উত্তরপ্রদেশে এখন জোর কদমে চলছে যোগী সরকারের চার বছর পূর্তির সাফল্যের প্রচার। বলা হচ্ছে, সরকার দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে যে তারা সব প্রাণভয়ে পালিয়েছে। কিন্তু প্রচার ও বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বাস্তবের যে কোনো মিলই নেই, রাজ্যের প্রতিদিনের ঘটনা সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করছে। আইন-শৃঙ্খলার জঘন্য পরিস্থিতিতে দুর্বৃত্তরা উৎসাহিত হচ্ছে এবং এমনকি শুনানি চলার সময় আদালত কক্ষের ভেতরে সাক্ষীকে হুমকি দিতেও আইনজীবী নামধারী দুষ্কৃতির কোনো কুণ্ঠা হচ্ছে না।
গত ৫ মার্চ হাথরসের বিশেষ আদালতে গণধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়া হাথরসের দলিত কন্যার ন্যায়বিচারের শুনানি যখন চলছিল, সেই সময় অভিযুক্তদের আইনজীবী তরুণ হরি শর্মা আদালত কক্ষে ঢুকে (অভিযোগ, মদ্যপ অবস্থায়) দলিত কন্যার দাদা ও তাদের কৌঁসুলি সীমা কুশাহাওয়াকে হুমকি দেন। শুনানি বানচাল করা ও বাদী পক্ষকে ভয় দেখানোর জন্য ওরা লোকজন জড়ো করেছিল বলেও জানা গেছে। কিছুক্ষণ বন্ধ থাকার পর শুনানি আবার শুরু হলে এবার আদালত কক্ষে ঢুকে হুমকি দেন প্রথমে যিনি হুমকি দিয়েছিলেন সেই আইনজীবী হরি শর্মার বাবা। এরপর বিচারপতি শুনানি বন্ধ করে দিয়ে আদালতে উপস্থিত পুলিশ কর্মীদের নির্দেশ দেন, তারা যেন আদালতের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করে এবং দলিত কন্যার দাদা ও তাদের কৌঁসুলি সীমা কুশাহাওয়াকে সুরক্ষা দিয়ে নিরাপদে আদালত থেকে বার করে নিয়ে যায়। এই ঘটনার পর মামলার শুনানি উত্তরপ্রদেশের বাইরে বা দিল্লীতে গ্ৰহণ করার দাবি জোরালো হয়।
হাথরসের দলিত যুবতীর মর্মান্তিক পরিণতিতে সমালোচনার ঝড় উঠলে সরকার ঘটনার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। সিবিআই ২০২০’র ১৯ ডিসেম্বর বিশেষ আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। সিবিআই তাদের চার্জশিটে চার অভিযুক্তর বিরুদ্ধে গণধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ এবং তফশিলি জাতি/উপজাতি নিপীড়ন নিরোধক আইনেও অভিযোগ এনেছে বলে সংবাদ বেরিয়েছে। সিবিআই-এর কৌঁসুলিও জানিয়েছেন, মামলাটি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আবেদন তাঁরাও জানাবেন।
হাথরসের দলিত কন্যার ওপর চালানো পৈশাচিক বর্বরতা ও তার হৃদয়বিদারক পরিণতির কথা সংক্ষেপে স্মরণ করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মাঠে কাজ করছিলেন ১৯ বছরের দলিত যুবতী ও তাঁর মা। মেয়ের থেকে মা একটু দূরে ছিলেন। একটু পরে মেয়ের চিৎকারে ছুটে গিয়ে মা দেখেন মেয়ের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, জিব কাটা। পরে পুলিশ মেয়েটিকে আলিগড়ের হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে দিল্লীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে ৩০ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে দলিত যুবতী সন্দীপ, লবকুশ, রবি ও রামু নামে চারজনকে তার ওপর গণধর্ষণ চালানোয় অভিযুক্ত করে। এরা সবাই ঠাকুর জাতের, যে জাতেরই অন্তর্ভুক্ত হলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। পুলিশ পরিবারের সদস্যদের অমতে দলিত যুবতীর দেহ পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়। মেয়েটির ওপর গণধর্ষণ, তার মৃত্যু এবং পুলিশের ভূমিকা সারা দেশকে আলোড়িত করে।
এখানে এই প্রসঙ্গের অবতারণাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, বিজেপি বিধায়ক রাজিব সিং পাহেলওয়ান গত বছরের ৪ অক্টোবর অভিযুক্তদের সমর্থনে একটি জমায়েত করেন। ‘রাষ্ট্রীয় সাবর্ণ পরিষদ’ নামক সংগঠন অভিযুক্তদের পক্ষে সমর্থন জানায়। আরএসএস সহ বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী সংগঠনও অভিযুক্তদের সমর্থনে নামে। এখানে এই বিষয়টিও উল্লেখের দাবি রাখে যে, ধর্ষণ কাণ্ডের ১১ দিন পর মেয়েটির যৌনাঙ্গ থেকে পদার্থ সংগ্ৰহ করার পর তার থেকে পাওয়া রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে জনৈক পুলিশ অফিসার ঘোষণা করেন যে, মেয়েটি গণধর্ষণের শিকার হয়নি এবং এইভাবে প্রশাসন ও অভিযুক্তদের রক্ষার চেষ্টা চালান। সেই অফিসারই আবার ‘অনবদ্য কাজ’এর জন্য রাষ্ট্রপতির পদকে ভূষিত হন।
