স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট: বিজেপি’র কূটকৌশলে বেসামাল টিএমসি ও কংগ্ৰেস
Report of the Standing Committee

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০ সম্পর্কে খাদ্য, উপভোক্তা বিষয়ক ও গণবন্টন সম্পর্কিত মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট সংসদে পেশ হওয়ার পর অস্বস্তিতে পড়েছে প্রধান বিরোধী দলগুলো। কারণ, এই আইনটা নিয়ে তারা সংসদে ও সর্বসাধারণের সামনে যে অবস্থান নিয়েছে, নিজেরা স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কমিটির রিপোর্টে তার উল্টো কথাই বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০ হল মোদী সরকারের পাশ করা তিনটে কৃষি আইনের অন্যতম, যে তিনটে আইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা গত চার মাস ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। টিএমসি ছাড়াও কমিটিতে রয়েছে কংগ্ৰেস, আপ, এসপি, শিবসেনা, এনসিপি’র মতো বিরোধী দলের সদস্যরা। অন্যান্য দলের মধ্যে টিএমসি ও কংগ্রেস আলোচ্য আইনটার বিরোধিতা করেছে, কৃষকদের কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে, টিএমসি এমনকি পশ্চিমবাংলা বিধানসভায় তিনটে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাবও পাশ করিয়েছে। কিন্তু পেশ করা স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই আইনের রূপায়ণ হলে কৃষিক্ষেত্রে লগ্নি বাড়বে, হিমঘর নির্মাণ, গুদামঘর তৈরি, প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ও রপ্তানিতে বিনিয়োগ হবে, কৃষিপণ্য বিপণনে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং এই প্রক্রিয়ায় কৃষকের আয়ের বৃদ্ধি ঘটবে। আর তাই আইনটাকে সর্বাঙ্গীণভাবে কার্যকর করতে হবে। আইনটা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর প্রকাশ্য অবস্থান আর স্থায়ী কমিটির রিপোর্টেতার বিপরীত বিষয়ের সুপারিশ সবচেয়ে বিপদে ফেলেছে টিএমসি’কে। এবং তা এই জন্য যে, কমিটির রিপোর্টে আইনটাকে কল্যাণকর রূপে অভিহিত করে সম্পূর্ণ রূপে রূপায়িত করার সুপারিশ মোদী সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করায় চেয়ারম্যান সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল টিএমসি’কেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনের মুখে সজ্ঞানে এই ধরনের অবস্থান গ্ৰহণ যে তাদের পক্ষে আত্মঘাতী হবে এবং তারা কখনই এই পথে যাবে না – এই যুক্তিধারাকে মেনে নিয়েও বলতে হবে, কৃষকদের আন্দোলন এবং রিপোর্টের কথা মাথায় রেখে স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের দলকে আরো সক্রিয় ও হুঁশিয়ার হওয়া উচিৎ ছিল।

তবে, তারা যে এই রিপোর্টের জন্য দায়ী নয়, কৃষকদের সঙ্গে, নিজেদের ঘোষিত অবস্থানের সঙ্গে তারা যে বেইমানি করেনি তার প্রমাণস্বরূপ টিএমসি বলছে যে, রিপোর্টনিয়ে যেদিন কমিটির শেষ বৈঠক হয় সেদিন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী প্রচারে কলকাতায় ছিলেন, ফলে বৈঠকে যোগ দিতে পারেননি। কাজেই, তাঁকে ও তাঁর দলকে খলনায়ক রূপে প্রতিপন্ন করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। টিএমসি’র রাজ্যসভা সাংসদ ও দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, “পিছনের দরজা দিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। কমিটির চেয়ারম্যান যখন নির্বাচনের জন্য কলকাতায় ব্যস্ত, তখন সংসদীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রতারণা করে এই রিপোর্ট গৃহীত হয়েছে”। কংগ্ৰেসের ওপরও রিপোর্টের দায় খানিকটা এসে পড়ায় তারাও রিপোর্ট থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করেছে। এই স্থায়ী কমিটিতে কংগ্ৰেসের তিনজন সদস্য রয়েছেন – সপ্তগিরি শঙ্কর উল্কা, রাজমোহন উন্নিথান ও ভৈথিলিঙ্গম ভে। তিনজনই লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, “আমি রিপোর্টের সুপারিশ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছি, এবং রিপোর্টের প্রতি বিরোধিতা প্রকাশ করছি।” রিপোর্ট “সমস্ত রীতি ও প্রথাকে অগ্ৰাহ্য করে গ্ৰহণ করা হয়েছে” বলেও তাঁরা অভিযোগ করেছেন। কংগ্ৰেস নেতা জয়রাম রমেশও বলেছেন, “চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে রিপোর্ট গ্ৰহণ অভূতপূর্ব ব্যাপার”।

