আবার কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে বিভিন্ন রাজ্য থেকে শুরু হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপরীতমুখী অভিবাসন, বা রিভার্স মাইগ্রেশন। গতবছর অপরিকল্পিত, আচমকা দেশজুড়ে ডেকে দেওয়া পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নির্দয় লকডাউনের বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি। আর, কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিপোর্টে প্রকাশিত, ২০০৬-০৭ সালে মনরেগা প্রকল্প প্রথম চালু হওয়ার পর এই প্রথম, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করার সংখ্যা ১১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যে একশো দিনের কাজের প্রকল্পকে মোদী কটাক্ষ করে বলেছিলেন, এটা ভবিষ্যতে ব্যর্থ প্রকল্পের এক স্মারক হয়ে থাকবে, সেই প্রকল্পটাই অসহায়, কর্মচ্যুত, কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে বেঁচে থাকার শেষ খড়কুটো হয়ে উঠলো।
কেন্দ্রীয় সরকারের ১ এপ্রিলে প্রকাশিত শেষ তথ্য অনুযায়ী, মাত্র এক বছরের মধ্যে এই প্রকল্পে নথিভুক্তির সংখ্যা এক লাফে বেড়েছে ৪১.৭৫ শতাংশ — গত অর্থবর্ষে যা ছিল ৭.৮৮ কোটি, তা ২০২০-২১ অর্থবর্ষে হয়েছে ১১.১৭ কোটি! ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ পর্যায়ে নথিভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ৬.২১ কোটি থেকে ৭.৮৮ কোটিতে উঠা নামা করতো।
পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপুল বাহিনী নিজ নিজ এলাকায় ফিরে আসার পর গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক তেমনি বেড়েছে পরিবার পিছু এই প্রকল্পে অংশ নেওয়ার মাত্রা। ২০১৯-২০-তে ১০০ দিন কাজ সম্পন্ন করা পরিবারের সংখ্যা ছিল ৪০.৬০ লক্ষ, যা ২০২০-২১ এ বেড়ে হয়েছে ৬৮.৫৮ লক্ষ — এটাও আরেকটা রেকর্ড। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কর্মদিবসের সংখ্যা ৩৮৫.৮৯ কোটি, গত অর্থবর্ষের তুলনায় এবার কর্মদিবসও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে, আর এই বৃদ্ধির হার ৪৫.৪৩ শতাংশ।
এবারের বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী তাঁর আড়াই ঘন্টার ভাষণে তিনবার ‘কাজ’ ও ছ’বার ‘কর্মসংস্থানের’ কথা আওড়েছেন। কিভাবে নতুন নতুন গড়ে ওঠা টেক্সটাইল হাব, গণপরিবহন ব্যবস্থা, তামিলনাড়ুতে কিছু নতুন শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক নতুন কাজ সৃষ্টি করবে, এই সব বলে তাঁর কল্পকথার ফানুস উড়িয়েছিলেন। এবং, এই নতুন নতুন ‘কাজ’ সৃষ্টির স্বার্থেই সম্পদ সৃষ্টিকারী নিয়োগকর্তাদের (পড়ুন, কর্পোরেটদের) আরও উৎসাহ জোগাতে তিনি এই বাজেটে হ্রাস করলেন বেশ কিছু পণ্যের উপর কাস্টমস ডিউটি, শিল্পকে দরাজ হাতে দিলেন উৎপাদন ভিত্তিক ইনসেন্টিভ (পাঠক, মনে রাখবেন, আম জনতার জন্য যা ভর্তুকি, কর্পোরেটদের জন্য তা হয়ে যায় ইনসেন্টিভ)। আর, বারংবার কর্পোরেট ঘরানাগুলোকে ভূয়সী প্রশংসা করলেন দেশের ‘সম্পদসৃষ্টিকারী’ ও ‘কাজ সৃষ্টিকারী’ হিসাবে। এই কথাগুলো যখন অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, তার ঠিক কিছুদিন আগে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি এক রিপোর্টে জানায়, ভারতের ৫০ কোটি আনুমানিক শ্রমশক্তির মধ্যে প্রায় ৪০.