চিত আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর এই প্রয়াণ এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে আমাদের আক্ষেপে রোরুদ্যমান না করে প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হতে উদ্বুদ্ধ করুক। কে আর মিছিল ডাকবে, আমরা নিরাশ্রয় হলাম জাতীয় হা-হুতাশ করার সময় এখন নয়। এখন সময় আরও বেশি ঘনবদ্ধ হওয়া, বেঁধে বেঁধে থাকা আর আগ্রাসী ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধে সাহসে বুক বেঁধে পথে নামার। মনে রাখতে হবে কবি শঙ্খ ঘোষেরই সেই অমোঘ পংক্তি :
পুব থেকে পশ্চিমের থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে কে
অক্ষৌহিনী ঘিরবে বলে ফন্দি করে আসছে ঝেঁপে ?
--অশোক চট্টোপাধ্যায়