রিপোর্ট গ্ৰহণ ও পেশের ক্ষেত্রে তারা এক অপ্রস্তুত পরিস্থিতির মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল বলে টিএমসি ও কংগ্রেস বোঝাতে চেয়েছে। তবে, রিপোর্ট তৈরি ও গ্ৰহণের ক্ষেত্রে বিজেপি’র পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়ে অভিযোগের ক্ষেত্রে যথার্থতা যদি থেকেও থাকে, রিপোর্ট যে মোদী সরকারকে কিছুটা সুবিধা যোগাচ্ছে এবং কৃষকদের আন্দোলনের সামনে কিছুটা প্রতিকূলতা খাড়া করছে তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। সংযুক্ত কিসান মোর্চা তাদের এক বিবৃতিতে তাই বলেছে, “আমরা কমিটির এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও বিরোধিতা করছি। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ও অন্যান্য মঞ্চে আমরা ব্যাখ্যা করে বারবারই বলেছি যে, তিনটে আইনই ক্ষতিকারক এবং আইনগুলো কৃষক ও সাধারণ নাগরিকদের শোষণ করবে”। মোর্চা স্থায়ী কমিটির কাছে আবেদন জানিয়েছে, তারা যেন তাদের সুপারিশ প্রত্যাহার করে নেয়।

তিনটে কৃষি আইনই কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী এবং কর্পোরেট স্বার্থের মদতকারী বলে সমালোচিত হয়েছে। আলোচ্য আইনটা রূপায়িত হলে কর্পোরেট সংস্থাগুলো চাল, ডাল, আলু, পিঁয়াজ, গম, ভোজ্য তেল, ইত্যাদির মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য যত ইচ্ছে মজুত করে মুনফাবাজি চালাতে পারবে। আইন কালো বাজারিকেও উৎসাহিত করবে। কর্পোরেট স্বার্থের পাহারাদার বিজেপি যে এই আইনের সপক্ষে রিপোর্ট তৈরিতে যথেষ্ট আগ্ৰহী হবে তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হওয়ার নয়। বৈঠক ডাকা হয় অত্যন্ত কম সময় দিয়ে। কংগ্রেস সাংসদ সপ্তগিরি উল্কা জানিয়েছেন, “১৮ তারিখের বৈঠক অত্যন্ত কম সময়ে ডাকা হয়। সকাল ৯টা নাগাদ (১৭ মার্চ) ফোন করে আমাকে বৈঠকের কথা জানানো হয়। প্রায় ১০০ পাতার খসড়া রিপোর্টও এই সময় আসে”। শুধু এই নয়, ১৮ মার্চের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিজেপি’র অজয় মিশ্র। বৈঠক ডাকা থেকে রিপোর্ট তৈরি ও গ্ৰহণ – গোটা প্রক্রিয়াটা বিবেচন করার পর মনে হয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইনের সপক্ষে রিপোর্ট গ্ৰহণের লক্ষ্যে বিজেপি পরিকল্পনা ও কৌশলকে খুব ভালোভাবেই সাজিয়েছিল। পাঁচটা রাজ্যে নির্বাচনী পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে ওদের কৌশলের কেন্দ্রে ছিল বৈঠকে উপস্থিত হওয়া ও প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বিরোধী সদস্যদের যথেষ্ট সময় না দেওয়া, প্রায় ১০০ পাতার খসড়া রিপোর্ট পড়ে উঠে নির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশের জন্য বিরোধী সদস্যরা যাতে যথেষ্ট সময় না পায় তা সুনিশ্চিত করা। সিপিআই(এমএল)-এর কৃষক সংগঠন সারা ভারত কিসান মহাসভাও স্থায়ী কমিটির রিপোর্টের নিন্দা করে বলেছে, পাঁচটা রাজ্যের নির্বাচনী পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত কম সময় দিয়ে বৈঠক ডাকা হয় যাতে বিরোধী সদস্যরা বৈঠকে উপস্থিত হতে না পারেন। স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট তৈরি হয়েছে কর্পোরেট কোম্পানিসমূহ ও মজুতদারদের স্বার্থে, যাদের বড় পুঁজি রয়েছে। এই আইনের লক্ষ্য হল গণবন্টন ব্যবস্থাকে নিকেশ করা, দরিদ্রের থালা থেকে খাবার কেড়ে নেওয়া এবং খাদ্য দ্রব্যগুলোকে বিপুল মুনাফা অর্জনের ভোগ্যপণ্যে পরিণত করা।

বারবারই দেখা গেছে, নিজেদের স্বার্থ হাসিলে বিজেপি কুটিল ও নৃশংস পথ অনুসরণে একটুও পিছপা হয় না। স্থায়ী কমিটির রিপোর্টও বিজেপি’র ধড়িবাজির সাক্ষ্য বহন করছে। এই রিপোর্ট আরো একবার জানিয়ে দিল, বিজেপি’র মোকাবিলা করতে গেলে তার প্রতারণাময় কৌশল ক্ষমতার সঙ্গেও টক্কর দিতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-12