ক্ষমতার বৃত্তে নারী কোথায়?
women in the circle of power

একুশে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন লিঙ্গবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এক নজিরবিহীন নজির হয়ে রইলো। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে রইলো এই বিদ্বেষ। সৌজন্যে, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল — বিজেপি। করোনার এই সুনামি-ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে প্রায় করোনামুক্ত এই রাজ্যে আট দফায় নির্বাচনের পিছনে এক গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। এবং সেখান থেকেই দলটির মানববিদ্বেষী ক্রূর চেহারাটা আরেকবার স্পষ্ট হয়ে গেল।

প্রচারপর্বে রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর মোকাবিলায় বিজেপি’র এক ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সর্বভারতীয় নেতা, ভিন রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করলেন, নারী বিদ্বেষের গরল ছড়ালেন ভাষায়, শরীরী ভঙ্গিমায়। রাজ্যনেতারা তাতে যোগ্যতর সঙ্গত করলেন, বলাই বাহুল্য!

তৃতীয় এবং বিশেষ করে চতুর্থ দফার নির্বাচন গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকলো। সেই কলঙ্ক সামনের দফাগুলোকে গ্রাস করবে কিনা সেই আশঙ্কা সবার মনেই।

কিন্তু এইরকম একটি আবহে নির্বাচনে ‘নারী’ একটি বিশেষ প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে উঠল কেন? পাঁচটি রাজ্যের প্রায় সব দলের কাছে? সেটা কি এই জন্যে যে, রাজ্যগুলিতে মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি, এমনকি চারটিতে পুরুষের সমান বা তার চেয়েও বেশি? কেরালা, তামিলনাড়ু, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে মহিলা ভোটারের অনুপাত যথাক্রমে ৫১.৪%, ৫০.৫%, ৪৯.৩৫% এবং ৪৯.০১%। না কি, মহিলারা না এগোলে সমাজ এক পা-ও এগোবে না — এই চূড়ান্ত সত্যটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে রাজনৈতিক দলগুলো?

কিন্তু এখানে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। সাধারণভাবে বলা যায় মহিলাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি সবার ঝুলিতেই। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি একধাপ এগিয়ে কর্মসংস্থানে ৩৩% সংরক্ষণের কথাও বলেছে। নিখরচায় যাতায়াতের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।

তামিলনাড়ুতেও উপহারের ছড়াছড়ি। বিনামূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার, ওয়াশিং মেশিন পর্যন্ত আছে! এটা অবশ্য ওখানে নতুন কিছু নয়। নতুন যেটা সেটা হল মেয়েদের গার্হস্থ্য শ্রমের মজুরির কথা বলেছে কামাল হাসানের পার্টি। আর বিভিন্ন দল, কেউ মাসে ১৫০০, কেউ ১০০০ টাকা করে মেয়েদের হাতে দেওয়ার কথা বলেছে। আমাদের পশ্চিমবাংলার শাসক দলও কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, রূপশ্রী এই সব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সাথে মহিলাদের হাতখরচ বাবদ মাসে ৫০০ টাকা (এসসি, এসটি-দের জন্য ১০০০ টাকা) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মোদ্দা কথা, যে গার্হস্থ্য শ্রমের স্বীকৃতি ও মর্যাদার জন্য মহিলা সংগঠনগুলো লড়াই করছে-সেটা অন্তত নৈতিকভাবে রাজনৈতিক বৃত্তে উঠে এল। শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রমজীবী মহিলা থেকে গ্রামের চাষি, কুমোর, তাঁতী, জেলে, বিড়ি শ্রমিক পরিবারের মহিলাদের অনেকটা সময় ঘর গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসা বা পেশাতেও শ্রম দিতে হয় যা পুরুষশাসিত সমাজের চোখের আড়ালে থেকে যায়।

বিজেপি’র ইস্তাহারের সঙ্গে নেতাদের ভাষণের কোনো সাযুজ্য নেই। তারা তথাকথিত নারীসুরক্ষার নামে যেসব আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে নারীর স্বাধীনতা, সায়ত্ততা, স্বাধিকার প্রবলভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং পরোক্ষ ভাবে তাদের ঘরবন্দি করারই চক্রান্ত এটা। বাংলার শিক্ষিত উদার পরিমণ্ডলের (বামপন্থীদের ভূমিকাও যেখানে অগ্রগণ্য) পরিচর্যায় সমাজে মেয়েরা অনেক খোলামেলা পরিসরে বেড়ে উঠতে পেরেছে, আর্থিক অবস্থা যা-ই হোক। কিন্তু বিজেপি নেতাদের অভয়বাণীতে সেই পরিসর কেড়ে নেওয়ার অশনি সংকেত!

