বিজেপিকে ভোটে হারাও বাংলা বাঁচাও লক্ষ্যকে সামনে রেখে গাইঘাটা বিধান সভা কেন্দ্রের সিপিআই প্রার্থী কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের সমর্থনে ১৯ এপ্রিল ঠাকুর নগর খেলার মাঠে এক নির্বাচনী সভা অনুষ্টিত হল। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের গাইঘাটা লোকাল কমিটির আহবানে সংগঠিত এই সভায় প্রার্থী কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, ছাত্র সংগঠন আইসা-র নেত্রী অন্নেষা রায় বক্তব্য রাখেন। মুখ্য বক্তা ছিলেন লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ভট্টাচার্য। শুরুতে কাগজ না দেখানোর গান করেন বাবুনী মজুমদার এবং মেঘনা মজুমদার।
দীপঙ্কর তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন বাচীক শিল্পী শোভনার আবৃত্তি করা আমীর আজিজের কবিতা ‘সব মনে রাখা হবে’ লাইনটি উদ্ধৃত করে। তিনি বলেন, সত্যিই এবারের বিধানসভা নির্বাচন মনে রাখতে হবে। পশ্চিমবাংলা কেন, সারা দেশের কোথাও আগে এভাবে নির্বাচন হয়নি। দেশ জুড়ে এমনকি আমাদের রাজ্যেও যখন করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ছে তখন রাজ্যে এক মাসের বেশি সময় ধরে আট দফায় নির্বাচন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, গৃহমন্ত্রী সকালবেলা ভোট প্রচার করছেন, বিকালবেলা দিল্লিতে গিয়ে করোনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের নিয়মে সন্ধ্যা সাতটার পর প্রচার বন্ধ, যাতে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়। শীতলকুচীতে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো চার জনকে গুলি করে হত্যা করল কেন্দ্রীয় বাহিনী, আর তিন দিন সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর এবং সমশেরগঞ্জ দুটি কেন্দ্রের প্রার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সেখানে নুতন ভোটের দিন হল ১৩ মে ঈদের দিন। অথচ সেখানে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান। বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে, হত্যার রাজনীতি করছে। এই নির্বাচন বাংলার মানুষের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে দীপঙ্কর বলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’। দেশকে কিছুতেই ‘জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ’ বানাতে দেওয়া যাবে না। বিজেপি দেশের মানুষের পয়লা নম্বর শত্রু। পশ্চিমবাংলায় পার্টির নির্বাচনী পলিসি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দীপঙ্কর বলেন, নির্বাচনও একটা আন্দোলন। সীমিত সংখ্যক এবং নিয়মিত আন্দোলনের জায়গাতেই সিপিআই(এমএল) প্রার্থী দিয়েছে। মিড ডে মিলের কর্মীদের কাজ এবং মজুরি নিয়মিত করা, চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি, তাদের হাসপাতালের ব্যবস্থা রাজ্যের জ্বলন্ত দাবি। লক ডাউনের কারণে ভারতের কর্পোরেট ও ধনি ব্যাবসায়ীরা লক্ষ কোটি টাকার কর ছাড় পেয়ে গেল অথচ পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতাদের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে ঋণ পরিশোধের জন্য। আমাদের পার্টি ঋণ মুক্তি আন্দোলনের সুচনা করেছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব এবারে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করছে। বেকার যুবকদের কাজের দাবি, নয়া শিক্ষা নীতিতে শিক্ষার সুযোগ কমে যাওয়ার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, কৃষক সংগ্রামের অঞ্চল এবং শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলি থেকেই আমাদের মোট ১২টি আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। রাজ্যে ২০১৬-র নির্বাচনে জয়ী বাম বিধায়কদের মধ্যে যাঁরা এখনও লাল ঝান্ডার সাথে আছেন, সিপিআই(এমএল) সেই সব আসনেই সমর্থন করছে। পশ্চিমবাংলার বাম ঐতিহ্যকে মনে রেখেই ফ্যাসিবাদকে পরাস্থ করতে হবে। কত বছর আগে সুকান্ত বলেছিলেন, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’। কমরেড কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর স্বচ্ছ ভাবমুর্তির মানুষ। গাইঘাটা বিধানসভা ক্ষেত্রের মানুষদের কাছে এক চমৎকার সু্যোগ আছে একজন বামপন্থী মানুষকে বেছে নেওয়ার। কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের নেতা হিসাবে বলা হয়। তিনি আসলে সম নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলনের অগ্রনায়ক। দীপঙ্কর বলেন, নাগরিকত্বের বিষয়েও নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশের মানুষকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে, বাংলার মানুষদেরও বিপদে ফেলতে চাইছে। যদি জন্মসুত্রে নাগরিকত্ব অথবা আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া বাতিল করা হয় তাহলে প্রমাণ করতে হবে যে ২০১৪-র ৩১ জুলাই পর্যন্ত যাঁরাই এই দেশে এসেছেন তারা উদ্বাস্তু, ধর্মীয় কারণে উৎপীড়নের শিকার। যার মানে হল, নাগরিকত্ব দেওয়া নয় বে-নাগরিক করে দেওয়া। আসামে বিজেপি সরকার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষকে বে-নাগরিক করে দিয়েছে। যাদের মধ্যে ১৫ লক্ষ হিন্দু বাঙালী। তাদের ‘ডি ভোটার’ (সন্দেহজনক ভোটার) বানিয়ে দিয়ে জবরদস্তি ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু হিন্দু মুসলিম বিভাজন নয় পরিবারের মধ্যেও ভাগ হয়ে গিয়েছে। দীপংকর আহবান জানান বিজেপিকে হারাতে হবে বাংলায় ডিটেনশন ক্যাম্প রুখে দিতে হবে।
শিক্ষা এবং সংস্কৃতির আন্দোলনের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির উল্লেখ করে দীপংকর বলেন, যে সময় বাংলায় নিম্ন বর্ণের দরিদ্র মানুষের শিক্ষার কথা বলছেন তখন মহারাষ্ট্রে জ্যোতিবা ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে শিক্ষার কথা বলছেন।আম্বেদকার বলছেন, শিক্ষিত হও। নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষাকেই বিকৃত করলেন। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের কথা হল সবল আর দুর্বলের মিলন হতে পারেনা। যেমন শোষক আর শোষিতের মিল হবে না। তা যদি করা হয় তবে সবল আরও সবল হবে, দুর্বল আরও বেশি দুর্বল হবে। সারা দেশ পশ্চিমবাংলার দিকে তাকিয়ে আছে। দিল্লীর বুকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কৃষক নেতারা আমাদের রাজ্যে এসে বলে গেলেন বিজেপিকে হারাও। সারা দেশে ব্যাঙ্ক, বীমা রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির শ্রমিক, বিএসএনএল সহ সমস্ত সরকারি সংস্থার কর্মচারিরা দুদিন ব্যাপি ধর্মঘট করে মোদী সরকারের দেশ বেচার নীতির বিরোধিতা করেছেন।
পশ্চিমবাংলায় তৃণমুলের সরকার গণতন্ত্রের প্রসার করতে দেয়নি। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনেকেই ভোট দিতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চলবে। এই সময়ে দেশের মানুষের পয়লা নম্বর শত্রু বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। কমরেড কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর আমাদেরও প্রার্থী। “ভোট দিবেন কিসে কাস্তে ধানের শীসে”। কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরকে জয়ী করার আবেদন রেখে দীপংকর ভট্টাচার্য বক্তব্য শেষ করেন।
সভায় সারা সময় ধরেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সিপিএম-এর প্রাক্তন সাংসদ অসীম বালা এবং সিপিআই নেতা বিরাট মন্ডল।