ভারতের পূবের প্রতিবেশী বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে ২০২১-এর ২৬ মার্চ। এই সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরই আবার বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীর বছর। সেখ মুজিবুর ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের নেতা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, যে রাষ্ট্রটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে সফল হয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পূর্ব পাকিস্তান নাম নিয়ে ভারত থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান থেকে নতুন রাষ্ট্রটার স্বাধীনতা অর্জনে সময় লাগে ২৫ বছরেরও কম। কেননা, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক বন্ধন ধর্ম এবং রাষ্ট্র নিরূপিত জাতীয়তাবাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলে প্রতিপন্ন হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাতৃভাষা রূপে বাংলা ভাষার অধিকারকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালে যে লড়াই শুরু হয় সেটাই দু’দশকের মধ্যে পূর্ণমাত্রার জাতীয় মুক্তি সংগ্ৰামে বিকাশ লাভ করে। এরই পরিণতিতে চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তান জাতিরাষ্ট্রের বাহ্য রূপকে ছুঁড়ে ফেলে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ জাতীয় পরিচিতি গঠনের ক্ষেত্রে ভাষার কেন্দ্রীয়তাকে প্রতিপাদন করে এবং জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ধারার কাছে এক প্রেরণা সঞ্চারী শিক্ষা হয়ে রয়েছে।
গত পাঁচ দশকে আন্তর্জাতিক বাতাবরণে অবশ্য আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ভারতের রণনৈতিক সমর্থনই লাভ করেনি, পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নেরও সমর্থন, যে রাষ্ট্রটি আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কাকে সফলভাবেই নাকচ করেছিল। সেই সময়টা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং পৃথিবীর নানা অংশে জাতীয় মুক্তি সংগ্ৰাম ও বিপ্লবী জোয়ারের যুগ। নতুন দেশটা নিজের জন্য যে অভিমুখ বেছে নিল তারমধ্যে এই বাতাবরণের মতাদর্শগত ছাপ সুস্পষ্ট রূপে দেখা গেল – সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। কিন্তু সদ্য জন্ম নেওয়া প্রজাতন্ত্রের মুক্তির সুবিধাকে সংহত করা এবং অর্থনীতিকে নতুন করে গঠন করার সুবিশাল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে সামলাতে পারার আগেই বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ল। সেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করা হল, তাঁর মন্ত্রীসভার কয়েকজন সদস্যকে গ্ৰেপ্তার করে পরে হত্যা করা হল এবং নতুন প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দিশা অল্প দিনের মধ্যেই ধাক্কার মুখে পড়ল।
আজ ভারতীয় রাষ্ট্র যেমন সাংবিধানিক মূল্যবোধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের লক্ষ্য থেকে পিছু হঠছে, একইভাবে বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের সংকট তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, চরম বিশৃঙ্খলা ও অপশাসনের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতিতে মৌলবাদী শক্তিসমূহ এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা মাথাচাড়া দিচ্ছে। নির্বাচন আর অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে গণ্য হচ্ছে না; ভিন্ন মত প্রকাশকারী নাগরিক, লেখক ও শিল্পীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং তাঁদের এমনকি হত্যা করাও হচ্ছে; এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করতে রাষ্ট্র তীব্র দমন নামাচ্ছে এবং নজরদারি চালাচ্ছে। পঞ্চাশ বছর আগে ভারতের যে গণতান্ত্রিক জনমত বাংলাদেশের মুক্তিকে সমর্থন জানিয়েছিল ও অভিনন্দিত করেছিল এবং আজ যাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সমবেতভাবে পরিকল্পিত ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে প্রতিহত করতে হচ্ছে, তাঁরা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিবাদী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর হাতে অধিকতর ক্ষমতার আকাঙ্খা করেন যাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুত লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক সাধারণভাবে বন্ধুসুলভ ও শান্তিপূর্ণই থেকেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ হিসেবে এই অঞ্চলে মৈত্রী ও সহযোগিতার পরিমণ্ডল বজায় রাখায় ভারতেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব রয়েছে, এবং এই আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতের কথা ধরলে তাতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। মোদী সরকারের আবির্ভাব কিন্তু এই সম্পর্কের মধ্যে এক নতুন চ্যালেঞ্জের উদ্ভব ঘটিয়েছে। দু’দেশের মধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা, জল বন্টন, পারস্পরিক সংযোগ ও বাণিজ্যের মত অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান এখনও যেমন বাকি আছে, সেরকমই ভারতের নাগরিকত্ব আইনে মোদী সরকার বৈষম্যমূলক সংশোধনী আনার ফলে তা দু’দেশের মধ্যে আস্থার সংকটের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত ভারতের তিন রাজ্য পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরায় বিজেপি’র গোটা রাজনৈতিক আলোচনাধারাই আবর্তিত হয় ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ঢোকার’ জুজু এবং তাদের নির্বাসিত করার তর্জনগর্জনকে কেন্দ্র করে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তথাকথিত এই ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বোঝাতে ‘উইপোকা’ শব্দটি ব্যবহার করেন, এবং তার থেকে অপরিহার্যযে সিদ্ধান্তটা বেরিয়ে আসে তা হল, এই উইপোকাগুলোকে নির্মূল করেই দেশকে বাঁচাতে হবে।
মজার ব্যাপার হল, তথাকথিত অনুপ্রবেশের এই বিষয়টা কিন্তু দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচ্যসূচির অন্তর্গত হয়না। এনআরসি নথিপত্র না থাকা নাগরিকদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়; আর সিএএ নথিপত্র না থাকা নাগরিক ও নথিপত্র থাকা শরণার্থীদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে ফারাক করতে চায়; উভয় আইনই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের তথাকথিত অনুপ্রবেশ ও সংখ্যালঘু নিপীড়নের উৎস হওয়াকে ভিত্তি করে এবং আইন দুটো অনুপ্রবেশকারীদের নির্বাসিত করার পরিসংখ্যানগত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। এরফলে ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ভারতের নিজের সংখ্যালঘুদের ভীতি প্রদর্শনের স্থায়ী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রসঙ্গত, মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরসূচীর মধ্যে বাংলাদেশে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দির পরিদর্শনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, এবং তা পশ্চিম বাংলা ও আসামে ভোট শুরুর লগ্নেই। বিদেশনীতির বিষয়ের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশকে মেশানোর প্রচেষ্টা আমাদের বিদেশনীতির কাঠামোকেই জটিল ও বিকৃত করে তুলবে।
বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ দ্বি’জাতি তত্ত্ব এবং ধর্মের ভিত্তিতে জাতি ও সংস্কৃতি নিরূপণের বিপজ্জনক প্রকল্পকে সংশয়হীনভাবে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছে। সেটা ছিল বৈচিত্রের এবং গণতন্ত্রের মধ্যে মর্যাদার আত্মঘোষণার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এটাকে সেই সমস্ত প্রচেষ্টার অযৌক্তিক ও সর্বনাশা তাৎপর্যের বিরুদ্ধে স্থায়ী হুঁশিয়ারি হিসেবেই বুঝতে হবে, যে প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতের বহুত্ববাদী বুনটকে অভিন্ন সত্ত্বায় নতুন রূপদান করা, বহু-ধর্মীয় বহু-সংস্কৃতির ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র রূপে নতুন করে চরিত্রায়িত করা এবং গণতন্ত্রকে সংখ্যাগুরুবাদী হিন্দু আধিপত্যের তুলি দিয়ে রাঙানো। সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ এমন কোনো বেদনাদায়ক অতীত নয় যাকে আমাদের ছাড়িয়ে যেতে হবে এবং কখনই যার পুনরাবৃত্তি ঘটানো চলবেনা। তাদের কাছে এটা বরং এক অসম্পূর্ণ প্রকল্প যাকে আবার শুরু করে সমাপ্ত করতে হবে। আমাদের পুবের প্রতিবেশীর আত্মপ্রকাশের সুবর্ণ জয়ন্তী বছরে তার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক মৈত্রী সম্পর্কের অঙ্গীকার করতে হবে এবং সুন্দরতর আগামীর জন্য ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৩ মার্চ ২০২১)