এ কোন বাংলা!
This is no Bengal

বাংলায় তৃতীয় দফার ভোটে কী হয়েছে সবাই জানেন। ‘না দেখলে পিছিয়ে পড়তে হয়’ চ্যানেলের সান্ধ্য চণ্ডীমণ্ডপে সঞ্চালক দুই মহিলা প্রার্থীকেই (সুজাতা মণ্ডল ও পাপিয়া অধিকারী) ডেকেছিলেন, দর্শক শ্রোতাদের তাদের বক্তব্য শুনিয়ে চ্যানেলের ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রেখে ব্যথিত বিস্ময়ে বার বার প্রশ্ন রেখেছেন — কেন বাংলার এই অবস্থা যখন প্রতিবেশি রাজ্যগুলোতে নিরুপদ্রবে ভোট হয়! কিন্তু ভুলেও বললেন না – কেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় পদ্মনেতারা এই বাংলায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। কেন এক মহিলার বিরুদ্ধে বিরামহীন বিষোদগার করে চলেছেন যে বিষ নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চ থেকে সমাজ আবহে ছড়িয়ে পড়ছে, গরল হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে! কেন প্রধানমন্ত্রী সমস্ত শিষ্টাচার সৌজন্য জলাঞ্জলি দিয়ে, নির্বাচনী বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, দেশের যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধূলিসাৎ করে রাজ্যের সরকারি আধিকারিকদের কৃষকপঞ্জী বানানোর নির্দেশ দেন? মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা বলে কি এই অসৌজন্য এত অবলীলায় প্রকাশ করা গেল!

এক কথায়, ‘ঠগেন্দ্রনাথ’ তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে বাংলার বাতাসে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ভেদের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন গত কয়েক মাস ধরে। এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা বাংলার মাটিতে ঠাঁই পাবে না, কিন্তু বাংলার সমাজ জীবনের অনেকটাই ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছেন দূষণ ছড়িয়ে। কেউ বলতেই পারেন, বাংলার বাতাস কি নারীবিদ্বেষ মুক্ত ছিল! তাহলে কয়েক বছর আগে অভিনেতা-সাংসদ যখন বিরোধী দলের কর্মীদের বাড়ির মেয়েদের ‘রেপ’ করিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তখন প্রবল হর্ষধ্বনিতে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল কেন তার দলীয় কর্মীরা? ঠিক। কিন্তু এই কুমন্তব্যের জেরে সেই ‘ভালোমানুষ’ ইমেজের নায়কটি পরিণত হয়েছিলেন ‘কলঙ্কিত নায়কে’ এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন সমাজে। অকাল প্রয়াণের পরও সে কলঙ্ক মোছেনি! পুরুষপ্রধান সমাজে পিতৃতন্ত্র ছিল, আছে – মেয়েদের কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখার, মেয়েদের দক্ষতা, যোগ্যতাকে সন্দিহান চোখে দেখার চোরা প্রবণতা – ছিল, আছে। কিন্তু সেটা সমাজের উপরিকাঠামোয় তত উচ্চকিত ছিল না। নানা সংস্কার-প্রয়াস, নারী শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলন, যুক্তিবাদ, সমাজমনস্ক প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং অবশ্যই রাজনৈতিক চেতনার আলোকে নারী বিদ্বেষের অন্ধকার থেকে সমাজ ক্রমমুক্তির পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। মেয়েদের সমানাধিকার, স্বায়ত্ততা, মর্যাদার দাবি উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু কোথায় গেল সেই পরিবেশ? সেই পরিসর? যখন পনেরো ফুট লম্বা বাঁশ, চ্যালাকাঠ, হাঁসুয়া নিয়ে এক মহিলাকে তাড়া করা হয় এবং শরীরে তার ঘা পড়ে, যখন কোনো মহিলাকে সপাটে চড় কষানো হয় – তখন আর তাকে ‘মহিলা’ ভাবা হয় না – তখন সে ‘মেয়েমানুষ’! জনপরিসরে নেমেছো পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে, পাঞ্জা কষতে — তাহলে আবার ‘মহিলা কার্ড খেলা’ কেন? (এই শব্দবন্ধটি বাংলাকে ‘উপহার’ দিয়েছেন স্বনামধন্য দিলীপ ঘোষ – বিজেপির রাজ্য সভাপতি!) – ভাবটা এইরকম।

ঐদিন মহিলা সাংবাদিকদেরও একাধিক জায়গায় নিগৃহীত ও হেনস্থা হতে দেখা গেছে শাসকদল সহ বিভিন্ন দলীয় নেতা কর্মীদের হাতে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিষ্ণুপুরের পানাকূয়া পঞ্চায়েতের বাসিন্দা রীতা পাঁজা দীর্ঘ দশ বছর ভোট দিতে পারেননি। এবারও গ্রামবাসী যুবক গৌরাঙ্গ মাকালের বাধা ও হুমকি অগ্রাহ্য করে ভোট দেন। নির্বাচন কমিশন মাকালকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেও লিখিত অভিযোগ না থাকায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়া সেই মাকালকে দলীয় সহকর্মীরা গলায় মালা পরিয়ে ‘বীরের’ সম্বর্ধনা দিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করে! কী বলবেন?