১ কোটি মানুষ প্রকৃত অর্থে কর্মরত। আর, প্রায় ১০ কোটি মানুষ, যাদের মধ্যে সিংহভাগই হলেন তরুণ, তারা হন্যে হয়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজছেন। অর্থমন্ত্রী কর্পোরেটদের হয়ে যতই সার্টিফিকেট দিন না কেন, নির্মম বাস্তব এটাই, বিপুল সংখ্যক কর্মঠ তরুণ কাজের সন্ধানে দাঁড়িয়ে আছেন উপান্তে, আর, বিগত দু’বছর ধরে এই ৪০ কোটি সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়, যা দেখিয়ে দেয় যে শ্রমবাজার স্থিতাবস্থার মুখে। আর, বিরাট সংখ্যক এই বেকার বাহিনী, অর্থনীতির নিয়মেই, প্রকৃত মজুরির হারকে ঠেলে নামিয়েছে নীচের দিকে। গতবছর অতিমারীর ছোবল কেড়ে নেয় লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের কাজ। শহরাঞ্চল থেকে উৎখাত হওয়া কাজ খোয়ানো কাতারে কাতারে মানুষ গ্রামে ফিরে যায়, আর কৃষি বা গ্রামের অকৃষি ক্ষেত্র সেই কর্মচ্যুত এক বিরাট অংশকে তার অর্থনীতির মধ্যে ঠাঁই দেওয়ার চেষ্টা চালায়। আর, এরফলে গ্রামীণ মজুরীও নেমে যাচ্ছে ক্রমেই নীচের দিকে। কেন্দ্রীয় লেবার বুরো কর্তৃক প্রকাশিত মজুরি সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, উত্তর প্রদেশে কৃষি মজুরদের মজুরি ২০১৫ সালে ছিল দু’শো টাকা, যা ২০২০তে বেড়ে দাঁড়ায় ২৭২ টাকা। পাঁচ বছরে ৭২ টাকা বৃদ্ধি অর্থাৎ ফি বছর ১৫ টাকা বা প্রতি বছর ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি। কিন্তু প্রতি বছর গড়ে ৪.৪ শতাংশ মুল্য বৃদ্ধির সাপেক্ষে প্রকৃত বৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ২.৫ শতাংশ। লেবার ব্যুরোর চার্ট থেকেই দেখা যায়, কৃষিক্ষেত্রের বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথে যুক্ত কৃষি মজুরদের (পুরুষ) মজুরি বিগত কয়েক বছর ১২ থেকে ১৬ টাকায় আর মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৪ টাকা বৃদ্ধিতে আটকে রয়েছে। প্রতি বছরের মূল্যবৃদ্ধি নাম-কা-ওয়াস্তে প্রকৃত মজুরিবৃদ্ধিকে মুছে দিচ্ছে। সিএমইআই জানিয়েছে, যে কাজগুলো আগে ছিল সেগুলোও লোপাট হয়ে যাচ্ছে, আর দেশের যে কাজগুলো অবশিষ্ট রয়েছে, তা দু’টো মারাত্বক অভিশাপে দুষ্ট — অত্যন্ত কম মজুরী ও কর্মক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। তাই, বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী কর্পোরেটদের যতই পিঠ চাপড়াক না কেন, আতঙ্কজনক বেকারত্ব, কোনো নতুন কর্মসংস্থানের আশাপ্রদ ক্ষেত্র খুঁজে না পাওয়ায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তরুণ প্রজন্মের কর্মপ্রত্যাশীর দেশ ভারতবর্ষ গভীর অর্থনৈতিক সংকটের ফাঁসে জর্জরিত ।
যে ১০০ দিনের প্রকল্পটি অতিমারীর গভীর দুঃসময়ে কাজ খোয়ানো পরিযায়ী শ্রমিকদের কিছুটা সুরাহা দিতে পেরেছিল, সেই প্রকল্পে ও গতবছর জুন মাসে ৯০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কাজের জন্য আবেদন করেও কাজ পাননি। আবার, মোদী সরকার ধারাবাহিকভাবে এই প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ অনেক কাটছাঁট করেছে। অতিমারীর পর ২০২১-২২ অর্থবর্ষের জন্য ৭৩ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বরাদ্দ ২০২০-২১ সংশোধিত বরাদ্দের থেকে ৩৫ শতাংশ কম।