ভয় পাওয়ার চেয়ে যোগী জমানায় দুর্বৃত্তরা যে আরো স্পর্ধিত হয়ে উঠেছে তা উপরের আখ্যান থেকে স্পষ্ট। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে ধিক্কার-প্রতিবাদ-সমালোচনা কিন্তু নারী বিরোধী হিংসায় কোনো লাগাম পরাতে পারছে না। নারী বিদ্বেষের প্রাবল্য ও পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যের পরিমণ্ডলে নারীকে অধিকার বর্জিত ভোগ্যবস্তু রূপে জ্ঞান করার মানসিকতা জাঁকিয়ে বসেছে। যেন এই অভিমতকেই প্রমাণ করতে সোমবার অর্থাৎ ২২ মার্চ রাত থেকে ২৩ মার্চ রাতের মধ্যে ঘটল অন্তত তিনটে নারী-বিরোধী হিংসার ঘৃণ্য ঘটনা।
প্রথম ঘটনাটি গোণ্ডা জেলার বেলসারের। ৪০ বছরের দলিত মা ও তার ১৭ বছরের মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে গাছ থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। কিশোরীর কাকা জানিয়েছেন, জনৈক সত্যম সিং লুকিয়ে কিশোরীর একটা ‘আপত্তিকর ভিডিও’ তোলে। সেই ভিডিওটা দিয়েও ওদের ব্ল্যাকমেইল করে “যৌন শোষণ করতে চেয়েছিল আর সেই কারণেই ওরা ওদের জীবন শেষ করে দেয়”। তিনি আরো জানান, “এর আগে আমরা বিষয়টা নিয়ে পুলিশকে তিনবার জানালেও প্রত্যেকবারই তারা পঞ্চায়েতে ব্যাপারটা মেটাতে বলে”। দ্বিতীয় ঘটনাটা সন্ত কবির নগর জেলার সিংহা গ্ৰামের। ৪২ বছরের শান্তি দেবীর মাথা গুঁড়িয়ে হত্যা করা হয় এবং তাঁর ১৭ বছরের মেয়েকে গুরুতররূপে জখম করা হয়। মেয়েটিকে গোরখপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। তৃতীয় ঘটনাটা পিলভিটের এবং সেখানে ১৯ ও ১৬ বছরের দু’টি মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। হত্যার পর একটি মেয়েকে গাছ থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় আর অন্য মেয়েটি মাটিতে পড়ে থাকে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে গলা টিপে হত্যার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। দু’টি মেয়েই ইটভাঁটায় কাজ করত। মেয়েদুটির মা জানিয়েছেন, ইটভাঁটার মালিক ও তার অ্যাকাউন্টেন্ট মেয়ে দুটিকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছে। মায়ের আরো অভিযোগ “ইটভাঁটার মালিকের দেওয়া একটা কুঁড়ে ঘরে আমরা থাকতাম। মালিক মঙ্গলবার আমাকে হুমকি দিয়ে বলে যে, আমি পুলিশের কাছে যেন না যাই।” পিলভিটের এসপি বলেছেন, “নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা সন্দেহজনক। …”
উত্তরপ্রদেশ হিন্দুত্বর এক বড় পরীক্ষাগার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হিন্দুত্বর এক প্রভাবশালী নেতা। আরএসএস-এর আরাধ্য মনুস্মৃতিতে যে দৃষ্টিতে নারীকে দেখা হয়েছে, হিন্দুত্ববাদী নেতারা (যার মধ্যে যোগী আদিত্যনাথও রয়েছেন) নারীর জন্য যে ভূমিকা নির্দিষ্ট করেছেন, উত্তরপ্রদেশে নারী নিগ্ৰহের নিরবচ্ছিন্ন ধারা তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে হয়। উত্তরপ্রদেশে তাই আইনজীবী নামধারী দুষ্কৃতী আদালত কক্ষে ঢুকে বিচারপতিদের কোনো তোয়াক্কা না করে সাক্ষী ও বাদী পক্ষের কৌঁসুলিকে অবাধে হুমকি দেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারে, ধর্ষণ লম্পটদের কাছে অনায়াস সাধন হয়ে ওঠে, ধর্ষণের পর নারী হত্যাও অবলীলায় সংঘটিত হতে থাকে, বিজেপি ধর্ষকদের সমর্থনে রাস্তায় নামতে কুন্ঠিত হয় না, নারী নিগ্ৰহের বিরামহীন ধারা মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসনের প্রশান্তিতে একটুও নাড়া দিতে পারে না!