করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও নাগরিক সচেতনতা
The second wave of corona

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন ২০২১-এর শুরুতে আমেরিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে তখন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বলা হয়েছিল ভারত করোনা মোকাবিলায় অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু এই প্রগলভতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দ্রুতই ভারতে আছড়ে পড়েছে। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, দিল্লী, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য কয়েকটি প্রদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগে রেখেছে। বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, গবেষকরা সতর্ক করছেন। পশ্চিমবঙ্গে আট দফা নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচনী মিটিং-মিছিল-সমাবেশের ভিড় তো লেগেই আছে, একইসঙ্গে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ভিড়ও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ভোট কেন্দ্রে থার্মাল স্ক্যানার, স্যানিটাইজার, বোতাম টেপার হাতের জন্য গ্লাভস্ —সবকিছুই রাখা হচ্ছে। কিন্তু ব্যবহারে ভুল তো হয়ে যেতেই পারে। প্রতিটি বুথ পিছু ভোটার সংখ্যা হাজারে বেঁধে দিলেও দুই ভোটারের মধ্যে তিন ফুট দূরত্বের ব্যবধান থাকছে না। ভেতরে পোলিং এজেন্টদের বসার জায়গাও যথেষ্ট দূরত্ব মেনে থাকছে না। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সমূহ সম্ভাবনা থাকছেই। রোগ লক্ষণ ছাড়া যাঁরা জীবাণু বহন করছেন তাদের সংস্পর্শে যারা আসছেন তারাও সংক্রমিত হতে পারেন। এসব নিয়ে আদৌ দুর্ভাবনা থাকছে না।

রাজনৈতিক দলগুলির কর্তাব্যক্তিদের, কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, পুলিশ-প্রশাসন, কেন্দ্রীয় বাহিনী কারও কি কোনো হুঁশ আছে? এরই মধ্যে উপরন্তু রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চারজন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গেলেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুও ঘটছে। মারা গেলেন অধ্যাপক ও কবি পবিত্র কুমার মুখোপাধ্যায়। প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক।

করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে প্রশ্ন উঠছে, আবারও কি লক ডাউন করা হবে? এই রাজ্যে, এই দেশে? এই প্রশ্নে সাধারণ নাগরিকরা শঙ্কিত, কেন্দ্রের মোদী সরকারকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। আম জনতার সার কথা হল, যেটুকু কর্মসংস্থান রয়েছে তা বন্ধ করে দিতে যেন আর লক ডাউন ঘোষণা করা না হয়। হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকরা ২০২০-র মার্চ নাগাদ লকডাউন জারি হওয়ার পর টের পেয়েছিলেন কাজ হারানো, এতটুকু অর্থের সংস্থান না থাকা, দিনের পর দিন ভুখা পেটে থাকা, কেবলই পথ হাঁটা আর ঘরবাড়িতে ফেরা অনিশ্চয়তার শিকার হয়ে জীবন-জীবিকার পরিণতি কি নিদারুণ হতে পারে! প্রাণে বাঁচতে তারা নিজের নিজের গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সহযোগিতা না করে কেন্দ্রীয় সরকার ফেরার পথ রুদ্ধ করে দেয়। এক অ-সরকারী সংস্থার হিসাব অনুসারে পায়ে পায়ে পথ হেঁটে ফিরে আসতে গিয়ে প্রায় চার শতাধিক পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণ নাশ হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এইসব হৃদয় বিদারক তথ্য পরিসংখ্যান স্বীকার করে না, কোনও খবরই রাখে না। নাগরিক জনতার কত কত অংশ দেশের কোনো কোনো রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত? পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা কোথায় কত?

করোনায় আমাদের দেশে এপর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ১ লক্ষ ৬৯ হাজারের কিছু বেশি। পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজারের ওপর। দেশে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক। পশ্চিমবঙ্গে টেস্ট বাড়ালে দিনপ্রতি পজিটিভের সংখ্যা ১০ হাজার হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মিউট্যান্ট ভাইরাস ভীষণ পরিবর্তনশীল। টিকাকরণ চলছে ১০ কোটি ছুঁই ছুঁই। এখন শোনা যাচ্ছে টিকা সরবরাহে ঘাটতি থাকছে, হাসপাতালে শয্যা সংখ্যার ঘাটতি রয়েছে। এখনও অনুর্দ্ধ ৪৫ বয়সীদের টিকা শুরু হয়নি। তাতেই ঘাটতি! খবরে প্রকাশ, কিছু কিছু রাজ্যে যেমন, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, পাঞ্জাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব থাকছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে অ্যাকটিভ রোগীর সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। মহারাষ্ট্রে ৫,৩৮০০০, ছত্তিশগড়ে ৮৫,০০০, কর্ণাটকে ৫১,৭০০, উত্তরপ্রদেশে ৫৮,৮০০, কেরালায় ৪০,০০০। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের খবর হল, অ্যাক্টিভ পেশেন্টদের ০.৪৬ শতাংশ ভেন্টিলেটরে, ২.৩১ শতাংশ আইসিসিইউ, ৪.৫১ শতাংশ অক্সিজেনের সাহায্যে চিকিৎসাধীন। টিকা নিলেই কি প্রতিরোধ নিশ্চিত? এপ্রসঙ্গে বেলেঘাটা নাইসেডের বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী জানালেন, টিকা নেওয়ার পর করোনা হলে ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হবে। খবরে প্রকাশ, এইমস-এর টিকা নেওয়া জনা ত্রিশ ডাক্তারের করোনা পজিটিভ হয়েছিল। তাঁরা চিকিৎসাধীন। সুতরাং টিকা নিলেই করোনা হবে না এই ধারণা ভুল। তাই মুখাবরণ পরা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা উচিত। করোনা মোকাবিলায় প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর গুরুত্ব বিরাট। সেটা করতে হলে দারিদ্র থেকে মুক্তি আবশ্যিক প্রয়োজন। তাই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন দারিদ্র কমাতে সরকারী হস্তক্ষেপ খুবই জরুরী।

সুতরাং করোনার মোকাবিলায় লকডাউন কোনো পন্থা হতে পারে না। মানুষকে সচেতন করা, মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, মানুষের আর্থিক উপায় অব্যাহত রাখা, দ্রুত গতিতে টেস্ট ও টিকা অভিযান চালানো, হাসপাতাল ব্যবস্থাকে তৈরি রাখা — এসব করে চলতে পারলে মানুষ নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে।

- নিত্যানন্দ ঘোষ 

খণ্ড-28
সংখ্যা-14