যে কর্পোরেটদের ‘সম্পদ সৃষ্টিকারী’, নতুন ‘কাজ সৃষ্টিকারী’ বলে সংসদে তারিফ করলেন অর্থমন্ত্রী, তিনি একটা তথ্য সযত্নে গোপন রাখলেন। আর তা হোল, ১৯৯১ সালে উদারিকরণ চালু হওয়ার পর যে কাজ ভারতীয় অর্থনীতি তৈরি করেছে তার ৯২ শতাংশই ইনফর্মাল। আর, অতিমারী এই ইনফর্মাল শ্রমিকদের উপরই সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৭৫ শতাংশ ইনফর্মাল শ্রমিকই কর্মচ্যুত হয়েছেন। আর, বিশ্বব্যাঙ্ক গতবছরই এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে নতুন করে ১.২ কোটি মানুষ চরম দারিদ্রের কবলে পড়বে।
শিল্পক্ষেত্রকে নিত্য নতুন নানা করছাড় থেকে শুরু করে আর্থিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও এই ফেব্রুয়ারী মাসে শিল্প উৎপাদন হ্রাস প্রাপ্ত হলো ৩.৬ শতাংশ হারে। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন ক্ষেত্রগুলোতে এখনও ঘুরে দাঁড়াবার কোনো ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, ১৩ এপ্রিল ভারতীয় টাকা মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে গত তিন সপ্তাহের মধ্যে তার মূল্যের ৪.২ শতাংশ খুইয়েছে, যা বিগত ন’মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন! আর কোনো উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রার এতো গভীর অবনমন ঘটেনি। এই সময়ে একমাত্র তুরস্কের মুদ্রা নতুন লিরা ভারতের থেকে বেশি অবনমিত হয়েছে।
অধ্যাপক কৌশিক বসু তাঁর একটি লেখায় দেখিয়েছেন, ২০১৮-র পর থেকেই ভারতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে তা ২৩.৭৫ শতাংশ। ১৯৯১র পর ভারতে বেকারত্বের হার কোনদিন এতো বেশি ছিল না। অপুষ্টি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও রীতিমতো উদ্বেগজনক। এনএফএইচএস-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রে ১৬টিতে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। আর, এভাবে অপুষ্টি বেড়ে যাওয়া অতি বিরল ঘটনা।
ফি দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নতুন করে কোভিড সংক্রমণের ঘটনা। গতবছরের লকডাউন আতঙ্ক এখনও পরিযায়ী শ্রমিকদের স্মৃতিতে মারাত্মক এক অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, ফের লকডাউন আতঙ্কে মহারাষ্ট্র, দিল্লীতে কর্মরত অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক আবার ফিরে আসছেন দলে দলে। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিদারুণ অভিজ্ঞতা, যা গোটা দুনিয়ার কাছে ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল, তা মোকাবিলা করতে বিগত এক বছর আমাদের নীতিকারেরা কোনো শিক্ষা নিলেন কি না, আবার তাঁদের সুষ্ঠুভাবে নিজ নিজ এলাকার সন্নিকটে কোনো কাজের সাথে যুক্ত করা যাবে কিনা, এই কঠিন পরীক্ষার সামনে গোটা দেশ, তার শাসক বর্গ, বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচিত সরকার।
আবার কোন মানবিকতার অগ্নিপরীক্ষা আমাদের দিতে হবে, কে জানে।
- অতনু চক্রবর্তী