ক্রন্দনরত এক ষোড়শীকে কোমরে দড়ি বেঁধে হাঁটানো হচ্ছে। উন্মত্ত জনতা ‘ভারত মাতা কী জয়’ ধ্বনি দিতে দিতে চলেছে। কিশোরীর অপরাধ – সে ধর্ষিতা হয়েছে এবং পরিবারকে সেটা জানিয়েছে! অর্থাৎ সে কেন ধর্ষকের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলনা, আর কেনই বা সেই ‘ভীষণ কলঙ্কের’ কথা প্রকাশ করে ফেলল! কেন সে ‘পরিবারের অসম্মানের’ কথা ভাবলো না! এত বড় অন্যায়! হাঁটানোর আগে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল। তারসঙ্গে অবশ্য ধর্ষককেও মারধর করার পর একই ভাবে গ্রামে ঘোরানো হয়। নাবালিকার এই নিগ্রহে গ্রামবাসীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল তার পরিবারের লোকজনও। ‘ভারত মাতা’র অন্তরাত্মা ‘পৌরুষদৃপ্ত সন্তানদের’ জয়ধ্বনি শুনে পুলকিত হয়েছিল, না গোপনে চোখের জল ফেলেছিল তা জানার উপায় নেই। কিন্তু বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের আলিরাজপুরের এই ঘটনা নারী নির্যাতনে (নাবালিকা নির্যাতনে) এক নতুন মাত্রা যোগ করল। বিজেপি শাসনে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের হাতে আরও কতভাবে নারী নিগৃহীত, অপমানিত হতে পারে তার সম্ভাব্য নিদর্শনের কথা ভেবে নাগরিক সমাজ নিশ্চয়ই শিউরে উঠবে!
গত সোমবার যোগীরাজ্য উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় বাইক আরোহী এক তরুণ দম্পতিকে তিন দুষ্কৃতী মারধর করে দশ হাজার টাকা লুঠ করে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে তার ভিডিও-ও করেছে।
বিজেপি শাসিত কর্ণাটকের প্রাক্তন জলসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গতকাল এক মহিলা আদালতে চাকরি দেওয়ার নাম করে তাঁকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেন।
গত রবিবারের আরেকটি ঘটনা। বছর চোদ্দ-পনেরোর দুই আদিবাসী কিশোরী বিকেলে রোজকার মতো গ্রামের প্রান্তে ইউক্যালিপ্টাস-এর জঙ্গলে শুকনো গাছের ডালে দোল খেতে খেতে গল্প করছিল। এমন সময়ে গ্রামেরই পাঁচ যুবক, যাদের ওরা ‘দাদা’ ‘কাকা’ বলে ডাকে, ওদের বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে সাইকেলে তুলে নেয় এবং নির্জন পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে। ধর্ষকরা শিক্ষিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়েরই। এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার শুখাডাঙ্গা গ্রামের। আদিবাসী কন্যা গণধর্ষণের এবং অপমানে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হওয়ার আরও ঘটনা কয়েক মাস আগে এই রাজ্যে ঘটেছে।
এ রাজ্যে ক্ষমতায় না থাকলেও বিজেপি এমন একটা সামাজিক আবহ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে -- যেখানে জাতি, ধর্ম বর্ণ এবং লিঙ্গভেদের বিষবাষ্প বায়ুকণায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের নির্বাচনী প্রচারে সেটা উৎকটভাবে প্রকট হয়ে উঠছে।
আলিরাজপুরের ঘটনায় ধর্ষিতা কিশোরীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়, এর আগেও আরএসএস-বিজেপি’র নেতা নেত্রীরা ধর্ষিতা, তার বাবা মা, তার পারিবারিক সংস্কারকেই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন এবং ধর্ষককে আড়াল করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু কেন? কেন নারীর প্রতি আরএসএস-বিজেপি’র এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ?
হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেপি সনাতন হিন্দুধর্মে নয়, মনুবাদে বিশ্বাসী যে মনুবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদের সমার্থক এবং পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। মনুসংহিতা অনুসারে শূদ্র ও নারী অপূর্ণ মানব। নারীর কোনো শিক্ষার ও স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার নেই। নারী হীনজন্মা। শাস্ত্রমতে স্ত্রীজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ। স্বামীসেবা, গৃহকর্ম ও সন্তানের জন্ম দেওয়াই তার একমাত্র কাজ। ব্রাহ্মণ ও পতিসেবায় ত্রুটি ঘটলে তাকে পরজন্মে আরও হীন পশুযোনিতে জন্ম নিতে হবে।
“ইহলোকে পুরুষদের দূষিত করাই নারীর স্বভাব। তাই পণ্ডিতগণ স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে অসাবধান হন না।”
“স্ত্রীগণ সৌন্দর্য বা বয়স বিচার করে না। যুবা বা বৃদ্ধ, সুরূপ বা কুরূপ, যাই হোক না কেন, পুরুষ পেলেই তারা সম্ভোগে লিপ্ত হয়।”
“শয়ন, আসন, ভূষণ, কাম, ক্রোধ, পুরহিংসা, কুটিলতা ও কুৎসিত ব্যবহার – এই সকল প্রবৃত্তি স্ত্রীলোকের জন্যই মনু সৃষ্টির সময় কল্পনা করেছেন। অর্থাৎ এই সকল প্রবৃত্তি নারীদের স্বভাবগত ব্যাপার।”
“ইহ সংসারে দেহধর্মবশত সব মানুষই কাম ক্রোধে বশীভূত। তাই মূর্খই হোক, আর বিদ্বানই হোক, কাম ক্রোধে বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থন হয়।”
“স্ত্রীলোকের এই স্বভাবের জন্যই সব সময় তাদের বশে রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই তারা স্বাধীন থাকতে পারবে না।”
“সর্বদাই গৃহকর্মে, পতি ও পরিজনের সেবায়, গৃহ দ্রব্যাদি পর্যবক্ষেণে তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে।”
এইসব হচ্ছে মনুর নির্দেশ ও বিধান। আর আরএসএস নেতারা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এই ফরমান আজকের ভারতীয় নারীদের জন্য চালু করতে চাইছেন। তাই তারা শুধু যে নিজেরা ধর্ষিতা নারীকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করছেন, তাই-ই নয়, আদালতকেও প্রভাবিত করছেন। নারীকে ঘৃণা, বিদ্বেষ, তাচ্ছিল্যের চোখে দেখার এই বিষাক্ত মনোভাব যেটা যুগপরম্পরায় খানিকটা প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও, আধুনিক শিক্ষা ও বিজ্ঞান মনস্কতায়, নারী আন্দোলনের ঢেউয়ে ক্রমশ ক্ষীয়মান হয়ে আসছিল, তাকেই চাঙ্গা করে তুলছে ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদীরা। তাই কেবল কঠোর থেকে কঠোরতম সাজা ঘোষণা করে ধর্ষণ রোখা যায়নি, যাবে না। দলিত নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী বিদ্বেষকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণা ও বিদ্বেষের মতাদর্শকে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের নারীরা, ছাত্রীরা চান নির্ভয় স্বাধীনতা।