বিজেপির ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপত্র ‘সোনার বাংলা সংকল্প পত্রে’ পরিবেশিত হয়েছে ১১টি উপশিরোনামে ১৩৪ দফা প্রতিশ্রুতি! সব নেতারাই বলে আসছেন, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ পাঁচ বছরের মধ্যেই ‘সোনার বাংলা’ তৈরি করে দেখিয়ে দেবে! এসব যে ভোটবাজারে হাওয়া তুলতে ভূয়ো কথা দেওয়া তার প্রমাণ ইতিমধ্যে দলের হোতারা বারবার নিজেরাই দিয়েছেন। ভোলাবে কি করে মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর ‘মুখ’ করে কেন্দ্রে প্রথমবার ক্ষমতায় আসতে বছরে দু’কোটি বেকারের হাত চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল! ক্ষমতায় আসার পর ওই প্রসঙ্গ বেমালুম চেপে যাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল! এমনকি তা ‘জুমলা’ অর্থাৎ নির্বাচনী পরিস্থিতিতে ওরকম অনেক কথা দিতে হয় বলে চাপ এড়ানোর অপকৌশল নেওয়া হয়েছিল! দেশের মানুষ দেখছে মোদী সরকারের হাতযশে কেমন ‘সোনার ভারত’ গড়ে উঠছে! বিজেপি শাসনের রাজ্যগুলোকে কেমন ‘স্বর্ণময়’ করে তোলা হচ্ছে! তবু বিরূপতা-বিদ্রূপকে আমল না দিয়ে পুনরায় নির্বাচনী পরিস্থিতিতে দাঁও মারতে নানা ছদ্ম প্রতিশ্রুতির কৌশল নিচ্ছে। প্রতারণার ওস্তাদিকে কিন্তু ঘুরে ফিরে ধরা পড়ে যাওয়া ও অবিশ্বাসের মাশুল গোনার মুখে পড়তে হচ্ছে। সেই মতোই বাংলার নির্বাচনের পরিস্থিতিতে বিজেপির ফেরী করা যাবতীয় প্রতিশ্রুতি মানুষের অবিশ্বাস ও কাঁটাছেড়ার মুখে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। ‘সংকল্প পত্রে’ অসঙ্গতি রয়েছে ছত্রে ছত্রে। বলা হয়েছে, ‘পিডিএস-কে সর্বজনীন করে সমস্ত নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ কিন্তু কেন্দ্রের মোদী সরকারের প্রবণতা হল গণবন্টণ ব্যবস্থার ক্রমাগত সংকোচন করে চলা। খাদ্যশস্যের বিষয়টিকে ক্রমেই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাজারের হাতে তুলে দেওয়া। অতিমারী পরিস্থিতিতে বিনা মূল্যে খাদ্য সরবরাহের প্রশ্নে চরম অমানবিক নির্দয় নিষ্ঠুর নির্বিকার অবস্থান নিয়েছিল কেন্দ্র। এই অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন কি কেবল একটি রাজ্যের? তাতো নয়। প্রয়োজনটি সারা দেশের সমস্ত রাজ্যের। তাহলে গোটা দেশের জন্য চালু করা হয়নি কেন? উল্টে চালু হচ্ছে গণবন্টণ সংকোচনের পলিসি। তাই কেন্দ্রের ক্ষমতায় থেকে ‘কি করছে’র ভিত্তিতেই উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে এ রাজ্যে এলে ‘কি করবে’ প্রচারিত ছদ্মকথা। ‘সংকল্প পত্রে’ ঘোষিত প্রায় প্রতিটি প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। বিস্তারিত পরিসরে সেই তুলোধোনা করা যেতে পারে। আপাতত কয়েকটি বিষয় নিয়ে দু’কথা হতে পারে।
প্রথমত লক্ষণীয়, অদ্ভুতভাবে কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে কিছু মনীষীদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা স্রেফ ভোট সংস্থানের জন্য যথেষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেমন, বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য বিদ্যাসাগর তহবিল স্থাপন, নতুন কলেজ ও পলিটেকনিক কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তহবিল গঠন, গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ‘গুরুদেব রুরাল মিশন’ নির্মাণ, বিচার ব্যবস্থার পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তহবিল স্থাপনের কথা দেওয়া হয়েছে! ইতিহাসে কাদের কি বিশেষত্ব ছিল, আর তাদের স্মৃতিকল্পকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে কেমনতর সব বিষয়ের সাথে! শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা রূপায়ণে উপরোক্ত মনীষীদের স্মৃতিনাম থাকলে তবু সম্মান দেখানো হচ্ছে মনে করা যেত। ইতিমধ্যে অবশ্য বাংলার স্বপ্ননায়কদের নামাঙ্কিত ব্যবসা সংস্থা খুলতে শুরু করেছে। যেমন, ‘নেতাজী সুভাষ ইনস্টিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্ট’! এইসব ব্যাপার স্যাপার জমি তৈরি করে দিচ্ছে। আর বানিয়াদের দ্বারা চালানো পার্টি বিজেপি মনীষীদের স্মৃতি ব্যবহারের প্রকরণে তদনুরূপ নমুনা মিলছে। ‘সংকল্প পত্রে’ বলা হয়েছে, নির্মাণ করা হবে নাকি ‘ক্রিড়া বিশ্ববিদ্যালয়’!
বিজেপির ‘সংকল্প পত্রে’ বলা হয়েছে, ‘বাংলাকে ভারতের সাস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে গড়ে তুলতে সোনার বাংলা তহবিল স্থাপন’ করা হবে। তার মানে বিজেপি ক্ষমতা পেলে বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে ভেঙেচুরে তাদের ছাঁচে ঢেলে গড়বে। বাংলা তো ইতিহাসগতভাবে সুদূর অতীতকাল থেকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হয়েই রয়েছে। তা অন্তত কয়েকশ বছর যাবত তো বটেই। বিশেষত কিছু অতিকথার কথা বাদ দিলে ঐতিহাসিক নবজাগরণের সময়কাল থেকে শুরু করে একদিকে সামন্তবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী এবং অন্যদিকে উপনিবেশবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক সৃজন ও সংগ্রামের পরম্পরা বাংলার আছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন, শ্রেণীসংগ্রাম ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা থেকে শুরু করে গণনাট্য, নবনাট্য, নতুন ধারার চলচ্চিত্রায়ণ, প্রগতি শিল্পসাহিত্য-সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা, লালন থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত, বইমেলা, পছন্দের অনুশীলন ও প্রেম ভালোবাসা, খাওয়া-পরা, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের, ঔদার্যের পরম্পরা। এই সবকিছুর দৌলতে বাংলা সারা দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীর ঐতিহ্য বহন করে আসছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিশেষ অর্জন করেছে। এতে কোনোকালেই সংঘবাদী ধারার কোনও জায়গা ছিল না, বরং বহু ক্ষেত্রে সংঘবাদী ধারার বিরুদ্ধে সংঘাতের মধ্যে দিয়ে এই পরম্পরা বিকশিত হয়েছে। এই ঐতিহ্যকে দিগভ্রান্ত করতে নিচের থেকে আরএসএস সুচতুর প্রয়াস চালিয়ে আসছে। তার কিছু কিছু বিষফলও লক্ষ্যণীয়। এবার বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতা দখলের গন্ধ পেয়ে বাংলার প্রতিষ্ঠিত পরম্পরাকে নিজের ছাঁচে পাল্টে দিতে ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিস্পর্ধার চ্যালেঞ্জ জানানো এবং সংঘবাদী শাসকদের ক্ষমতায় আসতে না দেওয়াই আজ সময়ের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক দাবি।