বিজ্ঞাপনেও বিজেপি’র মহিলা — কেন্দ্রিকতা লক্ষণীয়। মেয়েদের বাসস্থান, জ্বালানি, গ্রামীণ কর্মসংস্থান স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদিতে বিজেপি কত অবদান রেখেছে -- তারই পাতাজোড়া বাহারি বিজ্ঞাপন। কিন্তু হায়! সেখানেও নির্লজ্জ শুধু নয়, নির্মম প্রতারণা! গ্যাস সিলিন্ডার ৮৫০ টাকা, তাই সেই ‘চোখ-জ্বালা করা’ ঘুঁটে কয়লা কাঠই আবার লক্ষ লক্ষ মা-বোনেদের ভরসা। গ্রামীণ কর্মসংস্থান তথা প্রকল্পে এবারের বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরপিএম আবাস যোজনায় প্রধানমন্ত্রীর সহাস্য উপস্থিতির সঙ্গে ঘর-পাওয়া যে মহিলার ছবি ছাপা হয়েছে, বউবাজারের সেই লক্ষ্মীদেবী থাকেন ঘুপচি এক ভাড়া করা ঘরে। কস্মিনকালেও তিনি যোজনার ঘর পাননি! গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে বাবু ঘাটে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তখন তার ছবি তুলে তার অজান্তে দিব্যি তা বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে! এ ঘটনায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত।

আরেকটি লজ্জাজনক ঘটনা বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারগীতি ঘিরে। সেখানে বাংলাদেশে ২০০১ সালে ধর্ষিতা এক হিন্দু বালিকার (এখন যিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ড্যাফোডিল বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি পাওয়া ৩২ বছরের তরুণী এবং দায়িত্বশীল পদে কর্মরত) নাম ও ছবি তার অনুমতি না নিয়েই ব্যবহার করা হয়েছে। স্বভাবতই তরুণী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, “বাস্তবে একবার ধর্ষিতা হয়েছিলাম। এখন রাজনীতির স্বার্থে বার বার ধর্ষিতা হতে হচ্ছে।” বিজেপি মহিলাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকারকে কানাকড়িও দাম দেয় না -- বিদেশি তরুণীর এই ক্ষোভই তা আবার প্রমাণ করল! এই গানে ইসলাম বিদ্বেষকে উস্কানোই মূল উদ্দেশ্য আর সেটা এমন জঘন্য ও নির্লজ্জ ভাবে করা হল! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঐ তরুণীর পাশে বাংলাদেশ সরকার সর্বতোভাবে থেকে তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে, অপরাধীদের কঠোর সাজা দিয়েছে (সূত্র: আনন্দবাজার)। আর এখানে প্রত্যেকদিন কাঠুয়া, উন্নাও, হাথরাস ঘটছে এবং তারপর কী ঘটছে, সবাই জানেন।

এবার আসি সামাজিক মাধ্যমে মহিলা প্রার্থীদের নিয়ে ‘মিম’-এর প্রসঙ্গে। সেখানে অভিনেত্রীদের যেমন ‘সেক্সি’ ‘স্টাইলিশ’ অভিধায় তাদের পরশ্রমজীবী অকর্মণ্য বলে পেশাগত দক্ষতাকে নস্যাৎ করা হয়েছে, অন্যদিকে আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী দীপ্সিতার তথাকথিত জৌলুষহীন চেহারাকে কটাক্ষ করে ‘কাজের মাসি’ বলে, সমাজের মেহনতি মহিলা, পরিচারিকা সমাজকে অপমান করা হয়েছে। পরিচারিকা সমিতির নেত্রী সক্ষোভে জানিয়েছেন, দলীয় ইশতেহারে যেমন তাদের ব্যাপারে নীরব দলগুলি, তেমনই মধ্যবিত্ত সমাজের খুব ছোট একটা অংশই লকডাউনে তাদের পাশে থেকেছে। নেটিজেনদের মহিলা প্রশ্নে এই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার কুৎসিত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আমোদ বন্ধ হোক!

এবার চলে আসব শেষ প্রশ্নে। নারী ভোটার প্রধান রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক দলগুলো নারীর ক্ষমতায়নে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে? প্রার্থী নির্বাচনে কতটা গুরুত্ব পেয়েছেন মহিলারা?

আসামে ১২৬ আসনে তিন দফা নির্বাচনে মহিলা প্রার্থীর অনুপাত মাত্র ৭.৮২%, কেরালা, যেখানে মহিলা ভোটারের সংখ্যা পুরুষ ভোটার থেকে ৮.২৭ লক্ষ বেশি সেখানে ১৪০ আসনের জন্য মহিলা প্রার্থীর অনুপাত মাত্র ৯%!

তামিলনাড়ুতে মহিলা প্রার্থীর অনুপাত: এআইএডিএমকে-৮%, ডিএমকে-৬%, একমাত্র নাম তামিলার কাচি-৫০%;

পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের মহিলা প্রার্থী সংখ্যার অনুপাত: ১৭%;
(লিঙ্গ অনুপাত ২০২০-তে ছিল — ৯৫৬/১০০০, ২০২১-তে ৯৬১/১০০০)

সুতরাং ইস্তেহারে বিজ্ঞাপনে অনেক গালভরা আশ্বাস থাকলেও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও চিত্রটি বড়ই করুণ! সেটা যতদিন উজ্জ্বল না হচ্ছে, নারীর নির্ভয় স্বাধীনতা কি সম্ভব!

খণ্ড-28
সংখ্যা-14