নির্বাচনের আগের রাতে গোঘাটে শাসকদলের বাইকবাহিনীর তাণ্ডবে এক বিজেপি কর্মীর মা মালতী আদক মারা যান। তার প্রতিক্রিয়ায় এক তৃণমূলের পোলিং এজেন্টের বাবাকে নিগ্রহ করলে তিনিও মারা যান। সন্তানদের ভিন্নদল করার ‘অপরাধের’ বলি হলেন দুই দরিদ্র পরিবারের দুই অসহায় বর্ষীয়ান মানুষ! নির্বাচন মিটে যাবার পর, গ্রামে ঢুকে সন্ত্রাস, বাড়ি ঘর ভাঙচুরের তাণ্ডবে কোনো দলই পিছিয়ে থাকেনি। টিভির পর্দায় সেই এক ছবি-হদ্দ গরিব পরিবারের সামান্য মাথা গোঁজার আস্তানাটুকু আধ-ভাঙা, জিনিসপত্র ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে। কত কষ্ট করে, তিল তিল করে গড়ে তোলা গৃহস্থালির এই পরিণতি! মেয়েদের কান্না-হাহাকার। এসব দেখে মনে হয়-এদের কী অপরাধ যে কোলের শিশু নিয়ে রাস্তায় অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটাতে হবে?

আসানসোলের তৃণমূলপ্রার্থী অভিনেত্রী সায়নী ঘোষকে তার বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বী অগ্নিমিত্রা পাল হারার পর কন্ডোমের দোকান খোলার পরামর্শ দিয়েছেন। কতটা বিকৃতির শিকার হলে, বুকে কতটা ঘৃণা পুষে রাখলে-একজন মাঝবয়সী মহিলা এক তরুণীকে এমন কথা বলতে পারেন? এই বিকৃতি, বিদ্বেষ নিয়ে ‘জনপ্রতিনিধি’ হয়ে উনি মানুষের কাছে কী বার্তা দেবেন, কী মহদুপকার করবেন তাদের জন্যে? দেখুন, উনি কতটা সংক্রমিত হিংসায়! এমন নিদর্শন আছে ভূরি ভূরি যেখানে শালীনতার শেষ সীমাও লঙ্ঘিত হয়ে গেছে। তালিকা বাড়িয়ে শিরঃপীড়া বাড়ানোর দরকার নেই!

এবার রাজনীতির জগৎ ছেড়ে একটু সমাজের কথায় আসি, যদিও সেটাও রাজনীতিমুক্ত নয়।সেদিন কথা হচ্ছিল এক সরকারি সংস্থার প্রযুক্তিবিদ আধিকারিকের সঙ্গে। বললেন, “কয়েক দশক আগে বি টেক করে যখন শিক্ষানবিশীতে ঢুকেছিলাম, তখন এক মহিলা হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় নিজের পেশাগত ও প্রশাসনিক দক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিতও করতে পেরেছি। মহিলা হিসেবে বাড়তি সুযোগ তো নিই-ই নি, বরং অতিরিক্তটাই দিয়েছি। আমার জুনিয়র প্রতিটি মহিলা সহকর্মীকেও সেটাই বুঝিয়েছি।

এখন প্রতিটি সংস্থাকে নিজের সম্পদ নিজে যোগাড় করে নিতে হচ্ছে। সংস্থাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে সবল পায়ে চলাটাকেও আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। সবাই একযোগে এই সামগ্রিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার সাথে সাথে যখনই প্রোডাকশনের কোন সমস্যা বা ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়েছে, রাত দুপুরে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে, দৌড়েছি। সবাই মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে বিপদ সামলেছি। তখন সিনিয়র-জুনিয়র, নারী-পুরুষ এসব অবান্তর প্রশ্নই আসেনি। কোনো পদক্ষেপ বেঠিক মনে হলে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছি। সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে গেছি। তাতে সাময়িক মনোমালিন্য হলেও কখনও অসম্মানিত হইনি। জুনিয়র কোলিগদের কাছ থেকেও, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভালোবাসা ও সম্মান দুটোই পেয়েছি। অন্তত এতদিন পর্যন্ত তাই-ই জানতাম। হঠাৎ মাত্র কিছু দিনের মধ্যে অবাক হয়ে দেখছি, পরিস্থিতিটা কেমন পাল্টে যাচ্ছে। প্রতি পদে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে – তুমি একজন মহিলা! তোমার কথা শুনবো কেন? চোখের সামনে দেখলাম আমার যে পদে প্রমোশন প্রাপ্য ছিল, সেটি দেওয়া হল একজন জুনিয়রকে যিনি ভুল করেও কখনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো সংঘাতে যাননি। সে যাক। কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে আর চাকরিটা করা যাচ্ছে না। রাতের ঘুম চলে গেছে। অবসরের এখনও দেরি আছে। কিন্তু আমি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।” তার আক্ষেপ – “যখন একজন সিএম-কে যা খুশি বলা যায়, তখন আমরা আর সম্মান আশা করব কী করে!”

একজন মহিলা ইট ভাটা বা কয়লা খাদানের শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা, চাকরির সুরক্ষা তাহলে কোথায়? বিশেষ করে যখন নতুন শ্রম কোডে তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে?

গত সপ্তাহে আউশগ্রাম দুটি আদিবাসী বালিকাকে গণধর্ষণ করা হয়। সেই আউশগ্রামেই এক জনমজুর মহিলাকে তার জামাই দুই সঙ্গীকে নিয়ে গণধর্ষণ করে গত সোমবার। মহিলাদের ‘মেয়েমানুষ’ হিসেবে, পুরুষের অধীনত হিসেবে, মনুষ্যেতর হিসেবে দেখার এই ‘চোখটা’ প্রতিদিন ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা গোলওয়ালকরের শিষ্যরা এই বাংলায় নতুন করে ফুটিয়ে চলেছেন। এই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের প্রতিটি মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের কষ্টার্জিত সমাজভাবনাকে, সংস্কৃতিকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-13